কোভিডকে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। তবে নতুন বছর আসুক বৈষম্য ঘোঁচানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
দুঃস্বপ্নের শেষ! নাকি নতুন ভোর? ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ শুরু হয়েছিল এক কালো সময়ের। লক ডাউন। তার পর থেকে বিশ্বব্যাপী বিভীষিকার দৌড় চলছে অক্লান্ত ভাবে। তবে এটাও ঠিক, ২০২২ এর শেষ দিনে যখন পিছন ফিরে দেখছি, তখন মনে হচ্ছে হয়ত এই বিভীষিকার দৌড় থামার পথে।
থামল কিনা তা বলবে ২০২৩ এর ৩১ ডিসেম্বর। তবে আশঙ্কার মেঘ কিন্তু আশার আলোকে স্তিমিতই করে রেখেছে। উল্টো দিকে এটাও ঠিক যে, ২০২২ অবশ্যই ২০২১-এর থেকে ভাল কেটেছে। কিছুটা নতুন করে পাওয়ার স্বপ্ন, শুধুই হারানোর পালা শেষ করে পাওনার ঘরেও কিছু কুড়িয়ে রাখা, আবার একই সঙ্গে আগের থেকে কিছুটা হালকা হলেও সেই পুরনো কোভিডের ছোবল ঘিরে আতঙ্ক— ২০২২-এর মূল সুর কিন্তু ছিল এটাই।
আজ ৩১ ডিসেম্বরেও কোভিডের আতঙ্ক ঠিক একই ভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে। চিন সীমান্ত খুলে দিয়েছে। এখন ভয় আবার কোভিড আমাদের জীবনে ‘পজ়’ বোতামটা আবার কবে টিপবে। কোভিড আবার ছড়াবে তা নিয়ে নাকি সংশয় নেই। চিন ছাড়াও জাপান ও কোরিয়া ইতিমধ্যেই কাতর কোভিডের নতুন সংক্রমণে। অন্য দেশেও ছড়াতে আর বেশি দেরি নেই। আর কোভিডের এই নতুন ধরনটি নাকি একজন থেকে সরাসরি একাধিক মানুষের উপর আছড়ে পড়ে। তবে আশার কথা একটাই। ওমিক্রনের থেকেও এর অভিঘাত কম। তাই এর প্রকোপে বাজার কতটা অসুস্থ হয়ে পড়ব তা এখনই বলা মুশকিল।
তবে কোভিডের এই নতুন ধরনে আক্রান্ত মানুষ তুলনামূলক ভাবে কম অসুস্থ হলেও, অসুস্থ তো হবেই। আর তাতে আবার কিন্তু বাজারের উপর প্রভাব পড়বে। ২০২২-এ পা দিয়ে ভারত-সহ বিশ্বের সব দেশের নীতি নির্ধারকদের কাছেই চ্যালেঞ্জ ছিল উৎপাদন ব্যবস্থাকে চাগিয়ে বাজারকে চনমনে করে তোলা। কিন্তু ওমিক্রন সঙ্গে নিয়ে ২০১৯ থেকে বন্ধ হয়ে থাকা বিশ্ববাজারের ক্ষতি মিটিয়ে নতুন করে শুরু করাটা খুব সহজ কাজ ছিল না।
আর অসুস্থ বিশ্ব অর্থনীতির প্রকাশ ছিল মূল্যবৃদ্ধি। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া। ইউক্রেন থেকে খাদ্যশষ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল। রাশিয়া থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য কেনার উপর বিশ্ববাজারে শাস্তিমূলক বিধিনিষেধ জারি হওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল।
ভারতে শীর্ষব্যাঙ্কের কাছে মূল্যবৃদ্ধিকে বাগে আনা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এপ্রিল মাসে খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার গত আট বছরের মধ্যে রেকর্ড। ৭.৭৯ শতাংশ। গ্রামের বাজারেও হাল একই। বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭। আর তাই নিয়ে রাজনৈতিক আকচাআকচি। সরকারের দাবি সূচকের হিসাব ভুল। কিন্তু এটাও ঠিক যে কোভিডের জন্য দীর্ঘকাল বাজার বন্ধ থাকায় দেশে আর্থিক বৈষম্য বেড়েছে বই কমেনি।
পাশাপাশি, এটাও ঠিক যে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভারতের অর্থনীতি অনেক তাড়াতাড়ি তার নিজের জমি খুঁজে পেয়েছে। তার অবশ্য অন্যতম কারণ ভারতের নিজের বাজারের পরিসরই এত বড় যে বাঁচার জমি খুঁজতে খুব বেশি বাইরের জমি খুঁজতে হয়নি ভারতের অর্থনীতিকে। কিন্তু বৈষম্যের লাঘব যে কতটা হয়েছে তা মাপার জন্য কোনও সঠিক সরকারি তথ্য আগের মতো পাওয়া বহু দিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই পারিপার্শ্বিক তথ্য, যেমন কাজের বাজারের অস্থির পরিস্থিতি ইত্যাদি, থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ভারতে বৈষম্য কমার রাস্তায় এখনও হাঁটা তো শুরু করেইনি, উল্টে আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে।
তবে সঞ্চয়কারীদের জন্য সুসংবাদ। শীর্ষব্যাঙ্ক মূল্যবৃদ্ধিকে বাগে আনতে গিয়ে যে ভাবে সুদের হার ক্রমাগত বাড়িয়ে চলতে বাধ্য হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের পক্ষে যেমন ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়েছে ঠিক তেমনই আবার সুদ বাবদ আয়ের পরিমাণও এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়েছে।
মাথায় রাখতে হবে যে বিশ্বজুড়ে আর্থিক বাজার কিন্তু অনিশ্চয়তায় দুলছে। সবারই মনে কী হয় কী হয় ভাব। কেউ কেউ বলছেন, বলছেন শুধু কোভিডের নতুন ঢেউ নয়, বিশ্ব আর্থিক বাজারের অনিশ্চয়তার মূল্য ভারতকেও চোকাতে হবে। চিন-তাইওয়ান, রাশিয়া-ইউক্রেন, সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া— যে দিকেই তাকানো যায় চারিদিকেই কেমন একটা সাজো সাজো রব। আর তাই আর্থিক বিশেষজ্ঞরাও চিন্তিত বাজার কী ভাবে এই বিরোধকে পড়বে এবং তার প্রতিক্রিয়া কী হবে।
দেশের বাজারও বিরোধ নিয়ে নির্লিপ্ত নয়। আজকের দুনিয়া কিন্তু উন্নয়ন খোঁজে গবেষণা এবং উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে। ভারত নিজেকে আর্থিক ভাবে অন্যতম শক্তিধর দেশ হিসাবে দেখতে চাইছে। কিন্তু যে ভাবে গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারি অনুদানে রাশ পড়ছে এবং উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ কমছে তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তদুপরি জাতপাতের ভিত্তিতে দেশের ভিতর বিভাজন বাড়ছে বলে মনে করছে অনেকেই। এর একটা প্রভাব কিন্তু আর্থিক উন্নয়নের উপর পড়বেই। অনেকেই বলছেন, ভারত যতটা আর্থিক বৃদ্ধির উপর নজর দিচ্ছে ঠিক ততটাই নজর সরিয়ে নিয়েছে উন্নয়ন থেকে।
আর্থিক বৃদ্ধি উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। কিন্তু বৃদ্ধি হলেই যে উন্নয়ন হবে তার কিন্তু কোনও মানে নেই। উন্নয়ন এক কথায় বৃদ্ধির সুফল সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। পণ্যের উপর অধিকার অনেক বেশি সর্বজনীন করে তোলায়। এখন এ ব্যাপারে অনেকেই চিনের উদাহরণ দিতে শুরু করেছেন। চিন বিশ্বের অন্যতম আর্থিক শক্তিধর দেশ। কিন্তু কোভিড নাকি প্রমাণ করে দিয়েছে যে সে দেশের মানুষের কাছে চিকিৎসার অধিকারেই কত বৈষম্য। তাই দেশের উন্নতি হলেই যে দশের উন্নতি হবে তার কিন্তু কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর এখানেই আসে শিক্ষার সুযোগের প্রসঙ্গ। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মতো সামাজিক পরিকাঠামোর প্রসঙ্গ। অথবা গণ-পরিবহণ পরিকাঠামোর বিস্তার যা কাজের সুযোগ নিতে এবং ছড়াতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু পরিকাঠামোর বিস্তার এমনই হচ্ছে যে অনেকেই মনে করছেন তাতে সাধারণ নাগরিকের সহজে ব্যবহারের সুযোগ থাকছে না দামের কারণেই।
তবে হ্যাঁ। ভারত যে কোভিড উত্তর দুনিয়ায় বৃদ্ধির দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে অন্যদের থেকে তা নিয়ে সংশয়ের সম্ভবত কোনও জায়গা নেই। আর কিছু দিনের মধ্যেই এসে যাচ্ছে আপনার মুঠো ফোন ভর্তি ই-টাকা। ম্যানি ব্যাগকে অপ্রয়োজনীয় বানিয়ে। দাবি, প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হবে টাকার সরবরাহে ভৌগোলিক দুরত্বের বাধা কাটিয়ে। কিন্তু সমস্যা সেই একই জায়গায়। যে ফোন কিনলে এই সুযোগ পাওয়া যাবে সেই টাকা কত জনের কাছে আছে? মাথায় রাখতে হবে সরকারি হিসাবেই মাসে ৬৬ হাজার টাকা আয়ে একটি পরিবার আর্থিক ভাবে দুর্বল বলে মেনে নেওয়া হয়। আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে অনেকেই ৩০ হাজার টাকা মাইনের চাকরি পেলে কিন্তু বর্তে যান! এও যদি বৈষম্যের ছবি ও প্রমাণ না হয় তা হলে বৈষম্যের পরোক্ষ প্রমাণ হিসাবে আর কী চাওয়া হবে?
কোভিডকে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। তবে নতুন বছর আসুক বৈষম্য ঘোঁচানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে।