রায়পুরের এক পাঁচতারা হোটেলের লাউঞ্জ পেরিয়ে আলো-আঁধারি রেস্তরাঁয় পা রেখেই সঙ্গী দুই ভদ্রলোক কোণের একটি ‘রিজ়ার্ভড’ টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। “বোসো বোসো, আজ তোমার অনারে আমরা এখানে এসেছি।” যিনি কথাটি বললেন, তাঁকে দেখেই রেস্তরাঁয় তত ক্ষণে চাপা তৎপরতা। ম্যানেজার ও শেফ ছুটে এসেছেন ‘সাহেব’-দের খাতিরদারিতে। ছত্তীসগঢ়ের মাওবাদী দমন অভিযানে যাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই আইপিএস অফিসারের মুখে অতিথি আপ্যায়নের চকিত হাসি। তাঁর সঙ্গী আইপিএস অফিসারের মুখেও বন্ধুতার প্রশান্তি।
প্রসঙ্গটি ছিল ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী তৎপরতার পুলিশি ব্যাখ্যা ও তা দমনে কী কী ব্যবস্থা করছে রাজ্য সরকার। তখনও সেখানে বিজেপির শাসন, মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ। কংগ্রেসের ভূপেশ বঘেল ক্ষমতায় আসেননি। ডিআইজি পদমর্যাদার ওই অফিসার বিলক্ষণ জানেন যে, ভিনরাজ্যের কোন সাংবাদিক কী উদ্দেশ্যে কোথায় কোথায় যাচ্ছেন। লম্বা আড্ডা মানেই পেশাদার সাংবাদিকের ধর্ম মেনে নানা প্রশ্নের ব্যাখ্যা চাওয়া ও উত্তর খোঁজা!
উল্টো দিকটাও সমান সত্যি। গাড়িতে ওঠার আগে ভদ্রলোক বলেছিলেন, “এই যে তোমরা এখানে অবাধে এত জায়গায় যেতে পারছ, তার কারণ আমরা এটুকু ছেড়ে রেখেছি। মনে রেখো, যতটা সরকার চায়, তোমাদের স্বাধীনতাও ঠিক ততটুকু।” ঠোঁটে ঝোলানো হাসিতে কার্পণ্য নেই, “তুমি বাংলা থেকে মাঝে মাঝে আসো, ঘোরাঘুরি করো, জঙ্গলেও যাও— ঠিকই আছে। তবে তোমার স্থানীয় সাংবাদিক বন্ধুরা কিন্তু ভয় পায়! সাবধানে ঘুরো। জঙ্গলে অনেক সময় ক্রসফায়ার হয়!”
বক্তব্যের গূঢ় অর্থ স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। এই বক্তব্যই যুগে যুগে সত্য, তা তখ্তে যে দলই বসুক। তোমার স্বাধীনতা ঠিক ততটুকু যতটা আমি তোমাকে দেব!
সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক সূচকে ভারতের উত্তরোত্তর অবনতির মূল কারণটা হয়তো লুকিয়ে রয়েছে রাজতন্ত্রের এই অমোঘ উচ্চারণের মধ্যেই! আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দিবসে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ (আরএসএফ) ২০২২ সালের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে ভারত ১৫০তম স্থানে রয়েছে। আগের বছর সেই স্থান ছিল ১৪২-এ। আর ২০১৬-য় ভারতের জায়গা ছিল ১৩৩-এ। অর্থাৎ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারতের স্থান ক্রমেই নিম্নমুখী!
আরএসএফ-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসেন দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীক নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪-য় তিনি ক্ষমতায় আসার পরে তাঁর দল বিজেপি এবং কয়েকটি ধনী পরিবার, যারা বড় বড় মিডিয়া হাউস চালায়, তাদের মধ্যে চমকপ্রদ এক বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হিংসা, সংবাদমাধ্যমের মালিকানা কুক্ষিগত করে রাখা এবং রাজনৈতিক ভাবে একপেশে সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়, ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে’ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আজ বিপন্ন।
সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের উপর আক্রমণেরও নানা পন্থা রয়েছে। এ দেশে করোনাকালের কথাই ধরা যাক। সরকারি ভাষ্যের বিপরীতে গিয়ে যে সাংবাদিকরা ভিন্ন কথা বলার সাহস দেখিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত ৫৫ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা, যেমন, মামলা দায়ের হয়েছে, অনেককে জেলে পোরা হয়েছে, থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছে, কারণ দর্শানোর নোটিস জারি হয়েছে, অনেককে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এমনকি, শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করা ও সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের সম্পত্তি নষ্ট করার অভিযোগও উঠেছে। দিল্লির একটি সংস্থা, ‘রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিসিস গ্রুপ’ (আরআরএজি) এই তথ্য জানিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে পুরনো বৈরিতা পুষে রাখা আছে সেই গুজরাত দাঙ্গার সময় থেকেই। দেশ জুড়ে সংবাদমাধ্যমের লাগাতার সমালোচনায় বিদ্ধ মোদী ও তাঁর দল বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার সে সময় থেকেই ‘বেয়াড়া’ সাংবাদিকদের উপর খড়্গহস্ত। এর পর থেকেই মোদী সংবাদমাধ্যমের প্রচারকে অপপ্রচার বলেই মনে করে এসেছেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে জরুরি অবস্থা জারি করে বিরোধী নেতৃত্ব ও সাংবাদিকদের নির্বিচারে জেলে পুরেছেন। ২১ মাসের জরুরি অবস্থাকালে আস্ত প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া-কেই অবলুপ্ত করে দিয়েছেন। এমনকি স্থিতধী পণ্ডিত প্রাজ্ঞ মিতবাক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আমলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমও বিরুদ্ধ স্বর দমাতে নানা ব্যবস্থা করেছেন।
তবে বিরুদ্ধ স্বর দমিয়ে রাখতে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর মতো এতটা খুল্লমখুল্লা হতে অতীতে আর কাউকেই দেখা যায়নি। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন রাজ্যেও সাংবাদিক নিগ্রহ ঘটে চলেছে এন্তার। কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যাক। উত্তরপ্রদেশের হাথরসের ঘটনা ‘কভার’ করতে যাওয়ার পথে পুলিশ তাঁকে ধরে। তাঁর বিরুদ্ধে কুখ্যাত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ করে জেলে পাঠানো হয়। প্রায় দেড় বছর কেটে গেলেও আজও তাঁর মুক্তি হয়নি। কাশ্মীরওয়ালা-র সম্পাদক ফাহাদ শাহ-কে শ্রীনগরে জেলে পোরা হয়েছে। প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধেও ইউএপিএ প্রয়োগ করা হয়েছিল। পরে জামিনে মুক্ত হলেও তাঁকে কাশ্মীরের কুখ্যাত জনসুরক্ষা আইনে (পিএসএ) আবার গ্রেফতার করা হয়। এই আইনেরও বৈশিষ্ট্য হল, বিনা বিচারে কাউকে এক বছর পর্যন্ত কয়েদ করে রাখা যায়। উপত্যকার সাংবাদিক সাজাদ গুল-কেও কয়েদ করে রাখা হয়েছে।
রানা আয়ুবের মতো মহিলা সাংবাদিকদের অবস্থা আরও খারাপ। বিদেশযাত্রার সময় একেবারে শেষ মুহূর্তে বিমানবন্দরে তাঁকে আটকে দেওয়া তো তুচ্ছ বিষয়, তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে দেওয়া, বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দেওয়া, ধর্ষণের হুমকি দেওয়া— সব কিছুই এ দেশে চলছে বিনা বাধায়!
মোদীর সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ককে খুব চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন ক্রিস্তফ জাফ্রেলো তাঁর মোদী’জ় ইন্ডিয়া গ্রন্থে। ক্রিস্তফ বলছেন, মোদী স্থির করেছেন, তিনি সরাসরি ভারতবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। প্রথমত টুইট করে। দ্বিতীয়ত মাসিক রেডিয়ো অনুষ্ঠান ‘মন কি বাত’-এর মাধ্যমে। তিনি কোনও সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। দেশবাসীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের ভঙ্গিমা অনেকটাই ‘একমুখী’। এ ভাবেই তিনি মূলস্রোতের মিডিয়াকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছেন।
ক্রিস্তফের পর্যবেক্ষণ, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ধ্যানধারণা সম্পর্কে মোদী সরকারের স্পষ্টতই একটা অস্বস্তি রয়েছে। ২০১৪-য় তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচারমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন, সংবাদমাধ্যমের ‘লক্ষ্মণরেখা’ মেনে চলা উচিত। ‘স্বচ্ছতার নামে’ সরকারি অফিসারদের ভীতসন্ত্রস্ত না করে বরং ‘ভাল কাজ করার জন্য’ তাঁদের সাহায্য করা উচিত।
তখনই আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা আসলে ‘মুক্তচিন্তা’-র ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিতে চান। তাঁদের কাছে সাংবাদিকের স্বাধীনতা আর কাঁঠালের আমসত্ত্ব, দু’টিই এক বস্তু! হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক স্টিভেন লেভিতস্কি এবং ড্যানিয়েল জিবলাট তাঁদের বিখ্যাত গ্রন্থ হাও ডেমোক্র্যাসিজ় ডাই-তে বলছেন, যাঁদেরকে কেনা যায় না তাঁদের নানা ভাবে দুর্বল করে দেওয়া যায়।
অতীতে স্বৈরাচারী শাসকেরা তাঁদের বিরোধীদের কয়েদ করতেন, নির্বাসনে পাঠাতেন, এমনকি হত্যাও করতেন। কিন্তু এখনকার স্বৈরাচারীরা তাঁদের দমনপীড়নকে আইনি মোড়কে ঢেকে রাখেন! বিভিন্ন দেশে সরকারবিরোধী মিডিয়াকে আইনি পথেই সহজে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়।
হয়তো বা ভিন্ন প্রেক্ষাপট, কিন্তু অবাধ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতাকে যাঁরা ‘অপরাধ’-এর পর্যায়ে টেনে নামিয়েছেন, এই উদাহরণ কি তাঁদের জন্যও সুপ্রযুক্ত নয়?
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।