আর জি কর হাসপাতালের মর্মান্তিক ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরের মানুষ পথে নেমেছেন। রাস্তার রাজনীতি এক নয়া মোড় নিচ্ছে। সরকার বিপাকে। ইতিমধ্যে এই রাজ্যের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড— পুজো— দুয়ারে কড়া নাড়ছে। দেখতে পাচ্ছি, জুন মাসে যে সমস্ত হকারের রাস্তার উপরে গড়ে ওঠা দোকানগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, সেই সব দোকানি ফিরে আসছেন। সরকারবাহাদুর বুঝে গিয়েছেন, সবাইকে এক সঙ্গে চটানো মোটেই সঠিক পদক্ষেপ নয়। অতঃপর, সংবাদে প্রকাশ, নতুন হকার সার্ভের ভিত্তিতে পরিকল্পিত উচ্ছেদ আপাতত মুলতুবি থাকছে।
উত্তর ও মধ্য কলকাতার কিছু কিছু জায়গায় হকারেরা টিন বা টারপুলিনের ছাদ হটিয়ে হরেক রঙের ছাতা লাগিয়েছেন। কোথাও কোথাও দোকানগুলিকে কেটে ছেঁটে কিছু কিছু উচ্ছেদ হওয়া হকারদের জন্য জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে। কলকাতার হকারেরা বার বার উচ্ছেদ হন, আবার ফিরেও আসেন। উচ্ছেদের ইতিহাস কেবলই ব্যর্থতার ইতিহাস। হয়তো ভাবছেন, উচ্ছেদের প্রতিকার তো সঠিক পুনর্বাসনে। উন্নয়নের স্বার্থে আর জনস্বার্থে উচ্ছেদ অনিবার্য। কিন্তু হকারদের ক্ষেত্রে উচ্ছেদ আর পুনর্বাসন তালে তাল মিলিয়ে চলে না। তার দু’টি কারণ।
প্রথমত, হকারির আইনি অধিকার আজও সীমিত আর জটিলতায় ভরা। নিষিদ্ধ নয়, এমন পণ্যের বিকিকিনি হকারের অধিকারের সীমার মধ্যে পড়ে, কিন্তু, সব ‘দখলদারি’ আইনত স্বীকৃত নয়। অর্থাৎ, এমনটা হতেই পারে যে, আপনি হকারি করার সময় এক সঙ্গে আইন মানছেন ও ভাঙছেন। কলকাতার নিয়ম, যে সমস্ত হকার ফুটপাতের তিন ভাগের এক ভাগ জুড়ে হকারি করেন, আর এখনও অবধি যাঁরা ফুটপাতের উপর আধ-পাকা বা পাকা দোকান বানাননি, তাঁরা নিয়ম-মানা হকার। কেন্দ্রীয় হকার আইন চালু হওয়ার প্রায় এক যুগ আগে থেকে কলকাতায় এমন এক প্রথা চলে আসছে। কলকাতা কর্পোরেশন আর হকার সংগ্রাম কমিটি একযোগে এই নিয়ম বানিয়েছিল। অনেক সময় ফুটপাত ভাড়া নিয়ে হকারি চলে (গড়িয়াহাট-মোড়ে স্টলের দৈনিক ভাড়া ২০০ টাকা)। স্টল ভাড়া দেওয়া হলে কিন্তু হকারি আবার বেআইনি হয়ে যায়। হকারদের ফুটপাত ব্যবহারের আইনি স্বীকৃতি আর পথচারীদের ফুটপাত ব্যবহারের আইনি স্বীকৃতির মধ্যে মস্ত পার্থক্য আছে। ফুটপাতে পথচারীর চলার অধিকার সর্বজনীন। অন্য দিকে, হকারদের জন্য কেন্দ্রীয় আইনটি নিয়ম-মানা হকারদের নিয়মকানুনের কেবলমাত্র একটি চলনসই ব্যতিক্রম হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু, আইন হওয়ার ফলে আজ এই হকারদের উচ্ছেদ করতে গেলে সরকারকে দেখাতে হবে, জনস্বার্থে উচ্ছেদ জরুরি ও অনিবার্য। নিয়ম-মানা হকারদের পুনর্বাসনের দাবি সবার আগে।
কিন্তু, আজকের পরিস্থিতি এমন যে, নিয়ম-মানা হকারদের চেয়ে নিয়ম-ভাঙা হকারদের সংখ্যা বেশি। তাঁরা হকারির জন্য চিহ্নিত জায়গাগুলির বাইরে পসরা নিয়ে বসে গিয়েছেন। এঁদের পুনর্বাসনের আইনি দায় কিন্তু সরকারের নয়। তাই সরকার নিজের খেয়ালে পুনর্বাসন দিতে পারে। হয়তো যে সমস্ত হকার শাসক দলের ‘বেশি’ অনুগত, তাঁরা পুনর্বাসন পেলেন, আর যাঁরা একটু ‘কম’ অনুগত, তাঁরা ওয়েটিং লিস্টে চলে গেলেন। হয়তো বা যাঁরা ফুটপাতে হকারি করার সীমারেখার বাইরে কিন্তু ফুটপাতের উপরেই রয়েছেন, রাস্তার উপর চলে আসেননি, তাঁদের সরকার কিছুটা বরদাস্ত করে নিল।
এর অর্থ হল উচ্ছেদ কিংবা নিয়ন্ত্রণ হকারদের মধ্যে একটি শ্রেণির জন্ম দেবে, যাঁরা সহজ পথে রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠতে পারবেন না, আবার অন্যত্র পুনর্বাসনও পাবেন না। সুতরাং, এই ‘বাড়তি’ হকারেরা যেখানে জায়গা পাবেন, সেখানেই ডালা পাতবেন, ঠিক যেমনটি এক দিন ফুটপাত হকারেরা করেছিলেন। এই কারণে পুনর্বাসনের মাধ্যমে শহরের রাস্তাঘাট ‘হকার-মুক্ত’ করা যায়নি, যাবে না। বরং, ভাবতে হবে শহরকে উচ্ছেদ-মুক্ত কী ভাবে করা যায়। এটি কঠিন ভাবনা, কারণ, তা আমাদের পুঁজিবাদী সাধারণ জ্ঞানের চৌহদ্দির বাইরে।
হকার উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন প্রকল্পগুলি ব্যর্থ হওয়ার দ্বিতীয় কারণটি হল, ‘সঠিক’ পুনর্বাসন অসম্ভব। যে হকার রাস্তার উপর বসছেন, তাঁর সঙ্গে খদ্দেরের যোগ অবাধ ও তাৎক্ষণিক। শ্রেণিগত ভাবে সবচেয়ে দুর্বল ব্যবসায়ীদের দৃশ্যমানতা সবচেয়ে বেশি। এঁরা অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলতর, আইনে অস্বীকৃত এবং তুলনামূলক ভাবে অসংগঠিত। কিন্তু, সংখ্যায় বহু হওয়ার কারণে রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী। এঁরা হাতে থাকলে বাকি হকার ও দোকানদারও শাসক দলের আয়ত্তে থাকেন। এঁদের পুনর্বাসন ‘সঠিক’ হতে গেলে এঁদের এমন জায়গায় বসতে দিতে হবে, যেখানে ব্যবসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। চৌরঙ্গির হকারদের পুনর্বাসন আর যা-ই হোক অন্য কোথাও সম্ভব নয়। যেখানেই পাঠানো হোক, চৌরঙ্গির হকারেরা ফিরে আসবেন। যে কোনও পুনর্বাসনই তাঁদের কাছে নির্বাসনের মতো।
অতঃপর, সমাধান কী? হকার যদি তুলতে হয়, তবে সরকারকে তাঁদের বন্দোবস্ত আরও সম্ভাবনাময় পেশায় করতে হবে। এসপ্ল্যানেড বা গড়িয়াহাটের মতো ‘দামি’ জায়গায় হকারদের দৈনিক বিক্রিবাটা সাধারণত ৫ হাজার টাকা থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এই সব এলাকায় দৈনিক বিক্রি গড়ে ৩-৪ হাজার টাকার কম হলে সেই হকার বাজারের নিয়মেই অন্য পেশায় চলে যান কিংবা কোনও ছোট রাস্তায় পসরা সাজিয়ে বসেন। প্রতিষ্ঠিত দোকানিদের থেকে হকারেরা ৫ থেকে ১০ শতাংশ কম দামে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। কিছু কিছু হকার আবার দুই থেকে ছ’জন পর্যন্ত শ্রমিক নিয়োগ করেন। পুজোয় বা চৈত্র সেল-এ এই সংখ্যাটা আরও বেড়ে যায়। তার পর হকারদের আবার পুলিশকেও সন্তুষ্ট রাখতে হয়। সাধারণত পুলিশের মাধ্যমেই ‘তোলা’ অন্যান্য মহলে ছড়িয়ে পড়ে।
খরচ বাদ দিয়ে হকারের কাছে যা থাকে, তার একটি অংশ যায় সংসার চালাতে, আর একটি অংশ ধরা থাকে পরের দিনের পসরা সাজানোর জন্য। তাঁদের মূল বিনিয়োগ বাড়ে না, আবার কমেও না। এখানেই বড় পুঁজিপতিদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য। বড় পুঁজিপতিকে নিয়মিত বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলতে হয়। হকারি ভাত-কাপড়ের জন্য বা খুব বেশি হলে একটু সচ্ছল জীবনযাপনের জন্য। একটি ছোট স্টল জনা-আটের রুটি-রুজি জোগায়। ঝড়ঝাপটা আসে, বড় বড় মহীরুহের পতন হয়, কিন্তু হকার টিকে যান।
উচ্ছেদ হলে ‘মালিক হকার’ না হয় পুনর্বাসন পেলেন, কিন্তু, ‘শ্রমিক হকার’ কোথায় যাবেন? অপারেশন সানশাইন-এর পর কিছু মালিক হকার আর ফুটপাতে ফেরেননি। গড়িয়াহাটের ১০০ জন তো পয়সা জড়ো করে গোটা শপিং কমপ্লেক্সই বানিয়ে ফেললেন। নাম রাখলেন ‘শতদীপ’। তাঁদের জায়গা দখল করেছিলেন একদা শ্রমিক হকারেরা। এতে কিন্তু হকারের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। এ-ক্ষেত্রে হকার সংগ্রাম কমিটির বড় ভূমিকা ছিল।
ফুটপাতে হকারশুমারি করে আর তাঁদের আধার নম্বর হকার পরিচয়পত্রের সঙ্গে জুড়ে আপনি হয়তো ‘ঘোস্ট’ হকারদের চিহ্নিত করলেন, কিন্তু, এতে তথ্য (ডাটা) নিয়ে ব্যবসা আর অস্থায়ী ভাবে হকার অপসারণ ছাড়া আর কিছু হবে না। যেটা দরকার, সেটা হল একটি অর্থনৈতিক সার্ভে করে দেখা, শহরের ন্যূনতম মজুরি কত ধার্য করা হলে কোনও হকারই আর কালকে হকারি করতে আসবেন না। এটাও দেখতে হবে যে, প্রত্যেক নাগরিক যেন রোজ অন্তত ন্যূনতম হারে মজুরি আয় করার মতো কাজ পান এবং কাউকে ন্যূনতম মজুরির কমে মজুরি দেওয়া না হয়। ভারত সরকার বা কোনও রাজ্য সরকার কি এই রকম ব্যবস্থা করতে পারবে?
শোনা যাচ্ছে, সরকার নাকি হকারদের পুনর্বাসনের জন্য মল বানিয়ে দেবে। সেই মল কি শহরের দামি জায়গায় বানানো হবে? তাতে বিনোদনের ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ঢালাও বন্দোবস্ত থাকবে? বন্দোবস্ত এত ভাল হলে তো সবাই জায়গার দাবি জানাবে। পুনর্বাসনের সুবন্দোবস্ত করলেও কিন্তু জুগ্গি-ঝুপড়িবাসী মানুষ এবং হকার নতুন জায়গা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ব্যক্তিদের বিক্রি করে বা ভাড়া দিয়ে ফের ঝুপড়ি বা রাস্তায় ফিরে যেতে পারেন। হকারেরা অনেক সময় বলেন যে, বহুতলে পুনর্বাসন হলে নাকি খদ্দের হয় না। এক তলার দোকানদার বেশি ব্যবসা পান। “ফ্ল্যাটের একটি অংশে যদি দোকান বানাতে হয়, বা ছোট্ট একটি কারখানা বসাতে হয়, তা হলে পাঁচ তলার উপরে ফ্ল্যাট পেয়ে লাভ কী? ফ্ল্যাট আর কাজের জায়গার দূরত্ব অনেক। পুনর্বাসন পেয়ে খরচ বেড়ে গিয়েছে।” মোট কথা এই যে, পুনর্বাসন প্রকল্পগুলি সমাজে বৃহত্তর অসাম্য দূর করার জন্য বানাতে হবে। তা না করে উচ্ছেদ করলে সমস্যা বেড়ে যাবে।
যাঁরা সারা দিন রাস্তায় বা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে হকারি করেন, তাঁদের কেউই কিন্তু ইচ্ছা করে হকার হননি। অতিমারির পর এঁদের সংখ্যা এত বেড়ে গেল কেন? কারণ, বহু মানুষ নিরুপায় হয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেন। হকারেরা সারা দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সূর্যের তাপে দগ্ধ হন। গাড়ির ধোঁয়া সোজা ওঁদের ফুসফুসে ঢোকে। গ্রীষ্মে হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বহু লোক হিট স্ট্রোকে মারাও গেছেন, যাঁদের মধ্যে হকাররা আছেন। জলবায়ু পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকা কিন্তু নগণ্য।
এঁরা সমাজকে যা দেন আর বিনিময়ে যা ফিরে পান, তার মধ্যে দুস্তর ফারাক আছে। ৩৪ বছর বয়সি হকারকে ৬০ বছরের প্রৌঢ় বলে ভ্রম হয়। এই দেওয়া-নেওয়ার ব্যবধান ঠিক কতটা, আর কী উপায়ে এই ব্যবধান দূর করা যায়, তা ভাবা জরুরি। যে কাজে এই ব্যবধান যত বেশি, সেই শ্রমিকের কাছে সমাজ ততটা ঋণী।
ইতিহাস বিভাগ, আইআইএসইআর মোহালি ও ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা