বামফ্রন্ট সরকারের পতনের এক বছর পরের ঘটনা। দিল্লির এ কে গোপালন ভবনে প্রকাশ কারাট ‘মতাদর্শগত দলিল’ প্রকাশ করছেন। কেন এই দলিল, তাতে কী রয়েছে, বামপন্থী ঘরানার কঠিন তাত্ত্বিক ভাষার চোটে প্রায় কিছুই বোঝা গেল না। নিরুপায় হয়ে এক সাংবাদিক বললেন, ‘জার্গন’ বাদ দিয়ে ব্যাপারটা কি সহজ ভাষায় বোঝানো যায়?
মুচকি হেসে ব্যাখ্যা শুরু করলেন কারাট। বোঝা গেল, চিনের দেং জিয়াওপিংয়ের মতো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের জন্য যে চাষের জমি অধিগ্রহণের পথ নিয়েছিলেন, তাতে এত কাল দলের সায় ছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার সিপিএম পিছু হটছে। মতাদর্শগত দলিল বলছে, চিনের অন্ধ অনুকরণ করে লাভ নেই। এ দেশে বামেদের ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি মেনেই কাজ করতে হবে।
২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকে বাংলায় সিপিএমের পতনের শুরু। তা ঠেকাতে শুদ্ধিকরণ অভিযান হয়েছে। মতাদর্শগত দলিল তৈরি হয়েছে। ২০১১-য় বাম সরকারের হারের কারণ নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পর্যালোচনা হয়েছে। কলকাতায় সাংগঠনিক প্লেনাম হয়েছে। গত এক দশকে তিনখানা পার্টি কংগ্রেসেও পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের দুর্দশা নিয়ে চুলচেরা বিচার হয়েছে। একের পর এক দলিলে বাম সরকারের কাজকর্মে কোথায় ভুল ছিল, সংগঠনে কী সমস্যা, রাজনৈতিক লাইনে কোথায় ভ্রান্তি, তার তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। তবু আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই। তাঁরা বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে নারাজ। ৩৪ বছরের বাম সরকারের পতন হলেও তাঁদের ধারণা, তাঁরা কোনও ভুল করেননি— মানুষ বোকামি করেছেন। এমনকি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতাকেও তাঁরা ‘কুটিল চক্রান্তের চিত্রনাট্য’ বলেই মনে করেন। এ বার বিধানসভা ভোটে শূন্য হাতে ফেরার পরেও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বিশ্বাস, ‘বিজেমূল’-এর গোপন আঁতাঁতটা ভোটাররা বুঝতেই পারলেন না!
মানুষ যে বোকা নন, ভুলটা যে বিমান বসু-সূর্যকান্ত মিশ্ররাই করছেন, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি তা আরও এক বার আলিমুদ্দিনের কার্যত কান মলে মনে করিয়ে দিল। নিজেদের গোল্লা পাওয়ার পর্যালোচনা করে বঙ্গ ব্রিগেড যে রিপোর্ট পেশ করেছিল, তা এ কে গোপালন ভবনের আবর্জনার ঝুড়িতে জায়গা পেয়েছে। কুড়ি পৃষ্ঠার ওই রিপোর্ট রাজ্য কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাশ করিয়ে তা পার্টি চিঠির আকারে রাজ্য নেতৃত্ব দলে বিলি করতে চেয়েছিল। কিন্তু কেন গ্রামের চাষিরা এখনও সিপিএমের থেকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন— এই আসল প্রশ্নেরই তাতে উত্তর ছিল না। ভোটের আগে সিপিএম নেতারা সিঙ্গুরে গিয়ে কারখানার প্রতীকী শিলান্যাস করে বলেছিলেন, বামেরা ক্ষমতায় এলে ফের শিল্পায়ন হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-শুভেন্দু অধিকারীর তরজাকে হাতিয়ার করে মহম্মদ সেলিমরা প্রমাণের চেষ্টা করলেন যে, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে চক্রান্ত হয়েছিল। ভাবখানা এমন, যেন আসলে এক জন চাষিও জমি দখলের বিরোধিতা করেননি। এতে রাজ্যের চাষিদের মধ্যে কী বার্তা যাচ্ছে, তা নিয়ে আলিমুদ্দিন মাথাই ঘামায়নি। তাঁরা ভুলেই গিয়েছিলেন যে, সিপিএমের দলিলেই ২০১১-র হারের পর্যালোচনায় লেখা হয়েছিল, সিঙ্গুরে ‘প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভুল’-এর জন্য ‘খেসারত’ দিতে হয়েছে।
কেন্দ্রীয় কমিটির পর্যালোচনায় মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজ্য নেতৃত্ব সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম থেকে শিক্ষা নেননি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দশ বছর পরেও ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’-এর বুলি আওড়েছেন। ফলে, গ্রামের মানুষ ভেবেছেন, বামেরা এখনও সেই চাষের জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পায়নের পথেই অনড়। মোদী সরকারের কৃষি আইনের ফলে এমনিতেই চাষিরা জমি হারানোর ভয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। তার মধ্যে সিপিএম নেতাদের মুখে ফের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পক্ষে সওয়াল শুনে মানুষ আরও দূরে সরে গিয়েছেন।
বাম সরকারের স্থায়িত্বের মূল কারণ ছিল গ্রামের গরিব মানুষের সমর্থন। সিপিএম নেতৃত্ব তাঁদের সমর্থন ফেরানোর চেষ্টা না করে কী ভাবে নিজেরা ক্ষমতায় ফিরবেন, সেই সুযোগ খুঁজেছেন। তারই প্রতিফলন, কংগ্রেস-আইএসএফের সংযুক্ত মোর্চা গড়ে একেবারে বিকল্প সরকারের ডাক দিয়ে ফেলা। তাঁরা ভুলেই গিয়েছিলেন যে, কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বাংলায় সিপিএম তথা বামফ্রন্টের সঙ্গে কংগ্রেস-সহ সেই ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির নির্বাচনী সমঝোতা হবে, যারা বিজেপি ও তৃণমূলকে পরাস্ত করতে চাইছে। ফ্রন্ট গঠন করে বিকল্প সরকারের ডাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। কেন্দ্রীয় কমিটি সাফ বলেছে, রাজ্য নেতারা সংযুক্ত মোর্চা তৈরি করে, বিকল্প সরকারের ডাক দিয়ে দলের ‘রাজনৈতিক ও কৌশলগত লাইন’ লঙ্ঘন করেছেন। এটা কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধাচরণ।
মুশকিল হল, আলিমুদ্দিনের নেতারা ভাবতেই পারেন না যে, তাঁরা ভুল করতে পারেন। নিজেদের পর্যালোচনায় পুরো দোষটাই তাঁরা মাঝের ও নিচু সারির নেতা-কর্মীদের উপরে চাপিয়েছিলেন। এক দিকে বলেছিলেন, সংযুক্ত মোর্চা গঠনের ফলে গোটা রাজ্যে, বিশেষত পার্টি কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। অন্য দিকে দোষারোপ ছিল, ভোটের আগে ঠিকমতো বুথ সংগঠন তৈরির কথা বলা হলেও, তা হয়নি। একাংশ সদস্যের ভূমিকা সন্তোষজনক ছিল না। মাঝের সারির কমিটিগুলি তা সময়মতো ধরতে পারেনি। কেন্দ্রীয় কমিটি এ সব অজুহাত উড়িয়ে আলিমুদ্দিনের নেতাদেরই সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য দায়ী করে বলেছেন, ২০০৮ থেকে দলের জনভিত্তিতে ধস আটকাতে রাজ্যের নেতারা ব্যর্থ।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে ‘চক্রান্ত’-র মতোই সিপিএম নেতারা ‘বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে গোপন আঁতাঁত’-এর তত্ত্বে বিশ্বাস করতে ভালবাসেন। এত দিন তাঁরা দিদিভাই-মোদীভাইয়ের বোঝাপড়ার গল্প শোনাতেন। ভোটের আগে সেটা ‘বিজেমূল’ স্লোগানে পরিণত হয়। সিপিএমের শুধু একটাই আফসোস ছিল। এই সব গোপন চক্রান্ত, গোপন আঁতাঁত তাঁরাই বুঝতে পারেন, মানুষের মগজে এ সব ঢোকে না! কেন্দ্রীয় কমিটি এ বার রায় দিয়েছে, তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে দ্বিমেরু লড়াই হয়েছে ঠিকই, তবে তার পিছনে তৃণমূল-বিজেপি আঁতাঁত ছিল বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়াটা ভুল। ভোটের আগে তৃণমূলের বেশ কিছু নেতার বিজেপিতে চলে যাওয়া, ভোটে বিজেপির হারের পরে আবার তৃণমূলে ফিরে আসাকেও রাজ্যের নেতারা বিজেপি-তৃণমূলের আঁতাঁতের প্রমাণ বলে দাবি করেছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, এই সব অনুমান ভুল ছিল। দল বিজেপিকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলেও, আলিমুদ্দিন বিজেপি-তৃণমূলকে এক করে দেখেছে। বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণের ধার কমে গিয়েছে।
আসলে বাংলার সিপিএম নেতারা মানতে চান না যে, বিজেপি তাঁদের হারানো পরিসর দখল করেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে। তাই বিজেপি তৃণমূলের হাত ধরে রাজ্যে পা রেখেছে বলে তাঁরা নালিশ করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধি নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে অভ্যস্ত সিপিএম নেতারা মমতার জয়ের হ্যাটট্রিক আটকাতে এ বার মনেপ্রাণে বিজেপির জয় চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, বিজেপি তৃণমূলকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসবে। তার পরে তাঁরা বিজেপিকে সরিয়ে ফের গদিতে আসবেন। এই আকাশকুসুম স্বপ্ন থেকেই ‘আগে রাম, পরে বাম’-এর তত্ত্ব। বিজেপির আক্রমণের সুরের ঝাঁঝ কমে আসা।
সিপিএমের নেতাদের পক্ষে ভুল শোধরানো সহজ নয়। কারণ, তাঁরা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার মন্ত্র আওড়ে নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে চান। ব্যর্থতার দায় নিয়ে দলের গদি ছাড়তে চান না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ধমক ধামাচাপা দিতে এখন তাঁরা দলের রাজ্য কমিটিতে বয়সের সীমা বেঁধে দিয়ে, বৃদ্ধদের সরিয়ে তরুণ নেতৃত্ব তুলে আনার চিত্রনাট্য সাজাচ্ছেন। জরাগ্রস্ত নেতারা নিজেদেরই ধামাধরা নেতাদের গদিতে বসালে মুখ বদল হবে, হাল শোধরাবে কি?
কমরেড, আগে ভাবের ঘরে চুরি করা বন্ধ করুন। নয়তো ভোট-ব্যাঙ্কে ডাকাতি আটকাতে পারবেন না।