Satyendra Nath Bose

এ ভাবেও ভুলে যাওয়া যায়

গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ নিবন্ধ লিখে পাঠিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাত একটি বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকায়। কিন্তু নিবন্ধটি প্রকাশ পেল না।

Advertisement

শেখর দত্ত

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:২৭
Share:

১৯২৪ সালে বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু কোয়ান্টাম ফিজ়িক্সের অন্যতম পথিকৃৎ বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের একটা ‘ভুল’-এর উপর ভিত্তি করে অসামান্য একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেললেন। নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার স্ট্যাটিসটিক্সের। নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যা ও শক্তি-শূন্য ভরকণার একটি নতুন তত্ত্ব বেরিয়ে এল। গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ নিবন্ধ লিখে পাঠিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাত একটি বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকায়। কিন্তু নিবন্ধটি প্রকাশ পেল না। প্রত্যাখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ নিবন্ধটি সরাসরি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আইনস্টাইন নিবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে, সঙ্গে নিজের একটি নোট সংযুক্ত করে জার্মানিরই এক বিখ্যাত বিজ্ঞান-দর্শন পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন।

Advertisement

নিবন্ধটি প্রকাশ হতেই দিকে দিকে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জগতে তৈরি হল ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’ নামে কোয়ান্টাম ফিজ়িক্স-এর এক নতুন দিগন্ত। তারই সুবাদে সত্যেন্দ্রনাথ বসু দুই বছর ইউরোপে থেকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন-সহ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেলেন। উদ্ভব হল ‘বোসন কণা’, ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেন্সেট’ তত্ত্ব ইত্যাদি। অনেক পরে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার উপর কাজ করে হিগস-বোসন কণা নাম দেন। ২০১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান এই কাজের সুবাদে।

সত্যেন্দ্রনাথের সেই চার পৃষ্ঠার গবেষণাপত্রের মূল ধারণাটিকে কেন্দ্র করে স্বয়ং আইনস্টাইন অন্যত্র পর পর তিনটি প্রবন্ধ লেখেন। বিজ্ঞান-লেখক জন গ্রিবিং তাঁর শ্রয়েডিঙ্গার’স কিটেনস-এ সত্যেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অংশটির শিরোনাম দেন ‘দ্য ম্যান হু টট আইনস্টাইন টু কাউন্ট ফোটনস’। বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়নের গুরুত্ব এতখানিই। পদার্থের সঙ্গে আলোক বিকিরণের পারস্পরিক ক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক আলোককণার ধারণা পেশ করেছিলেন ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। ওঁর মতে, আলো শোষিত বা বিকিরিত হয় একটানা নয়, খণ্ডে খণ্ডে। আলোর ওই কণারূপ তার তরঙ্গাকারের (যা পরীক্ষিত সত্য) পরিপন্থী। সত্যেন্দ্রনাথ আলোকে গ্যাসের মতো পুরোপুরি কণার সমাবেশ হিসেবে তিনি ধরে নেন এবং নতুন সংখ্যাতত্ত্ব প্রয়োগ করেন। ফলে অসঙ্গতি থেকে প্লাঙ্ক-সূত্রের মুক্তি এবং কোয়ান্টাম সংখ্যাতত্ত্বের জন্ম।

Advertisement

১৯৭৪ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে পর্যন্ত জাতীয় বিজ্ঞান আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিজ্ঞান গবেষণা করে গেছেন। কোয়ান্টাম ফিজ়িক্সের আজকের প্রাসঙ্গিকতায় সত্যেন্দ্রনাথের যুগান্তকারী উপলব্ধি গবেষণালব্ধ কাজগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্পেস সায়েন্স, আন্তর্জাতিক ও বিশ্বময় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রায়োগিক বা ফলিত বিভিন্ন দিক-সহ আধুনিক বিজ্ঞানের বহু ক্ষেত্রে তাঁর কাজ আজ অপরিহার্য।

সত্যেন্দ্রনাথের একশো ত্রিশ পূর্ণ হল গত বছর। তাই নিয়ে বিশ্বের বেশ কিছু জায়গায় চলল কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্সের উপর সিম্পোজ়িয়াম, সেমিনার ও প্রাসঙ্গিক ভাবনার আরও উন্মেষ। সদ্য তেমনই আলোচনা করে গেলেন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা, আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ঘটে গেল কলকাতার ‘এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস’-এ। কিন্তু সেই বৃত্তের বাইরে এ দেশে, এই বাংলায় কি কোনও আলোড়ন হল তাঁকে নিয়ে? তিনি গবেষণাগুলো করেছিলেন বঙ্গভূমেই— ফরিদপুরের কলেজে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ ক্যাম্পাসে, বা বিশ্বভারতীতে। আইনস্টাইনের ডাকে তিনি কাজ করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন ডাকসাইটে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বসে।

বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা ও পঠনপাঠনের জন্য তাঁর ছিল অনলস প্রচেষ্টা। তাঁর উদ্যোগেই ১৯৪৮ সালে কলকাতায় গড়ে উঠেছে ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’। ১৯৬০ সালে বিজ্ঞানের শুধুমাত্র মৌলিক গবেষণা মূলক নিবন্ধ নিয়ে ‘রাজশেখর বসু সংখ্যা’ প্রকাশ করে তিনি প্রমাণ করেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাও মাতৃভাষায় করা সম্ভব। সত্যেন বসু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতেন “যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা অসম্ভব তাঁরা হয় বাংলা জানেন না নয়তো বিজ্ঞান বোঝেন না।”

বিশ্বের নানা ভাষাভাষী বিজ্ঞানীরা তাঁকে মনে করছেন। কিন্তু আধুনিক বাঙালি তাঁকে ব্রাত্য করে দিয়েছে। না সরকারি উদ্যোগে, না বিজ্ঞান ক্লাবগুলিতে, অথবা স্কুল কলেজে, কোথাও এই মহান বিজ্ঞানীর মহত্তর কীর্তির উল্লেখমাত্র আমরা খুঁজে পেলাম না। তাই আজ নাহয় কিছু বিজ্ঞান-অজ্ঞ কিন্তু বিজ্ঞানপ্রেমীদের ব্যর্থ আক্ষেপই ঘুরে বেড়াক এই বাংলার হাওয়ায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement