গ্রাফিক:- শৌভিক দেবনাথ।
প্রথম নিউ টাউনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাকে চাকরি ছাড়তে ‘বাধ্য’ করার খবর পড়তে পড়তেই পাঁচ বছর আগের কিছু স্মৃতি ফিরে এল। স্কুল থেকে আমাকেও প্রায় তাড়িয়েই দেওয়া হয়েছিল। কী আশ্চর্য সাযুজ্য দু’টি ঘটনার মধ্যে! ঘটনার থেকেও ঘটনাটি ঘটানোর পিছনের মনোবৃত্তি আমাকে ভাবায়। অজান্তেই মুখ থেকে একটি শব্দ বেরিয়ে আসে— আজও! মানে এখনও কোনও পরিবর্তন হয়নি। একটুও না! কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই! তিমির অবগুণ্ঠনে!
ঘটনাটা একটু বর্ণনা করি। তা হলে আনন্দবাজার অনলাইনের পাঠিক-পাঠিকাদের বুঝতে সুবিধা হবে কেন আমি কথাটা বলছি। সঙ্গে এ-ও জানিয়ে রাখি, যখন ঘটনাটা ঘটেছিল, তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিয়ো এবং নেটমাধ্যমে ঝড় তুলেছিল খবরটা। তার বিভিন্ন ইন্টারনেট লিঙ্ক এখনও পাওয়া যায়। কিন্তু এখন আর সেটা সকলের স্মৃতিতে না-থাকাই স্বাভাবিক। সকলেই খবরটা পড়েছিলেন, তা মনে করাও অন্যায়। তা-ই বিষয়টি এখানে বিস্তারিত জানানোই শ্রেয় মনে করি।
২০১৭ সাল। আমি অতীব অভিজাত স্কুলে পড়াতে ঢুকেছি। পদার্থবিদ্যা আর অঙ্ক পড়াই। দীর্ঘদিনই শিক্ষকতা করছি। তবে তার আগে কখনও ‘ইন্টারন্যাশনাল’ স্কুলে পড়াইনি। পড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম, তাদের পরিবেশ বেশ খানিকটা আলাদা। অনেক খোলামেলা। প্রায় বিদেশি আবহাওয়া। ‘ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম’ অনুযায়ী পড়ুয়াদের কোনও ইউনিফর্ম নেই। তারা যে পোশাকে স্বচ্ছন্দ, তা-ই পরতে পারে। সেই স্বাধীনতা শিক্ষকদের পোশাক-পরিচ্ছদেও। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ। ‘প্রফেশনাল’ (পেশাদার) এবং যাকে বলে কিনা ‘ইগ্যালিটেরিয়ান’ (সাম্যবাদী)।
আমার বেশ ভাল লেগেছিল পরিবেশটা। মনে হয়েছিল, যাক, এখানে হয়তো আমার ব্যক্তিগত সত্তা নিয়ে ঢাকঢাক গুড়গুড় হাশ-হাশ ভয়টা জলাঞ্জলি দিয়ে বেশ দম ছেড়েই, মন দিয়ে শুধু নিজের কাজ করে যেতে পারব।
আমি সমকামী। এবং এই সত্যিটা যে কতটা আলাদা ভার নিয়ে আসে, তা এখানে আলাদা করে বোঝানোর প্রয়োজন পড়বে না।
প্রথম ক’মাস সে রকমই কেটেছিল। তার পর এক দিন হঠাৎ প্রিন্সিপালের ঘর থেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হল। কারণ কী? কয়েক জন পড়ুয়া আমার ইউটিউব প্রোফাইল খুলে দেখেছে যে, আমার বেশ কয়েকটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের ভিডিয়ো এবং একটি শর্ট ফিল্ম আছে। যেখানে আমি একটি ‘ক্রস-ড্রেসার’ কিশোর, পাতি কথায় নমনীয় পুরুষ দেহে মহিলা পোশাকে অবতীর্ণ হয়েছি।
অবসাদের গভীর অন্ধকারে ডুবতে শুরু করেছিলাম। হয়তো বা হারিয়েও যেতাম। যদি না পেশা বদলাতাম।
শর্ট ফিল্মটি ২০০৯-এর। আর ঘটনাটা ঘটছিল ২০১৭ সালে। আমি না কেমন চমকে গেলাম! কী জবাব দেব! কেনই বা দেব! আমার ব্যক্তিগত প্রোফাইল, সেখানে আমার কিছু কাজ, সেটি প্রথাগত ফর্মুলা মেনে এক জন পদার্থবিদ্যা ও অঙ্কের শিক্ষকের ধারণার বাইরে হতেই পারে। কিন্তু তার প্রভাব স্কুলে পড়ে কী করে! সেটির জন্য জবাবদিহি কেনই বা করতে যাব আমি! সে দিন কিছু বলিনি। শুধু বিরক্ত হয়েছিলাম। একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম ‘ইন্টারন্যাশনাল’ শব্দটির দিকে। শুধু বাইরের মোড়কে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ হওয়া যতটা সহজ, মানসিকতায় নয়।
তার ঠিক দু’মাস পরের ঘটনা। স্কুলে তখন পরীক্ষা চলছে। আর আমরা গার্ড দিচ্ছি। পরীক্ষার ক’দিনের মধ্যেই আমাকে আবার প্রিন্সিপালের ঘরে তলব করা হল। এ বার আমি যথেষ্ট সতর্ক ছিলাম যে আবার কিছু নতুন ‘সমস্যা’ আসতে চলেছে। কিন্তু যেটি শুনলাম, তার জন্য সত্যিই আমি তৈরি ছিলাম না!
আমাকে বলা হল, আমি কি কোনও ছাত্রকে ‘টাচ’ করেছি পরীক্ষার হলে? আমি আকাশ থেকে পড়লাম! ‘টাচ’ করেছি মানে কী? অবশ্যই আমি পরীক্ষায় গার্ড দেওয়ার সময়ে কোনও ছাত্রের পিঠ চাপড়ে দিতে পারি। দিয়েছিও। এক জন শিক্ষক, অষ্টম শ্রেণির একটি বাচ্চা ছেলেকে, পরীক্ষার হলে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বা শাসন করার তাগিদে যে ভাবে পিঠে হাত দেন, তেমনই। কিন্তু তার যে এ রকম একটি অর্থ করা হতে পারে, আমি তো দূরদুরান্তেও ভাবতে পারি না!
‘গুড টাচ’, ‘ব্যাড টাচ’-এর শিক্ষা কি ‘ইন্টারন্যাশনাল’ স্কুলের পড়ুয়াদের এতই মন্ত্রপড়ার মতো দিয়ে দেওয়া হয়, যে তারা সব ছোঁয়াকেই সন্দেহ করতে থাকে! নাকি এক সমকামী শিক্ষকের (তত দিনে আমার যৌনতা প্রায় সকলেরই আলোচ্য) যে কোনও ছোঁয়াই এক ‘পুরুষ’ ছাত্রের কাছে চিন্তার কারণ হতে পারে!
সে বার আর বিরক্ত হইনি। রাগ করিনি। ভয়, আশঙ্কায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। এ বার কি তবে পক্সো আইনে আমার হাতে হাতকড়া পড়ল! স্কুলের কাউন্সেলরের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করলাম। প্রিন্সিপালের সঙ্গে দিনের পর দিন আলোচনা হল। হয়তো স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার ‘বদ মতলব’ নিয়ে সঠিক তথ্য না পাওয়ায় আমাকে সে যাত্রা ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়েছিল।
‘নাচের ছেলে— আমার সমকামী এজাহার’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার ঠিক দু’দিনের মাথায় স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে আবার ডেকে পাঠান। এই শেষ বারের মতো। কারণ, তার পরে আমি স্কুলটিতে আর থাকতে পারিনি।
এ দিকে, তখন আমার একটি আত্মজীবনীমূলক লেখা বেশ কয়েক মাস ধরে ফেসবুক ও একটি ব্লগে নিয়মিত বেরোচ্ছে। যথেষ্ট সমাদরই পেয়েছে সেই লেখা। স্কুলেরও কিছু সহকর্মী (এবং হয়তো কর্তৃপক্ষও) লেখাটি সম্পর্কে অবগত। যথাসময়ে সেগুলি একত্রিত করে ২০১৮-র বইমেলায় লেখাগুলি একটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। ‘নাচের ছেলে—আমার সমকামী এজাহার’ তার নাম। সম্ভবত বাংলায় লেখা কোনও সমকামীর পূর্ণাঙ্গ জবানবন্দি সেটিই প্রথম। আমার বন্ধুমহল ও কিছু সহকর্মীও যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন বইটির উদ্বোধন ঘিরে।
বইটি প্রকাশিত হওয়ার ঠিক দু’দিনের মাথায় ৬ ফেব্রুয়ারি স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে আবার ডেকে পাঠান। এই শেষ বারের মতো। কারণ, তার পরে আমি স্কুলটিতে আর থাকতে পারিনি।
না! নিউ টাউনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া সেই ভদ্রমহিলাকে ঘিরে বসা খাপ পঞ্চায়েতের মতো কিছু হয়নি। চূড়ান্ত অবমাননার মধ্যে দিয়েও যেতে হয়নি। বরং মিষ্টি হেসে, ভদ্রভাষায় দু’টি কথায় জানিয়ে দেওয়া হয়— আমার মতো মানুষের সে স্কুলে আর জায়গা নেই। আমি এখন ‘বিখ্যাত’ মানুষ। একটি বইয়ের লেখক আমি। তাই এ বার নিজেরটা নিজেই বুঝে নেওয়া ভাল।
ফল তো একই ছিল। না? মধ্যবয়সে এসে চাকরি খোয়ানো। অথচ নিজের কাজে কোনও গাফিলতি নেই। আছে শুধু মনগড়া, বদ্ধমূল কিছু ধারণার বাইরে না যাওয়ার ইচ্ছা।
তার পর প্রায় দীর্ঘ এক বছর কোনও চাকরি পাইনি। শুধু ‘খবর’ হয়েছি। বিভিন্ন নামী-দামি খবরের চ্যানেল, পত্রপত্রিকা, বেতারমাধ্যম, নেটমাধ্যম ও আলোচনাসভায় ঝড় তুলেছে সে খবর। ধর্নাও বসেছিল স্কুলের সামনে। শুধু আমার কোনও ‘গতি’ হয়নি। কলকাতার আর কোনও স্কুল আমাকে চাকরি দেয়নি। এমনকি, আমার নিজের স্কুলও নয়।
অবসাদের গভীর অন্ধকারে ডুবতে শুরু করেছিলাম। হয়তো বা হারিয়েও যেতাম। যদি না পেশা বদলাতাম। তখন অতিমারির আগের সময়। ই-লার্নিং সদ্য শুরু হয়েছে। হায়দরাবাদে সে রকমই একটি ই-লার্নিং সংস্থায় কাজ পেলাম। আমার সেই প্রথম কর্পোরেটে কাজ করতে আসা। এবং কর্পোরেটে কাজ করতে এসে দেখলাম, যে এখানকার ভাবনাচিন্তা আলাদা। আর যা-ই হোক, কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না। এক জন কর্মক্ষম ব্যক্তিকে এমন কারণে হারানোর বোকামো তারা করে না। এক জন মানুষকে শুধু ‘রিসোর্স’ ভাবার সীমাবদ্ধতা এবং কর্পোরেটের নিজস্ব সমস্যা থাকতেই পারে। তবুও বলব, এখানে এসেই প্রথম আমার পেশাদার পরিচয় তৈরি হল। শুধু অমুক মানুষটা সমকামী, অমুক মানুষটা বিবাহবিচ্ছিন্ন, অমুক মানুষটা ডিস্কোথেকে গিয়ে নাচেন, অতএব তাঁরা খারাপ ও অযোগ্য— এ সব জিনিসকে কর্পোরেট প্রশ্রয় দেয় না।
জানি না, নিউ টাউনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষিকা এখন কেমন আছেন। কী অবস্থায় আছেন। শুধু এটুকু জানি, উনি ভাল নেই। এক জন ডক্টরেট প্রাপ্ত অধ্যাপিকার কাজ সম্পর্কে বিশেষ না জানলেও তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে দ্বিমত থাকার কথা নয়। তিনি সমাজে কত রকম ভাবে কাজে লাগতে পারেন, সে বিষয়েও একটা হাল্কা আন্দাজ করা যায়।
শিক্ষিকার অমতে তাঁর ব্যক্তিগত পরিধিতে ঢুকে, তাঁর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, তাঁকে ‘স্লাট শেম’ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডল থেকে ‘বহিষ্কৃত’ করা হল। এটা কোনও সভ্য সমাজে হতে পারে! নাকি হওয়া বাঞ্ছনীয়? যে ‘মানহানির’ কথা বলে তাঁর বিরুদ্ধে এক বিশাল অঙ্কের টাকার মামলা করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদৌ সেই ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ আছে কি!
যে কঠিন থেকে কঠিনতম সময় দিয়ে ভদ্রমহিলা যাচ্ছেন, তার সবটা আন্দাজ করতে না পারলেও কিছুটা পারছি। এক দিন এই খবরও পুরনো হবে। বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যাবে। ভদ্রমহিলা যদি তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পান বা পেলেও এই মুচমুচে ‘স্ক্যান্ডাল’ তাঁর বাকি জীবনটা রঙিন করে রাখে, তা হলে কি তিনি সত্যিই ভাল থাকবেন?
করজোড়ে প্রার্থনা করি, তিনি খুব তাড়াতাড়ি নিজের প্রকৃত জায়গা ফিরে পান। সুস্থ পরিবেশে, সুস্থ মানুষের সান্নিধ্যে, কর্মজগতে ফিরে আসুন। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা!
(লেখক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। মতামত নিজস্ব)