ভারতীয় সাংবাদিকতায় নজরুল ইসলামের স্থানাঙ্ক নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। অথচ নজরুলের কবি পরিচয় যখন সবে তৈরি হচ্ছে, তখনই এক জন সাংবাদিক তথা সম্পাদক হিসেবে তাঁর কাজের গতিপ্রকৃতিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সরোজিনী নায়ডু, অনেকেই মান্যতা দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষও পত্রপত্রিকা সম্পাদনার সূত্রেই তাঁকে নাগরিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে বরণ করেছিলেন।
১৯২০ সালের গোড়ার দিকেই ব্রিটিশ সেনার ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে নজরুল কলকাতায় চলে এলেন। প্রথমে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের রমাকান্ত স্ট্রিটের বোর্ডিং হাউসে উঠেছিলেন। দিনকয়েক পরই তাঁর মুসলমান পরিচয় জেনে ওই বোর্ডিংয়ের পরিচারিকা তাঁর বাসন ধুতে অস্বীকার করেন। অতঃপর ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে ঠাঁই হল— মুজ়ফ্ফর আহমেদের আস্তানায়।
মুজ়ফ্ফরের সঙ্গেই সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি নজরুলের। তাঁদের যৌথ উদ্যোগে ও সম্পাদনায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হয়। সব মিলিয়ে নবযুগ-এ পাঁচ মাস কাজ করেন নজরুল। কাগজের প্রধান পরিচালক হিসেবে ফজলুল হকের নাম ছাপা হত। তবে সমস্ত কাজই করতেন নজরুল ও মুজ়ফ্ফর। এই ক’মাসে তিনি নবযুগ-এ ঠিক ক’টি সম্পাদকীয় লিখেছেন, তা আজ আর বোঝার উপায় নেই— তবে এই সম্পাদকীয়গুলির সঙ্কলন যুগবাণী নামক বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। ব্রিটিশ সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৪৮ সালে বইটি আবার প্রকাশিত হয়। যুগবাণী-তে নজরুলের লেখা মোট ২১টি সম্পাদকীয় নিবন্ধ পাওয়া যায়।
ব্রাত্যজনের পক্ষ নিতে হবে, এই বোধ নজরুলের জীবনের অভিজ্ঞান ছিল। নবযুগ-এ তাই শ্রমিকের, কৃষকের, সংখ্যালঘুর স্বর জোরালো হয়ে উঠেছিল প্রথম থেকেই। পত্রিকাকে সামনে রেখে নজরুল একটি ভেদাভেদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক স্বর গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন এই স্বল্প সময়েই। নামপ্রবন্ধটিতেই নজরুল লেখেন, “এসো ভাই হিন্দু! এসো মুসলমান! এসো বৌদ্ধ! এসো ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গণ্ডি কাটাইয়া, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।” নবযুগ-এ নজরুল একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে। ব্রিটিশ শাসকের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ঘৃণার চরিত্রটিকে চিহ্নিত করেন নজরুল। ‘কালা আদমিকে গুলি মারা’ নামক সম্পাদকীয়টিতে নজরুল স্পষ্ট বলছেন, ব্রিটিশরা এ দেশের মানুষকে কুকুরেরও অধম মনে করে।
ভাবতে অবাক লাগে, একুশ বছর বয়সি যুবক সে দিন ভারতের বুকে বর্ণবাদের অভিশাপটিকে চিহ্নিত করেছিলেন কত সহজে। লিখেছিলেন, “হিন্দুধর্মের মধ্যে এই ছুতমার্গরূপ কুষ্ঠরোগ যে কখন প্রবেশ করিল তাহা জানি না, কিন্তু ইহা যে আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃদের মতো একটা বিরাট জাতির অস্থিমজ্জায় ঘুণ ধরাইয়া একেবারে নিবীর্য করিয়া তুলিয়াছে, তাহা আমরা ভাইয়ের অধিকারের জোরে জোর করিয়া বলিতে পারি।” আজ এক শতক পেরিয়েও যখন এই দেশে ব্রাহ্মণের জন্য সংরক্ষিত চিতায় দলিত ঠাঁই পায় না, দলিতদের জলপান রুখতে কুয়োয় কীটনাশক ঢেলে দেয় তাঁরই প্রতিবেশী, তখন মনে হয় ক্রান্তদর্শী যুবকটির কাজের দিকে আর একটু বেশি আলোকপাত করলে আমাদের লাভের পাল্লা ভারী হত। নবযুগ-এর প্রতিলিপি দেশের কোনও আর্কাইভে সংরক্ষিত নেই। এ উপেক্ষা লজ্জার।
ধূমকেতু সম্পাদনার সময়কাল নজরুলের সাংবাদিক সত্তার সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্ব। তিনি নবযুগ ছাড়ার দু’বছর পরে ১১ অগস্ট ১৯২২ থেকে পথচলা শুরু করে ধূমকেতু। সপ্তাহে দু’বার প্রকাশিত হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লবী বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরীসুন্দরী ঘোষ, বীরজাসুন্দরী সেনগুপ্ত, সরোজিনী নায়ডুর আশীর্বাদ নিয়ে শুরু হয়েছিল এই কাগজের পথ চলা। নজরুলের ধূমকেতু সম্পর্কে জনতার আগ্রহের কথা উঠে আসে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর কল্লোলযুগ গ্রন্থে। তিনি লিখছেন “সপ্তাহান্তে বিকেলবেলা আরও অনেকের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, হকার কতক্ষণে ধূমকেতুর বাণ্ডিল নিয়ে আসে। হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্য। কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে লেখা সেই সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। শুনেছি স্বদেশীযুগের সন্ধ্যা-তেও এমনই ভাষাতে লিখতেন।” সন্ধ্যা-র প্রকাশকালে নজরুল পাঁচ বছর বয়সি বালক। কিন্তু সত্যিই সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধবের আপসহীন রাজনীতি ও ভাষার সঙ্গে নজরুলের মিল ছিল। ১৯০৫ সালের মার্চ মাসে সন্ধ্যা পত্রিকার পাতায় লেখা হয়, “আমরা কী চাই? আমরা চাই পূর্ণ স্বাধীনতা। আমরা দেখতে চাই আমরাই আমাদের দেশের মালিক হয়েছি।” এর ১৭ বছর পরে ধূমকেতু-তে ‘ধূমকেতুর পথ’ নামক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে নজরুল দাবি তুলবেন, “সর্ব্ব প্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।”
বাঙালি নারীর নিজস্ব সময়কে ধরার চেষ্টা তখন অতি বিরল। নজরুল ধূমকেতু সম্পাদনার প্রথম দিন থেকেই এই ধরনের গোঁড়ামিমুক্ত হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ধূমকেতু-র প্রথম সংখ্যাতে ‘নারীকল্যাণ’ বিভাগে ‘নারীর সত্য স্বাধীনতা কিসে?’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন বিরজাসুন্দরী দেবী। ধূমকেতু-র দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ নামের একটি কলামে নারীর জাগরণ বিষয়ে তর্কে মাততে দেখা যায় মহিলাদের, সময়ে সময়ে মতামত দেন কয়েক জন পুরুষও।
নজরুল কিন্তু কবি পরিচয়ের জন্যই কারাবরণ করেননি— মনে রাখতে হবে, তাঁর কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ধূমকেতু-র দ্বাদশ সংখ্যার সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। ১২৪ (ক) ও ১৫৩ (ক) ধারায় স্থিতাবস্থা নষ্টে ইন্ধনের অভিযোগে নজরুলকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিচারের ভার পড়ল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর উপরে, যিনি এক জন কবিও বটে। নজরুল বিচারপতিকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন, তা ধূমকেতু-র শেষ সংখ্যায় ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে প্রকাশিত হয়। নজরুল লিখেছিলেন, “আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে কিন্তু ন্যায় বিচারে সেই বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্য স্বরূপ।”
রাজবন্দি নজরুলকে কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত করে হুগলি সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে সহবন্দিদের দুর্দশা দেখে হতভম্ব নজরুল ৩৯ দিন টানা অনশন করেছিলেন। ক্ষমতাকেন্দ্র যখন আজ বার বার সাংবাদিকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে, মৃত্যুপথযাত্রী সমাজকর্মী যখন জেলে জল খাওয়ার জন্য স্ট্র-টুকু পান না, তখন এই নজরুলের থেকে আমরা নতুন করে প্রেরণা পেতে পারি না কি?