কিছু দিন আগের কথা। এই দফায় রাজ্যে লোকাল ট্রেন বন্ধ হয়েছে তখন দু’তিন দিন হল। সকালবেলায় ফেরিওয়ালার হাঁকে নতুনত্ব কানে এল। আনাজপত্র, মাছ ইত্যাদি হয় হেঁটে, নয় ভ্যানে চাপিয়ে ফেরি করার রেওয়াজ এ পাড়ায় অনেক দিনের। কিন্তু ঝাঁকা নিয়ে হেঁকে হেঁকে ডিম বিক্রি করতে আগে সে ভাবে দেখিনি। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ভদ্রলোক ট্রেনে হকারি করতেন। ট্রেন বন্ধ বলে ডিম নিয়ে বেরিয়েছেন।
ট্রেন বন্ধ এবং তার পরে কার্যত লকডাউন পরিস্থিতিতে চেনা ফেরিওয়ালাদের অনেককেই দেখতে পাই না। বেশির ভাগই ট্রেনের যাত্রী ছিলেন। তাঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া যদি একটা বড় বাস্তবতা হয়, কিছু সংখ্যক নতুন ফেরিওয়ালা তৈরি হয়ে যাওয়া তার উল্টো পিঠ।
মোড়ের মাথায় ফুচকাবিক্রেতা বলে যাঁকে চিনতাম, লকডাউনে গত বার তাঁকেই দেখেছি বাজারের পাশে মাস্কের ডালি নিয়ে বসতে। খালের ধারে আনাজ সাজিয়ে রেখেছিলেন এক নতুন ‘মাসি’। বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করতেন। নিজেই বললেন, “লোকে কাজে নিচ্ছে না গো দিদি। কী করব বলো? বরবটি নেবে? ভাল বরবটি ছিল!”
লকডাউন বৃত্তান্তে কর্মহীনতার পাশাপাশি পেশা পরিবর্তনেরও এমনই এক বৃহৎ মানচিত্র রচিত হয়ে চলেছে আমাদের চার পাশে। রঙের মিস্ত্রির সহযোগী হয়ে কাজ শিখতে শুরু করেছিল যে যুবক, সে শুনতে পাই খাবারের ডেলিভারি বয়ের কাজ নিয়েছে। এ সমস্ত বদলের কতটা সাময়িক, কতটা স্থায়ী পরিবর্তন, বোঝার সময় আসেনি এখনও। দোলের আগের দিন রং, কালীপুজোর আগের দিন পটকা, দুর্গাপুজোর সময় রোলের দোকান দেওয়ার যে চল, এ তার চেয়ে আলাদা। উৎসবের মরসুমে বাড়তি রোজগারের চেষ্টা নয়, বরং বিপদের মুখে চটজলদি বিকল্পের খোঁজ। নিম্নবিত্ত মানুষের পেটে যে লাথি মেরেছে কোভিড, তার মূল্যায়নে শুধুই নির্বিকল্প ‘অসহায়তা’র আখ্যান বিবৃত করে গেলে কোথাও হয়তো বা খাটো হয়ে যায় এই প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। আর তার চেয়েও বেশি করে, অধরা থেকে যায় অনেকগুলো পরত— জীবনযুদ্ধের, বৈষম্যেরও। বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই জীবনধারণ খানিকটা বেশি করেই কঠিন হয়ে উঠছিল এ দেশের বৃহদংশের মানুষের কাছে। অতিমারি এসে তার বাকি ছালচামড়াটুকুও খসিয়ে দিয়েছে।
বস্তুত, সেই নোটবন্দির সময় থেকে ভারতের অর্থনীতি যে রামধাক্কা খেয়েছে, সেটা এক রকম সকলেরই জানা। সেনসেক্স-এর চশমা দিয়ে দেশের হাল বোঝার অভ্যাস না থাকলে এ বাস্তবতা নজর এড়ানোর কথা নয়। কোভিডের আক্রমণের আগেই যে ভারতে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল, সে তথ্যও সবার চোখের সামনে আছে। নোটবন্দির অভিজ্ঞতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, এই ধরনের ঘটনার অভিঘাত হয় দীর্ঘমেয়াদি। চটজলদি অনেক কিছুই বোঝা যায় না, ধরাও পড়ে না। সেই কাটা ঘায়ের উপরেই নিক্ষিপ্ত হয়েছে কোভিড-লকডাউন এবং নানা কড়াকড়ি। স্বাভাবিক জনজীবন ধ্বস্ত। দেশ জুড়ে মৃত্যুমিছিল। জিডিপি সঙ্কোচনে রেকর্ড। খোদ সরকার বাহাদুরই অতিমারির দিনগুলিতে ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। অতএব ১৩০ কোটির দেশে ৮০ কোটিই যে বর্তমানে দুর্গত, সেটা এক রকম মানছেন ওঁরাও।
এই সূত্র ধরেই আবার এক গৃহপরিচারিকার বয়ানে ফিরি। ক্যানিং থেকে রোজ ট্রেনে আসতেন দক্ষিণ কলকাতায় কাজ করতে। গত বছর লকডাউনে টানা ট্রেন বন্ধ থাকল। তিনি আটকে গেলেন। মাস আড়াই পার করে কোনও রকমে ভ্যান ভাড়া করে চলে এলেন কলকাতায় বোনের বাড়ি। সেখানে থেকে কাজ করবেন। কোথায় কাজ? একাধিক কাজ গায়েব। স্থানীয়দের হাতে চলে গিয়েছে সে সব। আবাসনের কেয়ারটেকারের স্ত্রী আগে ঠিকা কাজ করতেন না। শূন্যস্থান দেখে তিনিও হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। তবে বেশি দিন বসে থাকতে হল না ক্যানিং-বাসিনীকেও। শিয়ালদহ দক্ষিণ লাইন থেকে যত জন আসেন রোজ কলকাতায়, তার মধ্যে কত জনেরই বা কলকাতায় বোনের বাড়ি থেকে যাওয়ার সুযোগ আছে? অতএব পড়ে থাকা কিছু কাজ জুটেই যায়। অন্য কোনও ‘লক্ষ্মী’ (কান্তপুর) বা ‘ডায়মন্ড’ (হারবার)-এর নিত্যযাত্রিণীর ফেলে যাওয়া কাজে তিনি বহাল হয়ে যান। স্বামী-ছেলে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। তাঁদের রোজগার বন্ধ। যে বোনের কাছে থাকেন, তাঁর স্বামী অটোচালক। তিনিও বাড়িতে বসা। মহিলারাই বহু সংসারে হয়ে উঠেছেন একমাত্র রোজগেরে!
ক্যানিংয়ের বাড়িতে টাকা পাঠাবেন কী করে, ভেবে অস্থির হয়ে ওঠেন দিদি। এর ওর হাত দিয়ে, কখনও বা আবারও ভ্যান-অটো ভাড়া করে পৌঁছে দেন সেই রোজগার। গণপরিবহণ বন্ধ থাকলে কত রকম ভাবে যাতায়াতের রাস্তা বার হয়, উচ্চ/মধ্যবিত্ত মগজ তা সহজে ভেবে উঠতে পারবে না। ২৪ ঘণ্টা পাশে থেকে এক বৃদ্ধার পরিচর্যার কাজ করেন যে মহিলা, তাঁর বনগাঁ লাইনে বাড়ি। এ বার ঝড়ের আগে বাড়ি যেতে চাইলেন। কী ভাবে যাবেন? গাড়িঘোড়ার ব্যবস্থা কী হবে? পলকে উপায় বার করে ফেললেন নিজ দায়িত্বে। বাজারে এক মাছবিক্রেতাকে চেনেন। তাঁরই এলাকার বাসিন্দা। বাজার গুটিয়ে তিনি যখন ফিরবেন, তিনি চলে যাবেন তাঁর সঙ্গে!
অতিমারি-লকডাউন জর্জরিত সময়ে কত মানুষ কর্মহীন, কত মানুষ আর্থিক ভাবে দুর্বলতর হয়ে পড়েছেন, তা নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি হবে। কারণ পূর্ণাঙ্গ ছবিটি এখনও অনেকাংশেই স্পষ্ট নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই কিছু টুকরো আলেখ্য এখানে সাজিয়ে দেওয়া গেল, যা এতই আটপৌরে যে আলাদা করে চোখে পড়তে চায় না। অথচ, এই সব আপাত-তুচ্ছ খুঁটিনাটির মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে জীবনের আহ্নিক গতি। মেহনতি মানুষের সংগ্রাম নিয়ে কেতাবি দুনিয়ার আন্তরিকতা যতই অকৃত্রিম হোক না কেন, তা অতিসরলতায় আক্রান্ত হতে বাধ্য, যত ক্ষণ না সেই জীবনকে তার পূর্ণতায় দেখা হচ্ছে। নচেৎ মানুষ, মেহনত এবং সংগ্রাম সবই বিমূর্ত ধারণায় পর্যবসিত হয়। কী ভাবে, কত ভাবে নিচুতলার অর্থনীতি নিজেকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়, তার হদিস ছাড়া অসম্পূর্ণই থেকে যায় জনমনের পাঠ। মানুষকে তার সামগ্রিকতায় বিচার না করে শুধু ‘হ্যাভ নট’-এর খাতায় ঠেলে দিলে তাকে বোঝাও যায় না, সম্মানও করা যায় না।
কত সময়ে তো খেয়ালই থাকে না, উচ্চাকাঙ্ক্ষা উচ্চবিত্তের একচেটিয়া নয়। সেই কারণেই পরিযায়ী শ্রমিকের আখ্যানকে কেবলমাত্র পেটের টানের বাধ্যবাধকতা হিসেবে দেখলেই চলে না সব সময়। অধিক রোজগারের সন্ধান এবং হিসেব করে কর্মস্থল নির্বাচন শুধু কর্পোরেট জগতের অভ্যাস নয়, এ কথাটা মনে না রাখলে জনজীবনের একটা বড় অংশ কী ভাবে পেশাগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তার গড়নটাই অনেকাংশে বোঝা যায় না। আকাঙ্ক্ষা আর সঙ্গতির টানাপড়েনের শ্রেণিচরিত্র এবং তার বিভিন্নতাকে ধরা যায় না।
কোভিড-পূর্ব ভারতে ট্রেনে ফটাস জল বিক্রি করা বাবা ছেলের আবদার মেটাতে ধারকর্জ করে মোটরবাইক জুগিয়েছেন। পছন্দের মোবাইল ফোন পায়নি বলে অভিমান করে আত্মঘাতী হয়েছে কিশোর-কিশোরী। আর, আজ মোবাইল হাতে পাওয়া না-পাওয়ার উপরে, তাতে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ থাকা না থাকার উপরে একটা গোটা প্রজন্মের পড়ুয়ার ভাগ্য নির্ধারিত হতে চলেছে। এমন একটা সময়ে ঘটনাগুলো ঘটছে, যখন আর্থিক সংস্থানের খুঁটি যার যতটুকু ছিল, সেগুলো একেবারে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। এই ভয়ঙ্কর মন্দা মানুষকে কতখানি নিষ্পেষিত করেছে, সেটা বুঝতে চেষ্টা করার পাশাপাশি এই অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের দিনগুলি মানুষ ঠিক কী ভাবে যুঝছেন, সেই নিবিড় খোঁজও চালিয়ে যাওয়া দরকার।
সেই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, এই অতিমারি শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যকে লাগামছাড়া করে দেয়নি, তার পাশাপাশি অবাধে অর্গলমুক্ত করেছে যাবতীয় শ্রেণি-ঘৃণা আর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। আর্থসামাজিক জীবনে তার প্রভাবও সমান দীর্ঘমেয়াদি হতে বাধ্য। বর্তমান জমানায় এমনিতেই বিদ্বেষ-বিষ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছিল। দূরত্ববিধি আর শোধনপ্রক্রিয়ার বেশ ধরে স্বাস্থ্য-সতর্কতার বৈধ টিকিট তাকে নব্য অস্পৃশ্যতায় গড়েপিটে নিয়েছে। তবলিগি সমাবেশ আর কুম্ভের তুলনামূলক আলোচনা করেই ক্ষান্ত থাকলে নিজের চৌকাঠ অদেখা থেকে যাবে।
রিকশায় উঠতে গিয়ে দু’হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে টলমল করছিলাম। চালককে বললাম, এটা একটু ধরে দেবেন? সঙ্কুচিত দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, “ধরব? আগের দিন এক ভদ্রমহিলার টাকার ব্যাগ পড়ে গিয়েছিল। আমি তুলে দিতে গিয়েছিলাম বলে ধমকে উঠেছিলেন, তোমায় ছুঁতে কে বলেছে? সেই থেকে আর ধরি না।”
এই ‘সচেতনতা’ আবশ্যিক ছিল বুঝি?