নরেন্দ্র মোদীর সমর্থক ও সমালোচক, সকলেই এত দিন বলতেন— বিদেশ নীতিতে তাঁর সাফল্য ভালই। যুদ্ধ এবং অন্যান্য বিশ্ব সঙ্কটের মধ্যে এক দিকে যেমন ভারতের অর্থনীতির বৃদ্ধি অপ্রতিহত রয়েছে, অন্য দিকে তেমনই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
নিয়মিত ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, এবং সেই সঙ্গে আরব দেশ, আফ্রিকা, এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রেখে গিয়েছেন। রাশিয়া এবং আমেরিকা, দু’দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন, যা আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেড়েছে।
সেই মোদী ম্যাজিক কি ক্রমশ ক্ষয়ে আসছে? গত কয়েক মাসে পর পর কিছু ঘটনার জেরে অনেকে সে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন, যা শেষ অবধি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করল, তার জন্য ভারত প্রস্তুত ছিল না। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংসদে জানিয়েছেন যে ৫ অগস্ট হাসিনার আবাস গণভবনের দিকে উন্মত্ত জনতা ছুটে যাচ্ছে, জেনে তাড়াহুড়ো করে হাসিনাকে ভারতে আসার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। মলদ্বীপে এক জন ভারত-বিমুখ নেতাকে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসা থেকে বিরত করতেও ব্যর্থ হয়েছে ভারত। নেপালেও চিনের অনুকূল সরকার গঠন রদ করতে পারেনি। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ভারতের জন্য সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে ভারত-বিরোধী মনোভাবের বাড়বাড়ন্তের সময়েও হাসিনা ছিলেন ভারতের সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
কোনও বিদেশি শক্তি হাসিনা সরকারের পতনের পিছনে কাজ করেছে, ভারতের এই তত্ত্ব প্রায় কোনও দেশ গ্রহণ করেনি। অনেকেই বলেছেন, নয়াদিল্লি তেমন কোনও অভিসন্ধির কথা জানতে পেরে থাকলে কেন তা প্রতিরোধ করতে পারল না? নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ শক্তি বলে দাবি করার পরেও ভারতের এই ব্যর্থতা কেন? এ প্রশ্নও উঠছে যে, ভারতের অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তা হলে চিনের প্রভাব ঠেকাতে পারবে কি ভারত?
তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পরে মোদীর প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল রাশিয়ায়, যা নিয়ে যথেষ্ট প্রচারও হয়েছিল। কিন্তু তা আশানুরূপ ফল দেয়নি। যে সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে ওয়াশিংটনে নেটোর বৈঠক হল, সেই সময়েই মোদী রাশিয়া সফর করলেন। মোদী এবং পুতিনের পরস্পর আলিঙ্গনের ছবিও প্রকাশিত হল। কিন্তু সেই দিনই ইউক্রেনে স্কুলের শিশুরা নিহত হল একটি ক্ষেপণাস্ত্রের হানায়, যেটি রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র বলেই অভিযোগ। স্বাভাবিক ভাবেই ইউক্রেন, আমেরিকা-সহ নানা দেশের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ল ভারত। অভিযোগ উঠল যে, মোদীর রাশিয়া সফরের ফলে শান্তির জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে।
এই দুর্ভাগ্যজনক সফরের পরে ভারতের নীতি-নির্ধারকরা তড়িঘড়ি ঘোষণা করলেন যে মোদী ‘শান্তি স্থাপন’-এর উদ্দেশ্যে যাবেন ইউক্রেনে। গত বছর জি২০ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ আলোচনা পরিচালনার ফলে একটা এমন ঘোষণাপত্র তৈরি করা গিয়েছিল যাতে রাশিয়ার উল্লেখ ছিল না। ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার প্রতি অধিকাংশ দেশ যখন বিরূপ, তখন এমন মধ্যপন্থার জন্য প্রশংসিতই হয়েছিল ভারত। ভারতের কূটনীতিকরা মনে করেছিলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে কথাবার্তার পরে আবার সেই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করা যাবে। কিন্তু মোদী কিভ পৌঁছনোর আগেই ইউক্রেন রাশিয়ার উপর আক্রমণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। পুতিন জানিয়ে দেন যে, তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে কোনও রকম শান্তি আলোচনায় আগ্রহী নন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কি মোদীর শান্তিপ্রস্তাব তৎক্ষণাৎ খারিজ না করলেও, এমন সব শর্ত জুড়ে দেন যাতে তা পুতিনের কাছে কখনওই গ্রহণযোগ্য না হয়। এমনকি মোদী ইউক্রেন ছাড়ার আগেই ওই প্রস্তাবের সমালোচনা করেন। যে-হেতু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সব পর্যবেক্ষকের কাছেই স্পষ্ট ছিল যে ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে হলে তা আমেরিকার মাধ্যমেই সম্ভব, তাই মোদীর কিভ-এ এই ‘পিস মিশন’-এ অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেছিলেন, তাঁর মস্কো-ভ্রমণের বিপর্যয়ের পরে আমেরিকাকে সন্তুষ্ট করতেই মোদী ইউক্রেন সফরে গিয়েছিলেন। যদিও ভারতের তরফে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে, মোদীর ইউক্রেন সফরে পুতিনেরও সমর্থন ছিল।
মোদীর আগামী আমেরিকা সফর, এবং কোয়াড বা ‘কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’-এর (ভারত ছাড়া যাতে আছে আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া) নেতাদের সঙ্গে বৈঠক সরকারের তরফে ‘অত্যন্ত সফল’ বলে দাবি করা হবে। কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে আমেরিকায় তাঁর সহযোগীরা ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় জমি দিতে আর তেমন আগ্রহী নন। আমেরিকা আর রাশিয়া, দু’পক্ষকেই সন্তুষ্ট রেখে চলার চেষ্টা ভারত বেশি দিন চালাতে পারবে কি? ভারত যদি চিনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে, তা হলে আমেরিকার চাপ বাড়বে। কোনও এক পক্ষকে বেছে নিতে বাধ্য হবে ভারত।
এরই মধ্যে রাহুল গান্ধীর আমেরিকা সফর ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে ওয়াশিংটন কেবল মোদীর সঙ্গেই কথা বলছে না, অন্য মুখও খুঁজছে। চাপ সম্ভবত আরও বাড়বে।