লড়াই: বিভিন্ন দাবি নিয়ে আশা স্বাস্থ্যকর্মী ইউনিয়নের বিক্ষোভ। সন্দীপ পাল।
অজস্র ভোট-চুটকি বাদলা পোকার মতো ভোঁ-ভোঁ করছে মোবাইলে। তার মধ্যে একটা মেসেজ মাথায় ঢুকে গিয়েছে— “গণতন্ত্রের উৎসব এসে গিয়েছে, ভোট দিয়ে বেছে নিন পছন্দের স্বৈরতন্ত্রীকে।” সত্যিই তো, শীর্ষ নেতাদের কথা নাহয় সরিয়ে রাখা গেল, নিজের কেন্দ্রের প্রার্থীটিই কি আমার প্রতিনিধি? গত লোকসভার ৮৭ শতাংশ সাংসদ ছিলেন কোটিপতি, গড় সম্পত্তি একুশ কোটি টাকা। তাঁরা কী অর্থে আমাদের ‘ঘরের ছেলে-মেয়ে’, কী করেই বা আপনি-আমি বলগর্বী নেতার পরিবার? তার উপর সাংসদদের কথা এবং নীরবতা, দুই-ই ব্যবসায়ীদের পকেটে। সংসদ এখন গণতন্ত্রের ঝুলনযাত্রা, সাংসদরা তার পুতুল।
বছর-বছর রুদ্ধশ্বাস ভোট-খেলা হয়। সার্থক প্রতিনিধিত্ব কী, সে প্রশ্নটা অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। এক জন লোক আরও পাঁচ জনের ‘প্রতিনিধি’ হতে পারে কী করে, সে তর্ক প্রাচীন। ফরাসি দার্শনিক রুশো তো বলেইছিলেন, গণতন্ত্র মানে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র— প্রত্যেককে নিজের নিজের কথা বলতে হবে। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসভা প্রতিনিধি নইলে অচল। এই যে আইন করে সংসদে মেয়েদের আসন বাড়ানো হল, তা এই ধারণার ভিত্তিতে যে, মহিলা সাংসদরা মেয়েদের ‘প্রতিনিধি’। কিন্তু ‘মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব’ মানে কী? বসিরহাটের সাংসদ ছিলেন মহিলা, ডজন ডজন মহিলা পঞ্চায়েত সদস্যও ছিলেন। তবু সন্দেশখালির মেয়েদের হয়ে কেউ মুখ খোলেননি। মেয়েদেরই নামতে হয়েছে পথে।
কে আমার কথা বলবে, এ প্রশ্নটা তুলছেন পশ্চিমবঙ্গের খেটে-খাওয়া মেয়েরাও। সম্প্রতি একটি আলোচনায় এসেছিলেন ইটভাটায়, চা-বাগানে, চটকলে, নির্মাণক্ষেত্রে কর্মরত মেয়েরা। ছিলেন আশাকর্মী, মিড-ডে মিল কর্মী, চাষি-খেতমজুর, বিড়িশ্রমিক, গৃহপরিচারিকা, গিগকর্মী, ক্যাবচালক। প্রায় সকলেরই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আছে। রাজনৈতিক জ্ঞান টনটনে— মেয়েদের ন্যায্য মজুরি, কিংবা মাতৃত্বের ছুটির দাবি কী ধরনের বিরোধিতার মুখে পড়ে, মালিকপক্ষ কী বলে, প্রশাসন আর রাজনৈতিক দল কী অবস্থান নেয়, পরিষ্কার বুঝিয়ে দেন এই মেয়েরা।
সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বৃহৎ ও সফল ধর্মঘট করলেন আশাকর্মীরা। রাজ্যের ৭০ হাজার আশাকর্মীর ৯৮ শতাংশ যোগ দিয়েছিলেন। রাজ্য সরকার বাধ্য হয়েছে তাঁদের দাবি আংশিক মেটাতে। আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ইসমত আরা খাতুনকে এসইউসিআই এ বার প্রার্থী করেছে কৃষ্ণনগরে। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল কর্মীদের যা প্রধান দাবি: ‘স্কিম কর্মী’দের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি, তা স্থান পেয়েছে তাদের ইস্তাহারে। কিন্তু কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল বা সিপিএম— কোনও দল তা উল্লেখ করেনি। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ট্রেড ইউনিয়ন বহু দিন ধরে তা সুপারিশ করে আসছে, তবু এই দেশের অন্তত ষাট লক্ষ মহিলাকর্মীর দাবি গণতন্ত্রে অনাথ।
এ কেবল সরকারের ‘ভাঁড়ে ভবানী’ দশার জন্য নয়। বাজার যে ভাবে শ্রমের অবমূল্যায়ন করছে, রাজনীতি তার নীরব দর্শক। চুক্তিতে বা ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ, ছাঁটাইয়ের ভয়, নগণ্য বেতন, সময়-সীমাহীন কাজ, অপমানজনক শর্ত— এই অসহনীয় ব্যবস্থা দক্ষ ও অদক্ষ, সব ধরনের কর্মীকে কার্যত দাস শ্রমিক করে তুলেছে। যে কারণে স্রেফ তিন বেলা খাবারের পরিবর্তে কোচবিহারে তামাক পাতা তোলা, কাটা, বাঁধার কাজ করেন মেয়েরা; হাজার বিড়ি বাঁধেন ১৪০ টাকায় (ন্যায্য মজুরি ২৭৩ টাকা); সেই কারণেই মাসে তিন হাজার টাকায় শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয় স্কুল-কলেজ, সরকারি প্রকল্পে বি-টেক প্রার্থী নিয়োগ হয় ১৫ হাজার টাকা বেতনে। কোন দল এ ব্যবস্থার অবসান চেয়েছে?
মজুরি-ঘাটতির উপর চাপে মেয়ে হয়ে জন্মানোর জরিমানা। ভারতে নির্মাণক্ষেত্রে মজুরদের অন্তত ত্রিশ শতাংশ মেয়ে, তাঁদের দৈনিক মজুরি পুরুষদের অর্ধেক। খেতমজুরদের সত্তর শতাংশ মেয়ে, মজুরির ফারাক ৫০-১৫০ টাকা। অস্থায়ী, অদক্ষ কর্মী করে রাখা হয় মেয়েদেরই বেশি। চা-বাগানে মেয়েরা কম মজুরিতে পাতা তোলার শ্রমসাধ্য কাজ করেন আজীবন, ফ্যাক্টরির কাজ পুরুষদের জন্য ‘সংরক্ষিত’। যে কোনও কর্মক্ষেত্রে একটি মেয়ের মজুরি-বঞ্চনার অঙ্ক বহু, বহু গুণ ছাপিয়ে যায় তার প্রাপ্য সব সরকারি অনুদানের মিলিত অঙ্ককে। খেতমজুর মেয়েকে জমির মালিক চাষের জমি লিজ় দেন না, ইটভাটার মেয়েমজুরকে ইট বইবার ভ্যান কেনার ঋণ দেয় না ব্যাঙ্ক। স্রেফ মেয়ে বলেই। বাজারের এই অন্যায়ের প্রতিকার না করে, মালিক-ঠিকাদার চক্রকে শাসন না করে, মেয়েদের অনুদান ধরাতে চান নেতারা। সমান মজুরির গ্যারান্টি দিচ্ছে কোন দল, কোন প্রার্থী?
শুধু টাকার অঙ্কে মার খাচ্ছেন মেয়েরা, তা নয়। টিটাগড়ের মিনা খাতুন চটকলে সাড়ে চারশো টাকা পেতেন। এখন কাগজ কুড়োন, দিনে দেড়শো টাকা আয়। কেন? “আট-দশ ঘণ্টা কাজ করলে বাচ্চাদের দেখবে কে?” চটকলে ক্রেশ থাকার কথা, নেই। পশ্চিমবঙ্গের আঠারো হাজার নথিভুক্ত কলকারখানার একটিতেও ক্রেশ নেই। গিগকর্মী, ক্যাবচালক, হকার, সেলস কর্মী, মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ মেয়েরা জানালেন, পাবলিক টয়লেট খুঁজে তাঁরা হয়রান হন। হয় রোজগার নয় সন্তানের দেখাশোনা, হয় চাকরিরক্ষা নয় কিডনির সুরক্ষা, হয় মজুরি নয় ইজ্জত— এমন সব শর্ত দেশের অর্ধেক নাগরিকের সামনে। অথচ, রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়নের চোখে, এ সব হল ‘ছোটখাটো’ কথা। এই কদর্য অসাম্য নাকি ইস্তাহারে লেখার মতো, নির্বাচনী প্রচারে বলার মতো, তেমন কিছু নয়।
গরিব, শ্রমজীবী মেয়েরা সংসদ-বিধানসভায় নির্বাচিত হচ্ছেন না, এটাই কি তবে সঙ্কট? সমাজবিজ্ঞানী সুদীপ্ত কবিরাজ বলছেন, প্রতিনিধির পরিচিতি বড় কথা নয়। নাটকে এবং রাজনীতিতে ‘রিপ্রেজ়েন্টেশন’ বিষয়ে একটি নিবন্ধে তিনি লিখছেন, সীতাহারা রামের দুঃখ কেমন, তা কল্পনা করেন অভিনেতা। মঞ্চে তার রূপায়ণে দর্শকরা নিজের নিজের দুঃখকে দেখেন। তেমনই, রাজনৈতিক প্রতিনিধি কেবল আয়নার মতো নির্বাচকদের বাস্তব পরিস্থিতি প্রতিফলন করেন না। বৈষম্যের গ্লানি, অবমাননার বেদনা, পীড়িতের নিরুপায় ক্রোধকে তিনি কল্পনায় ধরেন, ভাষা দিয়ে তার নির্মাণ করেন। তাঁর তুলে-ধরা ছবিতে দর্শক নিজের অভিজ্ঞতা-অনুভূতিকে আরও স্পষ্ট, আরও তীব্র ভাবে দেখতে পান। সেই দেখা সামূহিক, সত্য এবং দ্ব্যর্থহীন। জনপ্রতিনিধির সেই নির্মাণ থেকেই ‘দর্শক-নির্বাচক’ জনগোষ্ঠী নিজেদের তাৎপর্য খুঁজে পায়। এমন তাৎপর্য নির্মাণ করার জন্য বিতর্ক-আলোচনার যে প্রক্রিয়া, সুদীপ্তবাবুর মতে তা-ই রয়েছে প্রতিনিধিত্বের কেন্দ্রে। যার মানে, যে প্রার্থীরা এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যান না, তাঁরা সকলেই স্বৈরতন্ত্রী। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়।
সুদীপ্তবাবুর মতে, এই অর্থে জনগোষ্ঠী নেতা তৈরি করে না, নেতাই নিজের জনগোষ্ঠী তৈরি করেন। কৃষিজীবী-শ্রমজীবী মেয়েরা ভারতের বৃহত্তম নির্বাচক মণ্ডলী। তাঁদের শ্রমশক্তির চূড়ান্ত শোষণ, তাঁদের নিষ্করুণ জীবনসংগ্রাম সবাই দেখছে। অথচ, কোনও নেতা তা থেকে নিজের নির্বাচক মণ্ডলী, তথা ভোট ব্যাঙ্ক নির্মাণ করতে পারলেন না। এই হল ভারতে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের সঙ্কট।