বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙায় কয়লাখনি প্রকল্পটির আসল চরিত্র, জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে অস্বচ্ছতা এবং পরিবেশের উপর এর সম্ভাব্য কুপ্রভাব নিয়ে অনেকগুলি প্রশ্ন উঠেছে। প্রস্তাবিত কয়লাখনির ক্ষেত্রে প্রকল্পের সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট চূড়ান্ত করার আগেই গত নভেম্বরে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটি ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের প্যাকেজ ঘোষণা করে দেওয়া হয়। তার পর থেকেই প্রকল্প অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে সেই প্যাকেজের প্রচার চালিয়ে সম্মতি আদায়ের জন্য নানাবিধ চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের না হয়েছে কোনও গণশুনানি, না নেওয়া হয়েছে গ্রামসভার সম্মতি। সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নের রিপোর্টও চূড়ান্ত হয়নি। ২০১৩-র জমি অধিগ্রহণ আইনকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে কেন?
রাজ্য সরকারের ক্ষতিপূরণ প্যাকেজে জানানো হয়েছে যে, কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য মোট ৩৪০০ একর জমি নেওয়া হবে, যার মধ্যে ২২৬৭ একর জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন। মহম্মদবাজার ব্লকের ১৮টি গ্রামে ৩০১০টি পরিবার বাস্তুহারা হবে, যার মধ্যে আদিবাসী পরিবার ১০১৩টি। এ ছাড়াও, অন্য অঞ্চলে বসবাসকারী আরও ১৮২৮টি পরিবারের জমিও অধিগৃহীত হবে। জেলা প্রশাসন দাবি করছে যে, ১৬০০টি পরিবার নাকি ইতিমধ্যেই জমি অধিগ্রহণের জন্য সম্মতি জানিয়েছে, যার মধ্যে আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষতিপূরণের চেক, জমির পাট্টা বা চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে ২০৩ জনকে। জমি অধিগ্রহণের জন্য সম্মতি নেওয়ার প্রক্রিয়া আইন মোতাবেক শেষ না করেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ শুরু করে দেওয়া হল কেন?
প্রশাসন যাঁদের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে জমি দিতে ইচ্ছুক বলে চিহ্নিত করছে, তাঁদের অনেকেই এখন আর ডেউচা-পাঁচামি অথবা দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা নন। এই অঞ্চলের স্থায়ী বসবাসকারী আদিবাসীদের বহুলাংশই কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য নিজেদের বাস্তুভিটে, চাষের জমি, জাহের থান, মাঝি থান, চারণভূমি এবং জীবনশৈলী ছেড়ে প্রতিশ্রুত কোনও এক পুনর্বাসন কলোনির ৭০০ বর্গফুটের বাড়িতে চলে যেতে অনিচ্ছুক। গত কয়েক দশকে প্রকল্প অঞ্চলে পাথর খাদান-ক্রাশারের বেলাগাম বৃদ্ধি এক দিকে যেমন স্থানীয় পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের উপর নানাবিধ কুপ্রভাব ফেলেছে, অন্য দিকে তিন হাজারের বেশি আদিবাসীকে জীবিকা নির্বাহের জন্য এই খাদান-ক্রাশার অর্থনীতির উপরেই নির্ভরশীল করে তুলেছে। কয়লাখনি হলে শুধু ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ নয়, আদিবাসীরা কর্মচ্যুতও হবেন। যদি বিঘা প্রতি ১৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিনিময়েও আদিবাসীরা ভিটে মাটি থেকে না সরতে চান, তা হলে তাঁদের বলপূর্বক উচ্ছেদ করা যায় কি?
বিশ্বের সর্ববৃহৎ কয়লা উৎপাদক সংস্থা কোল ইন্ডিয়া বর্তমানে দেশ জুড়ে ৩৪৫টি কয়লাখনি চালায়। ২০১১-১২ অর্থবর্ষে কোল ইন্ডিয়ার উৎপাদন ছিল ৪৩ কোটি টন, মোট কর্মী ছিলেন ৩.৭ লক্ষের বেশি; এক দশক পর চলতি অর্থবর্ষে তার উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৫৪ কোটি টন, কিন্তু কর্মীর সংখ্যা কমে হয়েছে ২.৫ লক্ষ। এটাই কয়লাশিল্পে কর্মসংস্থানের বাস্তব। মুখ্যমন্ত্রী যা-ই দাবি করুন, ডেউচা-পাঁচামির মতো বৃহৎ কয়লাখনি প্রকল্পে এক লক্ষ কর্মসংস্থান হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সম্ভবত সে কারণেই পুলিশবাহিনীতে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, খনির কাজে নয়।
ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ অনুযায়ী, বর্তমানে চালু ২৮৫টি ক্রাশার ইউনিটকে উচ্ছেদ করা হবে। জমির দাম ছাড়া একটি প্রস্তাবিত ‘ব্যাসল্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’-এ ক্রাশার ইউনিটগুলিকে স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং ব্যবসার ক্ষতিপূরণ বাবদ ছয় মাস ধরে সেখানে বিনামূল্যে ইউনিটপ্রতি রোজ ১০ ট্রাক পাথর দেওয়ার কথাও বলা আছে, যার বাজারমূল্য নাকি প্রায় এক কোটি টাকা। প্রশ্ন হল, যদি কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য চালু পাথর খাদান এবং ক্রাশার ইউনিটগুলিকে উচ্ছেদ করতে হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ রোজ যে পাথর দেওয়া হবে, তা আসবে কোথা থেকে? কালো পাথরের বাজারদর তার গুণমানের উপর নির্ভরশীল। পাঁচামির খাদানের পাথরের যা দাম, নলহাটি বা রামপুরহাটের খাদানের পাথরের দাম তার থেকে অনেকটাই আলাদা। ক্রাশার ইউনিটগুলিকে বিনামূল্যে পাথরের জোগান দেওয়ার নামে অনিয়ম-দুর্নীতি-তোলাবাজির নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে যাবে না তো?
ক্ষতিপূরণ বাবদ মুখ্যমন্ত্রী যে ১০,০০০ কোটি টাকার অঙ্ক ঘোষণা করেছেন, সে টাকা আসবে কোথা থেকে? গত দুই বছরে অতিমারিজনিত আর্থিক সঙ্কট সামলাতে এক দিকে রাজ্য সরকারের ব্যয় বেড়েছে, অন্য দিকে আয় কমেছে। ফলে রাজস্ব ঘাটতি ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ১৯,৭০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে হয়েছে প্রায় ৩৩,০০০ কোটি টাকা। ২০২০-র মার্চ থেকে ২০২২-এর মার্চের মধ্যে রাজ্য সরকারের মোট ঋণের বোঝা বেড়েছে ৯৬,০০০ কোটি টাকা। কোষাগারের এই বেহাল দশার মধ্যে ১০,০০০ কোটি টাকার বাড়তি বোঝা সরকারের পক্ষে বহন করা মুশকিল।
ইতিপূর্বে দু’বার ডেউচা-পাঁচামিতে কয়লাখনি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল— ২০০৮ সালে এনএমডিসি, ডব্লিউবিএমডিটিসিএল এবং কোল ইন্ডিয়ার যৌথ উদ্যোগে; এবং ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও পঞ্জাবের রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলির যৌথ উদ্যোগে। দু’বারই যৌথ উদ্যোগের সহযোগীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। দেশের এই ‘সর্ববৃহৎ’ কয়লাখনি প্রকল্পে অংশীদার হতে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা উৎপাদক সংস্থা কোল ইন্ডিয়া-সহ অন্যান্য সংস্থা উৎসাহী হল না কেন?
জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া আগেই জানিয়েছে যে, ডেউচা-পাঁচামিতে ভূগর্ভস্থ কয়লাস্তরের গভীরতা এবং পুরুত্ব ভারতের অন্যান্য কয়লাখনির তুলনায় অনেক বেশি, যেটা খনন করতে বিদেশি প্রযুক্তি চাই। মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, ডেউচা-পাঁচামির কয়লাখনি প্রকল্পে ৩৫,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতরের বার্ষিক বাজেট যেখানে ৪,০০০ কোটি টাকার কম, সেখানে কয়লাখনি প্রকল্পে ৩৫,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আসবে কোথা থেকে?
ডেউচা-পাঁচামির মাঝারি থেকে নিম্ন গ্রেডের কয়লা খননে দেশি বা বিদেশি কোনও বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাকে আকর্ষিত করতে কয়লাস্তরের উপরে থাকা উৎকৃষ্ট মানের কালো পাথর সেই সংস্থাকে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে দিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। তা হলে কয়েকশো ছোট থেকে মাঝারি পাথর খাদান-ক্রাশার ইউনিটকে উচ্ছেদ করে একটা বৃহৎ একচেটিয়া সংস্থাকে পাথর এবং কয়লা দুটোই এক সঙ্গে খনন করার বরাত দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কিন্তু প্রকল্পের মালিকানার চরিত্র পাল্টাবে। ২০১৩-র আইন অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি যৌথ মালিকানার (পিপিপি) প্রকল্পের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তত ৭০ শতাংশের সম্মতি থাকতে হবে। প্রকল্পের মালিকানার চূড়ান্ত চরিত্র নির্ণয় না করে জমি অধিগ্রহণের জন্য সম্মতি আদায়ের প্রক্রিয়া চালানো কি আইনসম্মত?
বৃহৎ কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করা পরিবেশ সুরক্ষা আইন এবং নিয়মাবলি অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। বৃহৎ খোলা মুখ কয়লাখনি হলে প্রকল্প এলাকা এবং আশেপাশের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ডেউচা-পাঁচামির ভূগর্ভস্থ জলস্তর, দ্বারকা নদী এবং ওই অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রেরও ক্ষতি হতে পারে। স্থানীয় পরিবেশের উপর কুপ্রভাবের ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
সর্বোপরি, নতুন খনি থেকে আরও ২০০ কোটি টন কয়লা তুলে পোড়ালে যে বিপুল কার্বন নিঃসরণ ঘটবে, তা বিশ্ব উষ্ণায়নকেও ত্বরান্বিত করবে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব জুড়ে কয়লাচালিত তাপবিদ্যুতের অনুপাত কমিয়ে এনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির অনুপাত বাড়ানোর বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, ভারতও যে বোঝাপড়ার শরিক। অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও আগামী দিনে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে আসবে, বিকল্প শক্তির উৎপাদন বাড়বে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১০০ বছর কয়লার জোগান দেওয়ার জন্য আর একটা নতুন কয়লাখনি চালু করা কি দূরদৃষ্টির পরিচয়? বিশ্ব জুড়ে যখন কয়লার ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ কেন তার উল্টো রাস্তায় হাঁটবে? ১০,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রান্তিক মানুষদের উচ্ছেদ করে কয়লাখনি না বানিয়ে ওই টাকা পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করা যায় না কি?
ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্প সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে রাজ্য সরকারকে এই প্রশ্নগুলির সদুত্তর খুঁজতে হবে।