প্রতীকী ছবি।
ভাল আমরা কেন বাসি? পিতামাতার দেশ, না দেখা সেই ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে থাকা ক্লাবের নামকে ভালবাসা। পরাজয়ে হাহাকার। বুকে যেন রাবণের চিতা জ্বলে।
বেশ কয়েক বছর আগে বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সাত গোলে পরাজয়ের পর এক সহকর্মীকে ফোন করে বোঝাতে হয়েছিল দীর্ঘ ক্ষণ, এতটাই বিষাদাচ্ছন্ন ছিল সে। একেবারে বাক্রুদ্ধ। কেমন সেই অপমানের জ্বালা, যেখানে শুধুই নিঃশর্ত ভালবাসা থাকে। খেলা দেখে প্রেমে পড়া। একটা নাম, একটা চরিত্র, একটা দলকে ভালবাসা। তার পরাজয়ে যেন জগৎসংসার ধসে গেল। তবু ‘হায় এ কী, সমাপন’ জেনেও ‘ ছাড়িব না, ছাড়িব না, ছাড়িব না’।
বহু দিন পর্যন্ত দুঃখ বলতে বুঝেছিলাম, সাত সেকেন্ডে মোহনবাগানের আকবরের গোলের পর বা শ্যাম থাপার ব্যাকভলি জালে জড়ানোর পর কান্না। আকুল হাহাকার। সুখ বলতে কপিল দেবের ৪০০ উইকেট পাওয়ার মুহূর্তে কান্না।
এ ভালবাসা হালের জাতীয়তাবাদী প্রেম নয়, যাতে দল হেরে গেলে খেলোয়াড়ের বাড়িতে ঢিল পড়ে, আগুন জ্বলে, খেলোয়াড়ের স্ত্রী, বান্ধবী-সহ পরিবারকে অভিসম্পাত দেওয়া হয়, শিশুকন্যাকে দেওয়া হয় ধর্ষণের হুমকি।
অবশ্য মনে পড়ল, ইডেনে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে কপিল দেবের হঠকারী শটের পর ভারতের হেরে যাওয়া, আর তার পর অনেক কষ্টে জোগাড় করা কপিলের পোস্টার পেন দিয়ে খচখচ করে কেটে দেওয়া। নায়কের উপর অন্ধ রাগেই কি গোপন বীজ ছিল, যা যুগে যুগে পরিণত হল এই ক্ষণে-ভক্তি, ক্ষণে-ক্রোধের হুজুগে!
মনে পড়ে, এলপিতে শোনা ভানুসিংহের পদাবলী-তে গৌরী ঘোষ বলছেন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমরা যাহাকে ভালবাসি, কেবল তাহারই মধ্যে আমরা অনন্তের পরিচয় পাই। এমনকী, জীবের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করার অন্য নামই ভালবাসা।”
কয়েক দশক আগে এক প্রখ্যাত কলমচি ঘনিষ্ঠমহলে বলেছিলেন, সদ্য বুকারজয়ী এক লেখিকার সঙ্গে তাঁর প্রেম ১০০ শতাংশ হয়ে গিয়েছে। কলমচি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, অনেকেই মনে করলেন হতেই পারে কিছুমিছু। তা কলমচি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আমার দিক থেকে তো ১০০ শতাংশ। ওঁর তো শূন্য!
এই ‘ভার্চুয়াল’ ভালবাসায় প্রাপ্তি কী? মানুষের প্রতি ভার্চুয়াল ভালবাসায় কামগন্ধ নাহি তায়, বলা যাবে না ঠিকই, কিন্তু প্রাপ্তিই বা কী? ভালবাসতে পারার আনন্দ এবং অনন্ত বিরহে থাকার শান্তি। শোনা যায়, ‘নীলাঙ্গুরীয়’র লেখক পাড়ায় এক জনকে ভালবাসতেন। দেখতেন তাঁর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা। তাঁর অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়, সারা জীবন বিয়ে করেননি লেখকও। মনে পড়ছে বুদ্ধদেব বসুর লেখা, মেঘ সন্ধ্যায় জানলার কবাট বন্ধ করল দু’টি হাত, সাদা, রুলি পরা। “আবার দু-চোখ ভ’রে ঘুম জ’মে এলো,/ সকল পৃথিবী অন্ধকার;/ এই কথা না-জেনেই মৃত্যু হবে মোর/ হাতখানা কার।/ এসেছি নিজের ঘরে, বৃষ্টিও এসেছে,/ হাওয়ার চিৎকার যায় শোনা;/ যার হাত, কাল তার মুখে দেখি যদি,/ আমি চিনিবো না।/ বিছানায় শুয়ে আছি, ঘুম হারায়েছে,/ না জানি কখন কত রাত; কখনো সে হাত যদি ছুঁই, জানিবো না,/ এ-ই সেই হাত।”
এই চিরবিরহ, পেয়েও অপ্রাপ্তি বা চির অপেক্ষাও থাকে না সেই মানুষগুলোর জন্য, যাঁরা লেখায়, পর্দায়, খেলার মাঠে আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখেন।
আচ্ছন্ন শব্দটার মধ্যেই ফ্যান্টাসি আছে, বন্য মুগ্ধতা আছে, আর তাঁর সঙ্গে একাত্ম বোধ করা আছে। একাত্মতা সেই সময়ের সঙ্গে। যে চিত্রতারকাকে হয়তো তেমন পছন্দই করতাম না, কিন্তু মারা গেলে মনে হয়, আমাদের সময়ের একটা অংশ চলে গেল। আমাদের সময়, জীবনযাপন, সব কিছুর সঙ্গেই তো তাঁর যোগ। বিদেশি বিখ্যাত পত্রপত্রিকায় ‘ওবিচুয়ারি’তে তাই ধরা হয় সেই সময়টাকে। যা মানুষটাকে তৈরি করেছে, আর এক সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছে আরও প্রজন্মকে।
আর ক্লাব? যে ভূখণ্ড দেখিইনি কোনও দিন, শুধু শুনেছি পরিবারের কাছে, যা আমাদের অনেকের কাছেই শ্রুতি-ইতিহাস, তার জন্য কেন এত চোখে জল আসা, এত হাহাকার? ব্যবহারিক জীবনে যিনি বেশ কঠোর, বয়স বেড়ে সেই মানুষটিই কেন আকুল হয়ে কাঁদেন আর বলেন, ক্লাব তো নেই, সে তো
শুধু রয়েছে আমাদের মনে। তাঁর তো ফেলে আসা দেশ আর উদ্বাস্তু জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক ক্লাব, কিন্তু তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কী অতল প্রেম, যারা বোঝেইনি সরাসরি দেশভাগের ব্যথা? তারা কেন উদ্বেল একটা ক্লাবের প্রতি ভালবাসায়।
শুধু সেই ক্লাবই বা কেন? এক-একটা রঙের জার্সি পরা ১১ জনের টিম যখন টানেল দিয়ে মাঠে ঢোকে, গ্যালারি জুড়ে সেই চিৎকার রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দেয়, বুক ভেঙে কান্না আসে। যে ছেলেটি স্টেডিয়ামে ঢোকার আগে পর্যন্ত অকথ্য গালিগালাজ দিয়ে এসেছে প্রতিপক্ষকে, তার সঙ্গে মিল পাই মতি নন্দীর স্টপার-এর সেই ছেলেটির, যে বলেছিল, “কমলদা আমি কিন্তু ওদের একটাকে মাঠ থেকে নিয়ে বেরোব।” উদ্বাস্তু পরিবারের আধপেটা খেয়ে থাকা সেই ছেলে।
সেই জন্যই তো ভালবাসি। ছোটবেলা, আমাদের সময়, আমাদের ইতিহাস, আমাদের পাওয়া, না-পাওয়া, জয়ে জয়ী হওয়া, পরাজয়ে পরাজিত হওয়ার বোধই কি ভালবাসা? যা রক্তাক্ত করে কিন্তু ছাড়তে শেখায় না।
রাজেশ্বরী দত্ত গেয়ে চলেন, ‘এখনও তো ভালবাসি’...