পরিবারের হাত ছাড়লে দলের ভাল, কিন্তু সে উপায় কোথায়?
Congress

চক্রব্যূহে কংগ্রেস

মল্লিকার্জুন খড়্গে, যিনি জানিয়েই রেখেছেন, সভাপতি হলে ‘পরিবার’-এর পরামর্শ নিতে তিনি ইতস্তত করবেন না মোটেও।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২২ ০৪:৩৭
Share:

(অ)পরিবর্তন: কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর মল্লিকার্জুন খড়্গেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন সনিয়া গান্ধী। ১৯ অক্টোবর, নয়াদিল্লি। পিটিআই।

যুদ্ধের ফলাফল জানা ছিল আগেই। হারলেন শশী তারুর, জিতলেন মল্লিকার্জুন খড়্গে— সাত গুণ বেশি ভোট পেয়ে। সেই খড়্গে, যিনি জানিয়েই রেখেছেন, সভাপতি হলে ‘পরিবার’-এর পরামর্শ নিতে তিনি ইতস্তত করবেন না মোটেও। অর্থাৎ, কংগ্রেস যেখানে ছিল, ঠিক সেখানেই থাকল— সভাপতির পদে যিনিই থাকুন, পার্টি চলবে পরিবারের ইচ্ছাতেই। অনুমান করেছিল, নিয়ন্ত্রণ দশ জনপথের হাতেই থাকবে, এই ভরসাতেই দেশ জুড়ে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলো খড়্গেকে সমর্থন করেছিল নির্দ্বিধায়। কয়েক বছরের মধ্যেই যদি খড়্গেকে রাহুল বা প্রিয়ঙ্কার জন্য ২৪ আকবর রোডের সিংহাসন খালি করে দিতে হয়, আশ্চর্য হওয়ার কারণ থাকবে না। তারুর কংগ্রেস সভাপতি হলেও ছবিটা সম্ভবত শেষ অবধি অন্য রকম হত না। কংগ্রেসে ‘বহিরাগত’ শশী আস্থা অর্জন করতে পারতেন না পার্টির, এবং শেষ অবধি সরতে হত তাঁকেও। সভাপতির আসনে হয় রাহুল বা প্রিয়ঙ্কা আসতেন, অথবা খড়্গের মতোই অন্য কেউ।

Advertisement

এখানেই একটি মোক্ষম ধাঁধা। এক দিকে, দলকে নেতৃত্ব দিতে রাহুল গান্ধীর ব্যর্থতা এবং অনীহা প্রশ্নাতীত। গত দশ বছরে তাঁর ব্যর্থতাকেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রধানতম অস্ত্র বানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী— রাহুল সেই আক্রমণ সামলাতে পারেননি, দলও নয়। সনিয়াও বয়সের ভারে অশক্ত, ২০০৪-এ প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর আত্মত্যাগের জৌলুসও সময়ের ছাপে ফিকে হয়ে এসেছে। অন্য দিকে, শত বিপর্যয়ের পরেও, ভারতীয় রাজনীতিতে কার্যত ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষিত হয়ে যাওয়ার পরেও, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের মোট ভোট-শেয়ার ছিল বিজেপির পরেই, সাড়ে উনিশ শতাংশ। এবং, তার পরের সাতটি দলের— সাতটিই আঞ্চলিক দল, যথাক্রমে তৃণমূল কংগ্রেস, বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, ডিএমকে, শিবসেনা ও তেলুগু দেশম— মোট ভোট-শেয়ারের পরিমাণ কংগ্রেসের চেয়ে কম। তা হলে কংগ্রেসের নেতারা নেতৃত্বে অক্ষম সনিয়া-রাহুল-প্রিয়ঙ্কাকে ঝেড়ে ফেলে নতুন করে সংগঠন তৈরি করতে এমন অনিচ্ছুক, এমনকি ভীত কেন?

এই প্রশ্নের আংশিক উত্তর রয়েছে ইতিহাসে। সদা-সন্ত্রস্ত ইন্দিরা এবং ক্ষমতামত্ত সঞ্জয় দলে উন্নতির একমাত্র মাপকাঠি করেছিলেন এক নম্বর সফদরজং রোডের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যকে। কিন্তু, সেই আনুগত্য বজায় রাখার মোক্ষম ব্যবস্থাটিও তৈরি করে রেখেছিলেন তাঁরা— কংগ্রেসে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের যে ধারাবাহিক সংস্কৃতি ছিল, তাকে কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে। কার্যত প্রতিটি রাজ্যেই কংগ্রেসের একাধিক গোষ্ঠী, এবং সেই আন্তঃগোষ্ঠী বিবাদে থার্ড আম্পায়ারের ভূমিকায় নেহরু-গান্ধী পরিবার, এই ব্যবস্থা জারি থেকেছে টানা পঞ্চাশ বছর। প্রায় তিন দশকের ব্যবধানে দুটো উদাহরণ দিলে ব্যবস্থাটা আরও খানিক স্পষ্ট হবে। ১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান, এবং মূলত সোমেন মিত্রের নেতৃত্বে সমানে তাঁকে বাগড়া দিয়ে যাওয়ার কথা এখনও জনস্মৃতিতে প্রবল। মমতার নেতৃত্বে রাজ্যে কংগ্রেস শক্তিশালী হলে শেষ অবধি লাভ হত দলেরই, হয়তো ২০১১ সালের আগেই ক্ষমতা হারাত বামফ্রন্ট। কিন্তু, দলীয় সংস্কৃতিই যখন নিজের বা গোষ্ঠীর আখের গুছিয়ে নেওয়ার, তখন বৃহত্তর লাভের কথা ভাবার অবকাশ হয়নি। ফল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেসের সাইনবোর্ডটুকুও মুছে গিয়েছে ক্রমে, মমতা তার পুরো জমি দখল করে নিয়েছেন। সাম্প্রতিকতর উদাহরণ হল রাজস্থান। অশোক গহলৌত বনাম সচিন পাইলটের দ্বন্দ্বটিও জিইয়ে রেখেছে হাই কমান্ড। মমতা দল ভেঙে সফল, সচিন বিদ্রোহ ঘোষণা করেও ফিরে এসেছেন দলের ছত্রছায়ায়। কিন্তু তাতে মূল গল্পটা পাল্টায়নি— কংগ্রেসে থাকতে হলে বাঁধা থাকতে হবে পরিবারের সুতোয়, অথবা ছেড়ে দিতে হবে দল। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র অনেক পরের কথা, কংগ্রেসে থাকার প্রথম শর্ত হল, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ছেঁটে নিতে হবে পরিবারের ইচ্ছার মাপ অনুসারে।

Advertisement

ফলে, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, এমন একের পর এক নেতা দল ছেড়েছেন। সেই প্রবণতাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করলেও একটা গল্প বেরিয়ে আসতে পারে। কংগ্রেস ভেঙে আলাদা দল তৈরি করার ঘটনা নতুন নয়— ১৯২৩ থেকে ১৯৭৭ অবধি প্রায় কুড়ি বার ভেঙেছে কংগ্রেস। কিন্তু ইন্দিরা-সঞ্জয় জমানা থেকে দল ভাঙার পিছনে আদর্শগত কারণ দেখানোর নটেশাকটুকুও রাখেননি কেউ। কার্যত প্রতি বারই দল ভেঙেছে কোনও আঞ্চলিক গোষ্ঠীপতি পরিবারের কাছে যথেষ্ট পাত্তা না পাওয়ার ফলে। তাঁদের মধ্যে যেমন শরদ পওয়ার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা জগন রেড্ডি আছেন, তেমনই আছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, পালনিয়াপ্পন চিদম্বরমরাও। প্রণব, চিদম্বরমের সাধ্য ছিল না নিজেদের দল চালানোর। দরকষাকষি করে তাঁরা পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসে ফিরেছেন, ক্ষমতাও পেয়েছেন, কিন্তু জনসমর্থন পাননি। জনতাকে প্রভাবিত করার সাধ্য ছিল যাঁদের, তাঁরা নিজেদের দলকে পুষ্ট করেছেন, নিজেদের রাজ্যে কংগ্রেসের পায়ের নীচের মাটি কেড়ে নিয়ে।

জগন্মোহন রেড্ডিই শেষ নেতা, যিনি কংগ্রেস ভেঙে সফল ভাবে নিজের দল চালাতে পেরেছেন। সেই সাফল্য অবশ্য বহুলাংশে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত— তাঁর বাবা ওয়াইএসআর রেড্ডি, প্রথম সারির ইন্দিরা-অনুগত, অন্ধ্রপ্রদেশের কংগ্রেস গোষ্ঠী-রাজনীতির তাস খেলেছিলেন নিপুণ হাতে। জগন কংগ্রেস ছেড়েছেন এক দশক আগে। পরের এক দশকে বহু নেতা কংগ্রেস ছেড়েছেন, কিন্তু ব্যতিক্রমী দু’এক জন বাদে নতুন দল গড়েননি কেউই। বিভিন্ন রাজ্যের বিধায়করা সরাসরি যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে; জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, সুনীল জাখর, আরপিএন সিংহের মতো ওজনদার নেতারাও কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন; ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ দিনকয়েকের জন্য নিজের দল গড়ে শেষে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন; অনুমান, গুলাম নবি আজ়াদও সে পথেই হাঁটবেন। অন্য দিকে রয়েছেন কপিল সিব্বল, অশ্বিনী কুমারের মতো বিক্ষুব্ধ নেতারা, যাঁরা কার্যত রাজনীতির বাইরে চলে গিয়েছেন আপাতত। এই উদাহরণগুলো থেকে একটা কথা অনুমান করা যায়— অন্তত গত এক দশকে কংগ্রেসে এমন কোনও নেতা নেই, যাঁর নিজের জোরে দল চালানোর সাধ্য আছে। পরিবারের কাছে আত্মসমর্পণের সংস্কৃতি দলের মধ্যে নেতা তৈরির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব, পরিবারের শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় কী?

২০২০ সালে যে ২৩ জন নেতা পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে জি-২৩ নামে খ্যাত হলেন, তাঁদের তালিকার দিকে তাকালে এই কথাটি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। শশী তারুর, মণীশ তিওয়ারি, আনন্দ শর্মা থেকে মিলিন্দ দেওরা, এমনকি ভূপিন্দর সিংহ হুডা, ময়দানের রাজনীতিতে প্রত্যেকেই অচল আধুলি। কারও দৌড় দক্ষিণ মুম্বইয়ে সীমাবদ্ধ, কেউ হরিয়ানার গোটাদুয়েক জেলায় প্রভাবশালী, কারও দাপট আবার টেলিভিশনের পর্দা বা সোশ্যাল মিডিয়ার গণ্ডি ছাড়ায় না। পরিবারের বিরুদ্ধে মিনমিনে স্বরে বিদ্রোহের বেশি তাঁরা কিছু করে উঠতে পারেননি। এবং, তাঁদের মধ্যেও বিভাজনের রাজনীতিতে সক্ষম সনিয়া গান্ধী। বিদ্রোহ ঘোষণার পরই পৃথ্বীরাজ সিংহ চৌহান, মুকুল ওয়াসনিক, জিতিন প্রসাদের মতো বেশ কিছু নেতাকে এই কমিটির চেয়ারম্যান বা ওই রাজ্যের পর্যবেক্ষক করে দেওয়া হল। বিদ্রোহের নরম সুরও নরমতর হল।

কংগ্রেস আসলে একটা চক্রব্যূহে ঢুকে বসে আছে, যেখান থেকে বেরোনোর রাস্তা কারও জানা নেই। দলের সব নেতা যদি ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে, নিজস্ব ইগো বিসর্জন দিয়ে এক হতে পারতেন, যদি একে অন্যকে টেনে নামানোর খেলার বদলে পরস্পরের সহযোগী হতেন, তা হলে ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় ছিল। বিশেষত, এ কথা স্পষ্ট যে, এখনও প্রতি পাঁচ জন ভারতীয়ের মধ্যে এক জন কংগ্রেসকে ভোট দেন— দলটিকে দেখে যদি শক্তিশালী মনে হত, তা হলে সম্ভবত আরও অনেকেই দিতেন— এবং, বিজেপি-বিরোধী প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ, উদার বহুত্ববাদী পরিসরে কংগ্রেসের এখনও কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু, কংগ্রেসের দুর্ভাগ্য, ভারতেরও, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিস্বার্থে চালিত হতে চির-অভ্যস্ত তার নেতারা পরস্পরের হাত ধরবেন, সে সম্ভাবনা আপাতত সুদূরপরাহত।

এই অবস্থায়, নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থটুকু টিকিয়ে রাখতে দলের শীর্ষে পরিবারের অস্তিত্ব বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা ছাড়া তাঁদের আর কিছুই করার নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement