রাশিয়া কি এই মুহূর্তে আত্মঘাতের খেলাতে লিপ্ত? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সূত্রে ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবির দু’টি উদ্ধৃতি হঠাৎই স্মৃতির ভাঁড়ার থেকে উঠে এল। যার মধ্যে প্রথমটি হল, ‘সভ্যতার মৃত্যু হয় আত্মঘাতে। তাকে কেউ হত্যা করে না।’ মনে হল, রাশিয়া কি এই মুহূর্তে সেই আত্মঘাতের খেলাতেই লিপ্ত? রাশিয়া ইউক্রেনের উপরে অতি স্থূল ভাবে আক্রমণ চালিয়েছে এবং পশ্চিমী শক্তিগুলির দ্বারা অপ্রত্যাশিত ভাবে ভূ-অর্থনৈতিক আগ্রাসনের দ্বারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এই দু’টি বিষয় পরস্পর-সংযুক্ত, কিন্তু এদেরকে পৃথক ভাবে দেখাই দস্তুর। সামরিক দিক থেকে দেখলে রাশিয়ান ফৌজ এই মুহূর্তে ইউক্রেনের এক চতুর্থাংশ অধিকার করে রয়েছে। এর ফলে ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা এবং কিছু অঞ্চলের দখলদারির খেলায় মস্কো খানিক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বলেই মনে হতে পারে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের তরফে এখনও পর্যন্ত তেমন ঐকান্তিক ভাবে এই সব বিষয়ে আলাপ-আলোচনায় না যাওয়া থেকে এমন মনে হতে পারে যে (অবশ্য এতে কিছু ভুলও থাকতে পারে), বর্তমান সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পুতিনের অনুধাবন তেমন শোচনীয় নয়, যেমনটি পশ্চিমী বিশ্লেষকরা বর্ণনা করছেন।
পশ্চিমী শক্তিগুলি কর্তৃক প্রযুক্ত বিভিন্ন অবরোধের দ্বারা রাশিয়াকে ভূ-অর্থনৈতিক ভাবে নিঃসঙ্গ করে ফেলার বিষয়টি কিন্তু গুরুতর। ইউক্রেনের সঙ্গে কোনও সমঝোতা হওয়ার পরেও এই সব অবরোধ না-ও উঠতে পারে। অন্য ভাবে দেখলে, পশ্চিমের অভিপ্রায় এমন হতেই পারে যে ইউরোপীয় বাজারে খনিজ তেল এবং গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার যে কৌশলগত হুমকি রাশিয়া এত কাল দিয়ে এসেছে, তা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া।
মনে রাখতে হবে, জনৈক আমেরিকান সেনেটর একদা রাশিয়াকে বর্ণনা করেছিলেন ‘রাষ্ট্রের ছদ্মবেশে এক গ্যাস-স্টেশন’ হিসেবে! চিন, এমনকি ভারতও যেখানে কম দামে বিক্রয় করার উপযুক্ত জায়গা পেতে সমর্থ, সেখানে রাশিয়া কিন্তু অন্য কোনও ক্রেতা এখনও যোগাড় করে উঠতে পারেনি। মস্কোকে এর মাশুল দিতে হবেই।
জনৈক আমেরিকান সেনেটর একদা রাশিয়াকে বর্ণনা করেছিলেন ‘রাষ্ট্রের ছদ্মবেশে এক গ্যাস-স্টেশন’ হিসেবে!
পুতিন এই মর্মে প্রতিবাদ করছেন যে, এ সব অবরোধ আসলে যুদ্ধঘোষণারই নামান্তর। কিন্তু তিনি নিজেও একই ধরনের ভূ-অর্থনৈতিক অবরোধ জারি রেখেছেন ককেশাস অঞ্চলের বেশ কিছু ক্ষুদ্রায়তন রাষ্ট্রের উপর। বিষয়টিকে বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন রবার্ট ব্ল্যাকউইল এবং জেনিফার হ্যারিস তাঁদের ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ার বাই আদার মিনস: জিওইকোনমিকস অ্যান্ড স্টেটক্র্যাফট’ গ্রন্থে। তাঁরা সেখানে এমন কথাও বলেছিলেন যে, বাণিজ্য-ঘটিত অবরোধের থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ বেশি কার্যকর। কারণ, অর্থের যোগান আসে বাণিজ্য থেকেই। সুতরাং যখন রুশি রুবলের বাজারদর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল, তার পিছনে কাজ করেছিল ২০ শতাংশ সুদের এক অস্থিতিশীল হার। এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে রাশিয়ার সামনে একটি মাত্র পথই উন্মুক্ত ছিল। সেটি এই— ডুবন্ত অর্থনীতি এবং ক্ষীয়মাণ ক্ষমতা থেকে উদ্ধারের জন্য এক প্রকার মরিয়া হয়েই এক প্রায়-পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া।
এর পরেই মনে আসে টয়েনবির দ্বিতীয় উক্তিটি। ১৯৫২ সালে তাঁর রিথ বক্তৃতামালায় ইতিহাসবিদ বলেছিলেন, অ-ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির উপর পশ্চিম যা করেছে তা ‘ক্ষমার অযোগ্য আগ্রাসন’। এই সংক্রান্ত স্মৃতি বাছাইয়ের ব্যাপারে আবার পশ্চিম বেশ সুবিধাবাদী। কিন্তু যে দেশগুলির উপর আগ্রাসন প্রযুক্ত হয়েছিল, তারা সেই সব দুঃসহ স্মৃতিকে ভুলতে পারেনি। এ থেকেই বোঝা যায়, সময় ও সুযোগ পেলেই তাদের অনেকেই, এমনকি ভারতও প্রত্যাঘাত করতে প্রস্তুত। পশ্চিমের উচ্চ নৈতিকতার দোহাই দিয়ে যাবতীয় অনুমান ব্যর্থ করে, ইউরোপের অন্যান্য দেশ বাদ দিয়ে রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানির বিষয়টিকে ‘ভিন্ন ভাবে’ দেখার ভণ্ডামি সত্ত্বেও এ কথা সত্য। বিশেষত আমেরিকা আশ্চর্যজনক ভাবে এ কথা বুঝতে চায় না যে, ওয়াশিংটন ডিসি বা বার্লিন থেকে বিশ্বকে যেমন দেখতে লাগে, নয়াদিল্লি থেকে ঠিক তেমন দেখায় না।
সামরিক দিক থেকে দেখলে রাশিয়ান ফৌজ এই মুহূর্তে ইউক্রেনের এক চতুর্থাংশ অধিকার করে রয়েছে।
আর এক জন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, ইয়ান মরিস এক দশক আগে ‘হোয়াই দ্য ওয়েস্ট রুলস— ফর নাউ’ গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, ১৯০০ সালে পশ্চিমের আধিপত্য যতখানি বিস্তৃত ছিল, ২০০০ সালে ততখানি নয়। ক্ষমতার এই তুলনামূলক হ্রাস অব্যাহত থাকবে মূলত চিনের উত্থানের কারণেই। ক্ষমতাকেন্দ্রের এই ভরবিন্দু পরিবর্তনের মধ্যবর্তী সময়ে বহু মেরুবিশিষ্ট এক বিশ্বের উত্থান পরিলক্ষিত হবে। ভূ-অর্থনীতির সাম্প্রতিক সামরিকীকরণ বা অস্ত্রসজ্জা কেবল মাত্র ‘সুইফট’ (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন)-এর মতো পশ্চিম-কেন্দ্রিক সংস্থার পরিবর্ত নির্মাণের কাজকে ত্বরান্বিত করবে না, সেই সঙ্গে জাতীয় স্তরের তথ্যাদি সুরক্ষিত রাখার কাজ ও জাতীয় স্তরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরিকেও সম্ভব করে তুলবে। এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের প্রধান অর্থনৈতিক নিয়ন্তা হিসেবে আমেরিকান ডলারের আধিপত্যের দিনাবসানও ঘটাবে।
পশ্চিমের আজকের ধারণা অনুযায়ী এই পালাবদল মূলিত শুরু হয়েছে সেই দিন থেকে, যখন উদারপন্থী গণতন্ত্রগুলি তাদের সম্মিলিত শক্তিকে প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’-এ মার্টিন উলফ এই শক্তির উদ্গীরণের একটি বিশেষ বিন্দুকে চিহ্নিত করে লিখেছিলেন, ‘বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতিজনিত এক দীর্ঘ পর্বের উন্মেষ নিশ্চিত… বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখলে, দু’টি শিবিরের জন্ম এবং তাদের মধ্যে গভীরতর ফারাকও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভুবনায়নের বিপরীত গতিজাড্যে এমনটিই অনিবার্য, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে বাণিজ্যিক অভিপ্রায়গুলিকে উৎসর্গ করার মতো কাজের এটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।’ বিষয়টি নিয়ে উৎসাহে মেতে ওঠার কোনও কারণ নেই। আর প্রাকৃতিক সম্পদ ও সমরাস্ত্রের কারণে বহির্শক্তির উপর দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরশীলতার বিন্দু থেকে দেখলে ভারতের সামনে একটিই পথ উন্মুক্ত— নতুন মিত্র খুঁজে বার করার পথে পুরনো মৈত্রীগুলি যাতে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, সে দিকে লক্ষ রাখা।