ক্ষোভ: পশ্চিমঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী হিংসা প্রসঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলন করছেন বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। ২ জুলাই, কলকাতা। পিটিআই।
ভোট-পরবর্তী হিংসা রুখতে পারেনি রাজ্য সরকার, জানিয়ে দিল কলকাতা হাই কোর্ট। বহু লোক রাজনৈতিক হিংসায় আক্রান্ত হয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারেননি, চিকিৎসা করাতে পারেননি, যথাযথ তদন্ত হয়নি। এ কথাগুলো কেবল রাজ্য সরকার বা শাসক দলকে বিব্রত করবে, তা-ই নয়; এ রাজ্যের নাগরিক সমাজের একাংশকে অস্বস্তিতে ফেলবে, বিশেষত যাঁরা মানবাধিকার, বাক্স্বাধীনতা এবং আন্দোলনের অধিকার নিয়ে লড়াই করেন। বিধানসভা ভোটের পরে এ রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি বারবার গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ তুলেছে। সাধারণত যে সংগঠনগুলো এ বিষয়ে সরব, সেগুলো কিন্তু অনেকটাই নীরব ছিল। হয়তো তার কারণ এই যে, বিজেপি নেতাদের মুখে ‘গণতন্ত্র’, ‘মানবাধিকার’ শব্দগুলো শুনলে অনেকেরই অস্বস্তি হয়। বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার হরণের এক ধারাবাহিক অভিযান বিজেপি-পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিরোধী হিসেবে বিজেপি নেতা-কর্মীরা সেই সব সুরক্ষা দাবি করলে তা ভণ্ডামির মতো শোনায়। এমনকি তাঁরা আক্রান্ত হলেও, অনেকটা জগন্নাথ নাটকের জগন্নাথের মতো, ইচ্ছাপূরণের আনন্দও হয়তো কেউ কেউ পেতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গে ভোট-পরবর্তী হিংসা নিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির একটা বড় অংশের নীরবতা কি এই জন্যই?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোট-পরবর্তী সময়ে তৃণমূলের হিংসার অভিযোগকে ‘বিজেপির অপপ্রচার’ বলেছেন। দাবি করেছেন যে, রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে ‘নিরপেক্ষ’। বিজেপির তরফে যা কিছু প্রচার হচ্ছে তার সবই সত্য, এমন হয়তো নয়। ‘ফেক’ ভিডিয়ো চলছে। কিন্তু এটাও সত্য যে, বিজেপি-সহ রাজ্যের সমস্ত বিরোধী দলের কর্মীরাই ভোটের ফল বেরোনোর পর তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিজেপির পরেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত আইএসএফ-এর কর্মী-সমর্থকরা। কিছু এলাকায় আক্রান্ত সিপিএম ও কংগ্রেসের সমর্থকরাও। এমনকি যাঁদের উদ্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, সেই ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র কর্মীরাও তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন হিঙ্গলগঞ্জে। আবার, উত্তরবঙ্গের কিছু জেলায়, যেখানে বিজেপির প্রভাব কিছুটা বেশি, সেখানে আক্রমণকারী বিজেপি, আক্রান্ত তৃণমূল।
এ রাজ্যে ভোট-পরবর্তী হিংসা নতুন নয়, বাম আমলে প্রতি নির্বাচনেই ঘটেছে। কিন্তু তা নিয়ে দেশ জুড়ে হইচই পড়েনি। বিজেপি কিন্তু এই প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্ট, মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, এসসি-এসটি কমিশন— বহু বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে রাজ্য সরকারকে কিছুটা চাপে ফেলতে পেরেছে। কিন্তু রাজ্যের নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল, ও দলীয় রাজনীতির বাইরে গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলি নীরব। ফলে, এক দিকে এ রাজ্যে শাসকবিরোধী পরিসরটা কার্যত বিজেপিকে ছেড়ে দেওয়া হল। অন্য দিকে, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে বলার হক কার আছে, তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠে গেল। যা অদলীয় গণতান্ত্রিক শক্তিদের ভবিষ্যতেও তাড়া করে বেড়াবে।
ছোট-বড় তৃণমূল নেতারা বলছেন, ভোটের আগে বিজেপি নেতারা নানা উস্কানিমূলক কথা বলে সমর্থকদের উপর হামলার জমি তৈরি করেছেন। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, যে নেতারা লাগাতার হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁরা আজ কেন্দ্রীয় বাহিনী পরিবেষ্টিত হয়ে বিচরণ করেন। তাঁদের টিকি স্পর্শ করার সাহস বা ক্ষমতা, কোনওটাই নেই শাসক দলের। মার খাচ্ছেন একেবারে নিচুতলার সাধারণ ভোটার, সমর্থক বা পোস্টার-সাঁটানো কর্মীরা— যাঁরা দরিদ্র, দুর্বল। এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ভোটে জিতে যাওয়া মানে পরাজিতদের মারধরের লাইসেন্স পাওয়া নয়। হারানো সমর্থকদের কোনও দল ফিরে চাইতেই পারে, কিন্তু তাঁদের কাছে টানতে হবে রাজনৈতিক ভাবে। বিজেপি বা আইএসএফ কর্মীদের মাথা ন্যাড়া করে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে, জমিতে চাষ করতে না দিয়ে, দোকান খুলতে না দিয়ে, মোটা টাকা জরিমানা করে, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে ‘আত্মসমর্পণ’ করতে বাধ্য করা তার উপায় নয়; গুলি করে, বা পিটিয়ে হত্যা করে তো নয়ই।
রাজনৈতিক হিংসার প্রতিবাদ যে স্রেফ রাজনৈতিক বিরোধিতার খেলার আরও একটি চাল বলে দেখা হচ্ছে, তার খানিকটা দায় বিজেপিরও। শাসক দলের হিংসা নিয়ে এত কথা বলছেন বিজেপি নেতারা, কিন্তু আইএসএফ বা অন্য বিরোধীদের উপর হামলা নিয়ে স্পিকটি নট। ডায়মন্ড হারবার, মগরাহাট, ক্যানিং, ভাঙড়, দেগঙ্গা-সহ বহু এলাকায় আইএসএফ সমর্থকদের ঘরবাড়ি ভাঙা, জ্বালিয়ে দেওয়া, মহিলাদের নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য কর্মী-সমর্থক এখনও ঘরছাড়া। আইএসএফ-সিপিএম-কংগ্রেস মিলে গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতার যে বিকল্প কেন্দ্র তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল, তাকে তৃণমূল কোনও ভাবেই দানা বাঁধতে দিতে চায় না। এই বিকল্পের কেন্দ্রে রয়েছে আইএসএফ, যার প্রধান ভিত্তি দরিদ্র মুসলমানরা। তৃণমূল এই ভিত্তি নষ্ট করতে মরিয়া। আইএসএফ বিপুল ভাবে আক্রান্ত হলেও সে ভাবে প্রতিবাদে সরব হতে পারেনি, হইচই বাধাতে পারেনি। এই নীরবতা অনেক ক্ষেত্রেই ভয় থেকে তৈরি হয়— শুধু মারধর নয়, ঘটিবাটি চাটি হওয়ার ভয়।
রাজনৈতিক বিরোধিতার অন্য যে চাল হিংসার গুরুত্বকে লঘু করেছে, তা এসেছে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও অদলীয় গণতান্ত্রিক শক্তির তরফ থেকে। বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা আক্রান্ত আইএসএফ, কংগ্রেস বা বামকর্মীদের বুঝিয়েছেন— বোঝাপড়া করে নাও, না হলে বিজেপির সুবিধা হয়ে যাবে। বিজেপির সুবিধা হয়ে যাবে, তাই শাসক দল তৃণমূলের শত অন্যায় মেনে নেওয়ার এই যে দাওয়াই প্রচার করা হচ্ছে, তা শেষ বিচারে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বিরোধীর সুরক্ষার ধারণা ধ্বংস হয়ে গেলে ফ্যাসিবাদী বিজেপির সামাজিক ভিত্তি আরও দৃঢ় হয়ে উঠবে। ভিন্ন মতের অধিকার, স্বাধীন ভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার, নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রক্ষায় সরব হয়ে ওঠার একটা মস্ত সুযোগ ছিল নাগরিক সমাজে এই বারের বিধানসভা নির্বাচনের পরে, যা এ রাজ্যের নাগরিক সমাজ হেলায় হারাল।
নিপীড়িত, খেটে-খাওয়া মানুষের ধর্ম যেমন দেখার নয়, তেমনই তাঁর হাতের পতাকার রং দেখলেও চলবে না। পুলিশ-প্রশাসনের দলদাসত্বও মেনে নেওয়া যাবে না। রাজধর্ম পালন করতেই হবে নির্বাচিত সরকারকে। চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে ‘চোখের মণির মতো রক্ষা’ করার পরিণাম ভাল হয়নি। বিজেপির আজকের বাড়বাড়ন্ত সেই সময়কার অরাজনীতির চাষেরই পরিণাম। বিজেপিকে আগামী দিনে যাঁরা রাজ্যের মসনদ থেকে দূরে রাখতে চান, তাঁরাও যদি ভাবেন যে, তৃণমূলকে প্রশ্নহীন সমর্থন করাই ঠিক ‘রাজনৈতিক কৌশল’, তবে সেই সিদ্ধান্তটি আত্মঘাতী হবে।
প্রতিটি অগণতান্ত্রিক আচরণ, প্রতিটি মানবাধিকার হরণ, প্রতিটি হামলার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। সমালোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে রাস্তায় নামতে হবে। গণতন্ত্র-মানবাধিকার রক্ষার জন্য, সেই মূল্যবোধগুলি প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু কর্তব্য, তার সবই করতে হবে। প্রয়োজনীয় মূল্য চোকাতে হবে। কোনও শর্টকাট নেই।