পুজো প্রায় এসে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব পুজো কমিটিগুলোকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। সঙ্গে বিদ্যুৎ বিলে ছাড়-সহ আরও নানা সরকারি সুবিধা। অবশ্য পুজো যত এগিয়ে আসছে, আনন্দের সঙ্গে বাড়ছে আতঙ্কও। বছর দেড়েক ধরে কোভিড-অতিমারিতে মানুষের জীবন-জীবিকা এমনিতেই বিপর্যস্ত, আপাতত পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা, অক্টোবরের মাঝামাঝি আছড়ে পড়তে পারে তৃতীয় ঢেউ। সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় সরকারও। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও উৎসবের দিনগুলোয় পুজো কমিটি ও আমজনতার কর্তব্য সম্পর্কে একগুচ্ছ নির্দেশিকা জারি করেছে।
কেবল অতিমারি নয়। আরও সঙ্কট আছে। দুর্গাপুজো ঘিরে চার দিনের উৎসব এখন দীর্ঘায়িত হয়ে নয়-দশ দিনের— তার উপর থিম পুজোর নামে ইদানীং প্যান্ডেল আর প্রতিমার অভিনবত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতার শেষ নেই। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা ও টিভি চ্যানেলগুলোর ঘোষিত নানা শিরোপা আর পুরস্কার এই প্রতিযোগিতাকে প্রায় লড়াইয়ের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মিশরের পিরামিড, আইফেল টাওয়ার বা ভারতের নানা প্রান্তের মন্দির-গির্জার আদলে তৈরি হচ্ছে চোখ-ধাঁধানো অভিনব মণ্ডপ। কিন্তু বহু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা এবং গণপরিসর, প্যান্ডেল ও দর্শনার্থীদের দখলে চলে যাওয়ায় পুজোর দিনগুলোতে সাধারণ মানুষের চলাচল কঠিন। বিশেষত অসুস্থ মানুষ, মুমূর্ষু রোগী, জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বেরোনো মানুষ এই দীর্ঘ উৎসবের দিনগুলোয় খুবই অসহায় হয়ে পড়েন।
এর উপর আছে চাঁদার জুলুম। সরকার পুজো-পিছু পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দিলেও বহু এলাকায় ফি-বছর চাঁদার হার বাড়ে বই কমে না। সরকারের পক্ষ থেকে এই জুলুমের বিরুদ্ধে যতই অভয় দেওয়া হোক না কেন, বেশির ভাগ পুজো কমিটির মাথায় রাজনৈতিক নেতারা অধিষ্ঠান করেন বলে নিরীহ নাগরিক থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও চাঁদা দিতে অপারগতার কারণে অত্যাচারিত হয়েও সচরাচর নালিশ জানাতে সাহস করেন না। পথেঘাটে পণ্যবাহী গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায়ও এক পুরনো রোগ। ফলে পুজোর কিছু দিন আগে থেকে ভিন্রাজ্যের পণ্যবাহী গাড়ি আসা কমে যায় এ রাজ্যে। তার ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য হয়ে পড়ে।
পুজোর সময়ে মাইক বাজবে না, তা কখনও হয়? দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে হাই কোর্ট বারংবার মাইকের শব্দপ্রাবল্যের সীমা, মাইক বাজানোর সময়সীমা বেঁধে দিলেও পুজোর দিনগুলোতে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তারস্বরে মাইকের উপদ্রব চলতেই থাকে। বাড়িতে থাকা গুরুতর অসুস্থ রোগী বা সদ্যোজাত শিশুটিও সেই নিরন্তর শব্দশেল থেকে রেহাই পায় না। আর বিসর্জন তো এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। বক্সের উপর বক্স সাজিয়ে, ডিজে-র নামে শব্দাসুরের তাণ্ডবে কান ও প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও সেই উদ্দাম নেশাড়ুদের বিরত করে, সাধ্য কার?
বাজি নিয়ে আর এক সমস্যা। রাজ্য জুড়ে শব্দবাজির উপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পুজোর দিনগুলোয় তা বন্ধ হয় না। প্রশাসনের সব নজরদারি তুচ্ছ করে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া নিষিদ্ধ শব্দবাজির দাপটে কানের পর্দা ফাটলেও প্রতিকার মেলে না। সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে শব্দবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ যে একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু তার পরিণাম হয়েছে ভয়াবহ। ২০১০ সালে হালিশহরের পূর্ব কবিরাজপাড়ার সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধা বকুল অধিকারী, ২০১৩ সালে অশোকনগরের বছর চল্লিশের পিন্টু বিশ্বাস বাড়ির সামনে চকলেট বোমা ফাটানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে যূথবদ্ধ দুষ্কৃতীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্রতি বছর পুজোর সময় শব্দতাণ্ডবের বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিবাদ ও তার জেরে হেনস্থা ও দুর্ভোগের খবর প্রচারমাধ্যমে বাঁধাধরা। সরকারি নিষেধাজ্ঞা এখন কঠিন হয়েছে, বেড়েছে প্রশাসনিক নজরদারিও। তবু অস্বীকার করে লাভ নেই, আজও শব্দাসুরের তাণ্ডব কমেনি।
দুর্গোৎসবের কথা উঠলেই আজও ছেলেবেলায় দেখা গ্রামের দুর্গাপুজোর কথা মনে পড়ে। একটা গ্রামে একটাই পুজো। গ্রামের মানুষের ঝাড়ের বাঁশ, ধার করা ত্রিপল, চেয়েচিন্তে আনা শাড়ি-ধুতি দিয়ে বানানো বিচিত্র প্যান্ডেলে আড়ম্বরহীন একচালা প্রতিমা, নিতান্ত আটপৌরে সাজের। পুজোর ঠিক আগের অমাবস্যার রাতে রাশি রাশি কলার কাঁদি মাটির নীচে রাখা হত। গ্রামের মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের গাছের বাতাবি লেবু, নারকেল, খেতের আখ দিতেন। পাড়াতুতো কাকিমা-জেঠিমারা বানাতেন মুড়কি, নারকেল নাড়ু, ক্ষীরপুলি-সহ নানা মিষ্টি। ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে গ্রামের প্রতিটি পরিবারের স্পর্শ থাকত দুর্গাপুজোয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে আনা চাল-ডাল, আনাজ দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি আর লাবড়া অষ্টমী এবং নবমীর দুপুরে খেতে বসে পড়তেন গ্রামের সবাই। বাদ্যি বলতে কেবল ঢাক আর কাঁসি, তাও বাজানো হত শুধু পুজো আর সন্ধ্যারতির সময়।
জানি, পারস্পরিক সম্পর্করহিত আজকের শহুরে জীবনে সেই সহজ-সরল দুর্গোৎসবের আমেজ ফিরে পাওয়া আর সম্ভব নয়। কিন্তু সহনাগরিকদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে রাস্তা ছেড়ে পরিসর অনুযায়ী প্যান্ডেল তৈরি, শব্দবাজি বর্জন, প্রতিমার সাজ বা পুজোর আড়ম্বরে কিঞ্চিৎ কাটছাঁট করে চাঁদার জুলুম বন্ধ করা— এগুলো কি একেবারেই অসম্ভব? সেরার শিরোপা না-ই বা জুটল, আতঙ্ক দূর করে উৎসবের দিনগুলো সকলের জন্যে আনন্দময় করে তোলাটাই তো আসল কৃতিত্ব!