তরুণ মজুমদার। ফাইল চিত্র।
‘‘দুঃখিত দুঃখিত। সামান্য একটু ফাঁক পেলেই বাঙালি নাকি অকারণ গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে ফেলে। তা, আমি কী করে ব্যতিক্রম হব?” এ কথা বলে সিনেমাপাড়া দিয়ে চাওয়া পাওয়া থেকে অধিকার অর্জনের পথে সুঠাম মতাদর্শের ঋজু পদক্ষেপ করে তরুণ ‘যাত্রিক’ হেঁটে চললেন সাবলীল ভাবে। বোঝাই গেল, আসলে এই বাঙালি ভদ্রলোক ‘অকারণ গাম্ভীর্যের মুখোশ’ পরতে অনিচ্ছুক এক ইন্টেলেকচুয়াল, যিনি জীবনের গভীর অনুভূতি ছুঁয়ে কাজ করলেও তাকে ‘ইন্টেলেকচুয়ালাইজ়’ করার পক্ষপাতী নন।
সেই তখনকার কথা, যখন একাধারে ‘স্টুডিয়ো সিস্টেম’ আর ‘স্টার সিস্টেম’ বাংলার চলচ্চিত্র জগতের বাণিজ্যিক সারথি। আসলে আমাদের উচ্চমধ্যবিত্ত, শহুরে, তথাকথিত প্রগতিশীল সিনেমাজগৎ শুরু থেকেই পাশ্চাত্য-ভাবনার রসে টইটম্বুর কদম্ব হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল। বিশেষ করে মূলত হলিউড ও কিছুটা ইটালীয় নিয়োরিয়ালিজ়ম বা জার্মান এক্সপ্রেশনিজ়ম কিংবা সোভিয়েট চলচ্চিত্রকারদের উপচে-পড়া প্রেরণা দিশা দেখাচ্ছিল বাংলার চিন্তাজগৎকে। এই সঙ্কর জাতির উপর ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের চাপিয়ে দেওয়া অসমাপ্ত, অব্যাপ্ত এবং ক্ষণস্থায়ী বঙ্গ-নবজাগরণের প্রভাবাবৃত আবহেও কেউ কেউ খাঁটি বাঙালির আত্মাকে খামচে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার ও লেখক তরুণ মজুমদার তাঁদেরই এক জন।
‘জনপ্রিয়’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করার রহস্য এখানেই লুকিয়ে আছে বোধ হয়। প্রায় ঊনষাট বছরের ছবি তৈরির সময়কালে একই সঙ্গে এতগুলি শিল্পনৈপুণ্য-সঞ্জাত, মননসমৃদ্ধ, আবেগঘন, বাণিজ্যসফল ও জনপ্রিয় ছবির স্রষ্টা বোধ হয় বড় একটা পাওয়া যায়নি এ বাংলায়।
বোধ করি তরুণবাবুর জীবনবোধ তৈরি হয়েছিল বাড়িতেই। স্বাধীনতা-সংগ্রামী বাবার মতাদর্শের উত্তরাধিকার নিশ্চয়ই তাঁকে স্বতন্ত্র করেছিল। তার সঙ্গে ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি পূরণ চাঁদ জোশী বা বন্ধু সুনীল মৈত্রের ভাবনার প্রভাব। আর সেই কারণেই রূপশ্রী পিকচার্স, শ্রীমতী পিকচার্স বা নিউ থিয়েটার্স-এর তথাকথিত ‘মেনস্ট্রিম’ ঘরানায় কাজ শুরু করেও তরুণবাবু দলবদ্ধতার দিকেই পা বাড়ালেন। দিলীপ মুখোপাধ্যায় ও শচীন মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে করে তৈরি হল ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠী। পরিচালক-ত্রয়ী হিসেবে চার-চারখানা বাণিজ্যসফল ছবি তৈরির এই দৃষ্টান্ত কিন্তু বিরল (‘অগ্রদূত’ ব্যতীত অন্য কোনও চলচ্চিত্রের গোষ্ঠী এ ভাবে কাজ করেছিলেন বলে শোনা যায় না)। মূল ঘরানার (চাওয়া পাওয়া, স্মৃতিটুকু থাক, কাঁচের স্বর্গ, পলাতক), সৃজনবোধসম্পন্ন ও হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া ছবি— তবু সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বানানো ছবিগুলিকে বাণিজ্যসফল করার মরিয়া চেষ্টা ছিল তাঁদের। এখানেই কুড়িয়ে নেওয়া গিয়েছিল একলা তরুেণর বাকি পথ চলার মাধুকরী।
সেই সময় এক দিকে উত্তম-সুচিত্রার ছবির রমরমা ব্যবসা ও জনপ্রিয়তা, অন্য দিকে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের মননের অপ্রতিরোধ্য প্রবাহ। তারই মধ্যে তরুণবাবু স্বতন্ত্র। মানুষটি গম্ভীর, নিয়মানুবর্তী ও সময়নিষ্ঠ। ভাবনা তাঁর যতই গভীর হোক না কেন— সারল্য তাঁর সৃষ্টির প্রাণভোমরা, এবং বৈচিত্র তাঁর বিষয়চয়নে। ঊনষাট বছর ধরে তরুণ মজুমদারের বিভিন্ন ছবিতে উঠে এসেছে বিভিন্ন উপজীব্য— কখনও প্রেম, কখনও পরিবার, কখনও সম্পর্ক, কখনও প্রান্তিক মানুষের জীবন, কখনও মধ্যবিত্তের পাওয়া না-পাওয়ার গল্প। এক দিকে বালিকা বধূ, নিমন্ত্রণ, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ফুলেশ্বরী থেকে একটুকু বাসা, দাদার কীর্তি, আপন আমার আপন, আবার অন্য দিকে ঠগিনী, পলাতক, সংসার সীমান্তে, গণদেবতা, পথ ও প্রাসাদ বা মেঘমুক্তি। এরই মধ্যে দর্শকের মনে দাগ কেটে যাচ্ছে কুহেলি-র মতো থ্রিলারধর্মী ছবি। আবার আধুনিক সময়ে তৈরি করছেন, ভালোবাসা ভালোবাসা, আলো, চাঁদের বাড়ি, ভালোবাসার বাড়ি কিংবা গণনাট্য সঙ্ঘ প্রযোজিত অধিকার।
তরুণবাবুর হাত ধরে উঠে আসছেন কত নবাগত শিল্পী, এবং তাঁদের অভিনয়ের শৈলী মুগ্ধ করছে দর্শককে। তাঁরা যথাসময়ে ‘স্টার’ হয়ে যাচ্ছেন তরুণবাবুর মতো এক শিক্ষকের হাত ধরে। দর্শকের ভারে উপচে পড়ছে ছবিঘর। রবীন্দ্রসঙ্গীতের গভীর অনুধাবনে ও বৌদ্ধিক প্রয়োগে জমে যাচ্ছে সিনেমার সিকোয়েন্স। কিন্তু সেই ‘স্টারডম’-এর বিচ্ছুরিত আলো ধাঁধিয়ে দিতে পারছে না তরুণবাবুর চোখ। সেই ‘সিম্পল লিভিং, হাই থিঙ্কিং’ বীক্ষা পাথেয় করে সুঠাম বাম মতাদর্শের নৌকায় ছই খাটিয়ে এগিয়ে চলেছেন এক আপাদমস্তক ভদ্রলোক বাঙালি।
তরুণবাবুর যৌবনে রাশিয়ান পরিচালক পুদোভকিনের সংবর্ধনা-সভায় অগ্রজপ্রতিম দেবকী বসুর সেই ‘সিনেমায় বাণিজ্য’ বিষয়ক সতর্কবার্তা কি জীবনকাল ধরে তাঁর কানে বেজে চলেছিল? সিনেমা বাণিজ্যের মুখ চেয়ে তৈরি হবে না, বাণিজ্য সিনেমার মুখ চেয়ে বসে থাকবে। এবং সেই পথেই হেঁটে সেলুলয়েড থেকে ডিজিটাল যুগেও কত বাণিজ্য-সফল ছবিই না করে গেলেন তরুণ মজুমদার!
কিন্তু শুধু তাঁর ছবিই নয়। মানুষটাই আসলে বিরল। মূল্যবোধ যখন অবক্ষয়ী ও সৃষ্টি যখন আপসের জরায় আক্রান্ত, তখনও তরুণবাবুর ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস’ অটল। শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে— এই কথাটাই তরুণবাবু বলে গেলেন জীবন দিয়ে। অগ্রজ বা অনুজদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার খতিয়ান কত যে শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে আপস করে চলার কথা শুনিনি কখনও। মনে পড়ে, গণশক্তি-র অফিসে আমার সঙ্গে এক স্বল্প সাক্ষাতে উচ্চারিত হয়েছিল সেই জীবনবোধ: “মানুষের ক্ষতি করে, এমন ছবি বানাবেন না— তা হলেই হল।” বিপর্যয়ের দিনে প্রাতঃস্মরণীয়ের এই উক্তিই আজও আমার অন্ধের যষ্টি।
তরুণবাবুর জীবন যেমন অনাড়ম্বর ছিল— বিদায়কালেও দেহদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল আড়ম্বর উপেক্ষা করেই। জীবন যখন উত্তীর্ণ হল শূন্যতায়— সেই মহাপ্রস্থানের পথেও শরীর ছুঁয়ে রইল একটি লাল পতাকা আর গীতাঞ্জলি। সে বড় দীর্ঘ যাওয়া। কিন্তু যাওয়ার আগেও এই বিরানব্বই বছরেও একটা ছবি করার ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর। হয়তো আরও কিছু কথা বলার ছিল। অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই ছবিটি আর করে যেতে পারলেন না। হাসপাতালেই অঙ্গীকার করেছিলেন— “এ বার সুস্থ হয়ে উঠে ছবিটা করে ফেলতেই হবে। ছবিটা করা ভীষণ জরুরি।” কোথা থেকে আসে এই প্রাণশক্তি? বোধ বয়সেই ছেলেবেলায় গড়ে ওঠা জীবনবোধ থেকে— মতাদর্শ থেকে!
মিশেল ফুকোর একটি উক্তি আজ খুব মনে পড়ছে। “আমার আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে, আমাদের সমাজে শিল্প বিষয়টা হয়ে উঠেছে কেমন বস্তু-কেন্দ্রিক— ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই, জীবনের সঙ্গে তো নেই-ই।”
তরুণ মজুমদার শিল্পকে ‘পণ্য’ না করে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছিলেন। আর সেখানটাতেই ছিল তাঁর উত্তরণ।