পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী ভরাডুবির পর বামপন্থীরা কী ভাবছেন? বিজেপি-বিরোধী বিকল্প হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছেন কি?
প্রশ্ন: নির্বাচন-পর্বে সিপিএম উঠতে-বসতে ‘বিজেমূল’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করত। কিন্তু নির্বাচনের ফল বার হওয়ার পর একমাত্র বিজেপিকে মূল শত্রু হিসাবে অভিহিত করে, এবং বলে যে, কেন্দ্রে এই মূল শত্রুকে পরাজিত করার জন্য তারা তৃণমূলের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ডিগবাজি বা ভোল বদলের কারণ কী?
শোভনলাল দত্ত গুপ্ত: নির্বাচনের ফলাফল আস্বাদন করার পর সিপিএম বুঝল যে, তাদের মূল্যায়ন পুরোপুরি ভ্রান্ত ছিল। সীতারাম ইয়েচুরির মতো নেতারা রাজ্য নেতাদের তুলোধুনা করলেন, এবং বললেন যে, প্রয়োজনে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সিপিএমকে অন্যান্য দলের সঙ্গে তৃণমূলকেও জোটে আনতে হবে। বিজেপিকে নির্বাচনে পরাজিত করার জন্য এই সার্বিক ও সর্বদলীয় ঐক্য অপরিহার্য।
কিন্তু, রাজ্যের নেতারা কি আদৌ সংশোধনী পদক্ষেপ করছেন? শুধুমাত্র আত্মসমালোচনার মধ্যে নিজেদের সীমিত রাখলে চলবে না। কেন্দ্রে নিছক পরিস্থিতিগত বাধ্যতা দু’টি দলকে কাছাকাছি আনতে পারে ঠিকই, কিন্তু রাজ্যস্তরে এই দু’টি দলের মধ্যে বিস্তর সমস্যা আছে এবং একটা জাদুদণ্ড বুলিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
প্ৰ: বিজেপিকে মূল শত্রু হিসাবে অভিহিত করে সিপিএম কি তা হলে সিপিআই-এমএল (লিবারেশন)’এর নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের মূল্যায়নই মেনে নিচ্ছে যে, বিজেপিকে গদিচ্যুত করাই এখন বৃহত্তম ও একমাত্র বক্তব্য?
উ: দীপঙ্করবাবু ভোট-পর্বে যে প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন, সেই ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র লক্ষ্য ছিল বিজেপি-বিরোধী সব ক’টি দলের মধ্যে ঐক্যসাধন। সিপিএম এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। কিন্তু নির্বাচনের পর সিপিআই-এমএল তাদের প্রচারমাধ্যমে, বিশেষ করে দেশব্রতী সংবাদপত্রে, নিয়মিত তৃণমূলের সমালোচনা করে চলেছে। তাতে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ও সিপিআই-এমএল (লিবারেশন) পরস্পরের কিছুটা কাছাকাছি আসতে পারে। এমনকি এই দু’টি দলের ভিতর এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতাও গড়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি ত্রিপুরায় বিজেপি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে উভয় দলই হাত মিলিয়েছে। সিপিএম ও লিবারেশন যদি বিজেপির ও তৃণমূলের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থেই সরব হয়, তা হলে উভয় পক্ষের পরস্পরের কাছাকাছি আসা অনেক সহজ হতে পারে।
সিপিএম মনে করেছিল যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলায় বিজেপির তেমন জনসমর্থন নেই। ফলে, ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী ভোট তারাই পাবে। এই ধারণার কোনও ভিত্তি ছিল না, নেইও। তার প্রমাণ, বিজেপির ৭৭টি আসন জয়। এই বাস্তবকে মাথায় রেখেই পা ফেলতে হবে।
প্র: ঠিক কী কী করার কথা বলছেন?
উ: প্রথমত, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে এমন একটি মজবুত আর অঙ্গীকারবদ্ধ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে যা সমর্থকদের কাছ থেকে প্রকৃত সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হবে। দ্বিতীয়ত, দলের পরিচালক এবং সমর্থকদের ভিতরে একটি ক্ষেত্র-জাল গড়ে তুলতে হবে, যা দলীয় আমলাতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করবে, এবং সমর্থক ও নেতৃত্বকে একযোগে একটি দৃঢ় ও মজবুত কর্তৃত্ব প্রদান করবে। তিন, জনপ্রিয়তাবাদ এবং আমলাতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে প্রশাসনের একটি বিকল্প মডেল উপস্থাপন করতে হবে, যার সঙ্গে জনগণের সংযোগ হবে প্রত্যক্ষ ও নিবিড়। চার, একটি বিকল্প সাংস্কৃতিক নীতি ও আদর্শ প্রণয়ন করতে হবে, যার লক্ষ্য ও কাজ হবে মতাদর্শ ও সৃজনের স্তরে বিজেপির বিরোধিতা করা।
এই চতুর্থ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক আবহে একমাত্র বামপন্থীরাই বিকল্প মতাদর্শ এবং বিকল্প সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হতে পারে। লক্ষ করবেন যে, নির্বাচনের আগে তৃণমূল থেকে অনেক নেতা দল পাল্টিয়ে বিজেপিতে যোগ দিলেও বামপন্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল না বললেই চলে। অর্থাৎ, একমাত্র বামপন্থীরাই বিজেপির বিরুদ্ধে আদর্শগত বিশ্বদৃষ্টি পেশ করতে পারেন। তার জন্য প্রয়োজন বামপন্থীদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলা ও সমবেত কর্মসূচির প্রণয়ন।
প্র: অনেকেই তো মনে করেন যে বর্তমানে বামপন্থীরা নরমপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটে পরিণত হয়েছেন?
উ: কমিউনিজ়ম-এর সঙ্গে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির দূরত্ব অনেকখানি। এখন পর্যন্ত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি গণতন্ত্রের কোনও পূর্ণাঙ্গ, প্রকৃত বিকল্প পেশ করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, সমাজতন্ত্রের যে মডেলটির বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, তা কয়েকটি ক্ষেত্রে সফল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ ও বিফল প্রমাণিত হয়। এই ব্যর্থতার অনেক কারণের মধ্যে একটি হল, কর্তৃত্ববাদী সমাজতন্ত্র, যা মানবতাবাদী সমাজতন্ত্রের বিপরীত। বাম দলের লক্ষ্য নিশ্চয়ই বিপ্লবী গণতন্ত্রের সর্বোত্তম প্রকাশের জন্য ঐকান্তিক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, যে গণতন্ত্র মানবতাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করবে এবং স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করবে জনগণের ভিতর। মার্ক্স এই স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার পর রোজা লুক্সেমবুর্গ, আন্তোনিয়ো গ্রামশ্চি, নিকোলাই বুখারিন— সবাই এই স্বপ্ন লালন করেন।
দুঃখের কথা হল, সেমিনারে-লেখায়-বিশ্লেষণে-বিতর্কে এই মানবীয় মার্ক্সবাদ নিয়ে বিস্তর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনা করা হয়। কিন্তু এগুলি কখনও প্রয়োগের বৃত্তে আসে না।
রাজনৈতিক ভাবে বামপন্থী নেতাদের মনে রাখতে হবে যে, বিজেপির মতাদর্শ ও বিশ্বদৃষ্টির বিরুদ্ধে তাঁরা কিন্তু ভিন্ন ও বিপ্রতীপ মতাদর্শ উপস্থাপন করতে সক্ষম।
সাক্ষাৎকার: শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত