কর্নাটকের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে হিজাব পরে প্রবেশের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা সে রাজ্যে এক সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। কর্নাটক সরকারের এ সিদ্ধান্তটি ভারতীয় সংবিধানের ১৪, ১৯, ২১ এবং ২৫ নং অনুচ্ছেদের আলোকে এবং শিক্ষার অধিকার আইনের নিরিখে বিশ্লেষিত ও বিচার্য হওয়া প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে হওয়া একটি মামলার কথাও। কেরলের এক বিশেষ (জিহোবা) সম্প্রদায়ভুক্ত তিন ছাত্র স্কুলের প্রভাতী অ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে অস্বীকার করায় তাদের বরখাস্ত করা হয়েছিল। এই ছাত্রদের বক্তব্য ছিল, এই গান গাইলে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভাবাবেগে আঘাত লাগতে পারে। এই মর্মে ‘বিজয় ইমানুয়েল ও অন্যান্য বনাম কেরল রাজ্য ও অন্যান্য’ মামলাটিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ওচিন্নাপ্পা রেড্ডি এবং এম এম দত্ত সংবিধানের ৫১এ ধারা বিবেচনা করে ১৯৮৬ সালের অগস্ট মাসে রায় দেন যে, এই ছাত্রদের বরখাস্ত করার অর্থ তাদের বিবেকের স্বাধীনতা ও স্বাধীন ভাবে ধর্মাচরণের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা। আদালত বলে যে, আমাদের পরম্পরা সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়, আমাদের দর্শন সহিষ্ণুতার উপদেশ দেয়, আমাদের সংবিধান সহিষ্ণুতা অনুশীলন করে। একে লঘু করা উচিত নয়।
এ দিকে কর্নাটক সরকারের প্রকাশিত সাম্প্রতিক নির্দেশনামায় বলা হয়েছে, হিজাবের ব্যবহার যে হেতু মুসলিম সমাজে আবশ্যিক ধর্মীয় রীতি নয়, সে ক্ষেত্রে সরকার নির্দেশিত ইউনিফর্ম পরেই তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে হবে। এই নির্দেশ প্রকাশের পিছনে কর্নাটক রাজ্য সরকার বম্বে, মাদ্রাজ ও কেরল তিনটি হাই কোর্টের রায়কে হাতিয়ার করেছে। ২০০৩ সালের ‘ফতেমা হুসেন সইদ বনাম ভারত এডুকেশন সোসাইটি’ মামলায় জনৈক অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুলছাত্রী বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট পোশাকবিধি মানতে অস্বীকার করে বম্বে হাই কোর্টের শরণাপন্ন হয়েছিল, যেখানে হিজাব পরার উপর বিদ্যালয়ের তরফে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। মেয়েটি যে বিদ্যালয়ে পড়ত, সেটি ছিল পুরোপুরি বালিকা বিদ্যালয়— সেই যুক্তি দেখিয়ে বম্বে হাই কোর্ট কোরানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ উদ্ধৃত করে বলে, যেখানে শুধুমাত্র মেয়েরা রয়েছে, সেখানে অন্য মহিলাদের সামনে হিজাব পরে থাকতেই হবে, তাদের ধর্মগ্রন্থে কোথাও এমন কথা লেখা নেই। এবং স্কুলের এই সিদ্ধান্তের ফলে কোরানে উল্লিখিত কোনও নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হয়নি।
২০০৪-এ মাদ্রাজ হাই কোর্টে হওয়া ‘স্যর এম ভেঙ্কট সুব্বারাও, ম্যাট্রিকুলেশন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল স্টাফ অ্যাসোসেয়িশন বনাম স্যর এম ভেঙ্কট সুব্বারাও, ম্যাট্রিকুলেশন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল’ মামলায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা শিক্ষিকাদের উপর চালু হওয়া পোশাকবিধিকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। এই ধরনের নির্দেশ জারির পিছনে কোনও বিধিবদ্ধ বাধ্যবাধকতা নেই বলে স্বীকার করে নিলেও আদালত তার রায়-এ বলে যে, শিক্ষকদের শৃঙ্খলাপরায়ণ হওয়া ও ছাত্রছাত্রীদের সামনে নিজেদের রোল মডেল হিসাবে তুলে ধরাটাই বিধেয়।
২০১৮ সালে কেরল হাই কোর্টে হওয়া ‘ফাতিমা থাসনিম বনাম কেরল রাজ্য’ মামলায় জনৈক ব্যক্তি তাঁর ৮ ও ১২ বছর বয়সি দুই অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যার হয়ে হাই কোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। উক্ত পিতার বক্তব্য ছিল, তাঁর মেয়েরা পুরো হাতা জামা ও হিজাব পরলে বিদ্যালয়ের তরফ থেকে আপত্তি জানানো হয়। বিদ্যালয়ের বক্তব্য, এই পোশাক বিদ্যালয় নির্ধারিত পোশাকবিধির বিরোধী। যদিও কেরল হাই কোর্ট খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলের বক্তব্যকেই সমর্থন জানিয়ে বলে যে, বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত অধিকারের তুলনায় বিদ্যালয়ের সামগ্রিক অধিকারকেই প্রাধান্য দিতে হবে। বস্তুত, সংবিধান অনুসারে সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের দৈনন্দিনতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে।
কিন্তু, এই রায়গুলি বর্তমান পরিস্থিতিতে আদৌ কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে বির্তক রয়েছে। প্রথমত, সাম্প্রতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে হিজাব ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। এটি মোটেই কোনও বেসরকারি ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘটনা নয়, যারা নিজস্ব নিয়মে পরিচালিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, এই সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি শুধুমাত্র মহিলা পরিচালিত বা ছাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত, এমনও নয়। আবার, শিক্ষিকাদের শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে মাদ্রাজ হাই কোর্টের দেওয়া রায়ও এ ক্ষেত্রে তেমন খাটে না। সর্বোপরি, ভারতীয় সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদের নিরিখে আবেদনগুলির বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে শিক্ষিত মুসলিম মহিলারা যদি স্বেচ্ছায় মুখাবরণ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে উদ্যত না হন, তা হলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কি বলপূর্বক সেই ভূমিকা পালন করতে পারে? আমাদের সংবিধান তো তাকে সেই অধিকার প্রদান করেনি।