মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা আমার কাছে যতটা প্রিয়, আমি নিশ্চিত পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের কাছেই তাঁর মায়ের ভাষা মধুরতম। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালিদের কাছে শুধু একটি দিন বা একটি বিশেষ দিনের ঘটনাপ্রবাহ নয়, আমাদের কাছে একুশ একটি আবেগ, একুশ একটি গর্ব, একুশ একটি ভালবাসার অনুভূতি।
আমার কাছে যাঁরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চান, তাঁদের আমি বলি— দুটো উৎসবে আমাদের দেশে আসুন। তা হলে বাংলাদেশকে বোঝা যাবে। কোনও বই পড়ে জানার প্রয়োজন নেই। প্রথমটি একুশে ফেব্রুয়ারি। অন্যটি পয়লা বৈশাখ। এই দুটো দিন বাংলাদেশে কাটালে অনুধাবন করা যাবে বাঙালির ইতিহাস, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বাঙালির প্রকৃত আবেগ।
ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটা খুব উত্তেজনাময় ছিল। সে সময়ে ঢাকায় অল্প কিছু দোকানে ফুল কিনতে পাওয়া যেত। ফুলের এতটা বাণিজ্যিকীকরণ হয়নি তখনও। এখন তো আমাদের দেশ থেকে ফুল বিদেশে রফতানি হয়! ফুলের দোকান খুব বেশি না থাকলেও বসন্ত শুরু হওয়ার কারণে স্কুলে এবং পাড়ার বিভিন্ন বাড়ির বাগানে এই সময়টায় প্রচুর ফুল ফুটত। বিভিন্ন বাড়ি থেকে ফুল তুলে এনে ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে স্কুলে আর পাড়ায় ছেলেমেয়েরা শুরু করত মালা আর স্তবক গাঁথার কাজ।
একুশে উপলক্ষে ঢাকা শহরের শহিদ মিনার এলাকায় আলপনা আঁকা হয় রাস্তায়। আগের দিন বিকেলের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাড়ি চলাচল বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীরা সারা রাত ধরে রাস্তায়, দেওয়ালে এবং শহিদ মিনারের বেদিতে আলপনা আঁকেন। বাংলা বর্ণমালা নিয়ে ক্যালিগ্রাফিও থাকে তার মধ্যে। সারা রাত জেগে আমরা ফুলের মালায় লিখতাম পাড়ার নাম, স্কুলের নাম। সূর্যোদয়ের আগে সবাই একটা জায়গায় জড়ো হয়ে খালি পায়ে রওনা দিতাম। পরনে সাদা-কালো পোশাক। লম্বা মিছিল, কিন্তু সুশৃঙ্খল। সারা পথ জুড়ে খালি গলায় গাইতাম, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...’। জাতীয় সঙ্গীতের পর এই গানটাই আমরা সবচেয়ে বেশি গাই।
ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একুশের আবেগটা একটু পাল্টে গেল। এখন আর নিজের হাতে মালা গাঁথা হয় না। ফাইল চিত্র।
বাবা আমাকে ওই স্বাধীনতাটা দিতেন। এই যে একটা গোটা দিন ধরে বছর দশেকের এক বালক দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াচ্ছে, মাতব্বরি করে বেড়াচ্ছে, শেষ রাতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটায় তিনি প্রশ্রয় দিতেন। আসলে সেই সময়কার সব বাবাই দিতেন। আমিও বাবা হিসাবে সন্তানদের স্বাধীনতা দিই না, তেমন নয়। দিই। কিন্তু তখন হয়তো বাবা-মায়েরা ছোট ছেলেমেয়েদের আর একটু বেশি স্বাধীনতা দিতেন।
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একুশের আবেগটা একটু পাল্টে গেল। এখন আর নিজের হাতে মালা গাঁথা হয় না। কারণ, এখন ফুলের মালা কিনতে পাওয়া যায় যে!
১৯৯৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ঘোষণা করল একুশে ফেব্রুয়ারি হবে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। তার পরের বছর থেকে দিনটা একটু বদলে গেল। শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস— দুটোই মিশে গেল আমাদের উদ্যাপনে। আজও তাই হয়।
বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ’৭১-এ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মূল শক্তি। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা। বাহান্নের ভাষা আন্দোলন তাঁর নেতৃত্বেই হয়েছিল। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ’৪৮-এর মার্চ মাসে জিন্নাসাহেব ঢাকায় গেলেন। ঘোষণা করলেন, উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। রেসকোর্স ময়দানের সেই সভায় বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখনই এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। সেই সময়ে জিন্নাসাহেবের অবস্থানের বিরুদ্ধে এটি অবিশ্বাস্য সাহসের পরিচয়। বঙ্গবন্ধুর তখন বয়স মাত্র ২৮ বছর। পর দিন ২৪ মার্চ জিন্না গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। ঘোষণাটি আবার করলেন। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে আবার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানালেন। ভাষা আন্দোলন তখনই বেগবান হল।
আমাদের কাছে একুশ একটি আবেগ, একুশ একটি গর্ব, একুশ একটি ভালবাসার অনুভূতি। — ফাইল চিত্র।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাজপথে ভাষার দাবির মিছিলে পুলিশ যখন গুলি চালাল, বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। কিন্তু কারাগারে থেকে ভাষা আন্দোলনে তিনিই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কিছু দিন পর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে আন্দোলন আরও শক্তিশালী করে তুললেন। ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শহিদ দিবসের বর্ষপূর্তিতে ভাষার দাবিকে বাংলার সর্বদলীয় দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাঙালির সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বাঙালি যে উদার এবং মুক্তমনা সেটির প্রমাণ কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলতেন। আর উর্দুতে মাত্র ৮ শতাংশ! উর্দু আসলে পাকিস্তানের সম্ভ্রান্ত, শাসক শ্রেণির ভাষা ছিল। সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও বাঙালি কখনওই বাংলাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়নি। তারা বলেছিল, বাংলাকে ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা’ করা হোক। এ থেকে বোঝা যায়, বাঙালি সব সময়েই কতটা মুক্তচিন্তক এবং পরমতসহিষ্ণু! সংখ্যাধিক্যের দৌরাত্ম্য নয়, বাঙালি চেয়েছে প্রতিটি মানুষকে গুরুত্ব দিতে, প্রতিটি মানুষের ভাষাকে গুরুত্ব দিতে। সেই কারণেই বাংলাদেশের ভাষা শহিদ দিবস এখন সারা বিশ্বে উদ্যাপিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে।
এই যে রাষ্ট্রপুঞ্জ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছিল একুশে ফেব্রুয়ারিকে, সেটাও কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই কৃতিত্ব। তাঁর দল যখন দেশের ক্ষমতায় থেকেছে, তখন একুশে উদ্যাপন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। একুশ আমাদের শিখিয়েছে পৃথিবীর সব মাতৃভাষাকে সম্মান জানাতে হবে। পৃথিবী থেকে প্রচুর ভাষা হারিয়ে গিয়েছে। এখনও যাচ্ছে। আসলে ভাষার বিবর্তন হয় তো। চর্চার অভাবে আস্ত ভাষাই আজকাল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে জনপদ। যারা নিজেদের ভাষার চর্চা করবে, তার মাতৃভাষা তত শক্তিশালী হবে। বেঁচে থাকবে।
দেশের বাইরে থাকলেও একুশে ফেব্রুয়ারি সব সময়েই উদ্যাপন করি। এখন তো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই পালিত হয়। কূটনীতিবিদ হিসেবে বিদেশে আমার প্রথম পদায়ন হয় ২০০৫ সালে। জেনিভায় রাষ্ট্রপুঞ্জে আমাদের মিশনে একুশের আয়োজন হয়েছিল। সীমিত পরিসরে আলোচনা সভা হয়েছিল। দেশের বাইরে আমার সেই প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারি।
এর পর যখন ম্যানিলায় পোস্টেড, আমার কন্যা তখন ওখানকার একটা স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির আগের দিন আমি স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানালাম, আমায় পর দিন ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হোক। বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওঁরা অবাক হয়েছিলেন। কিছুটা ভেবেচিন্তে বলেছিলেন, ‘‘আসুন।’’ আমি সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারি মেয়ের স্কুলে ভাষা নিয়ে একটা ‘প্রেজেন্টেশন’ দিয়েছিলাম। মাতৃভাষা নিয়েই। বাচ্চাদের বলেছিলাম, তোমরা মাতৃভাষায় কথা বলো। ইংরেজির জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে। নিজের ভাষা যে খুব সুন্দর, সেটা বুঝিয়েছিলাম।
ওই স্কুলে বেশির ভাগ বিদেশিরাই পড়ত। বাংলাদেশ, ভারত, কোরিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর— মূলত দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়া থেকে যাওয়া পরিবারের সন্তান সকলে। বাঙালি একমাত্র আমার মেয়েই ছিল। অবাঙালি ভারতীয় ছিল কয়েক জন। তার পরের বছর স্কুল কর্তৃপক্ষই আমাকে ডেকেছিলেন। পরিবর্তন দেখেছি। এখন কী ভাবে ছড়িয়ে গিয়েছে মাতৃভাষার এই উন্মাদনা, সেটা দেখেছি অন্যান্য দেশে গিয়েও। এখন তো অনেক অনুষ্ঠান হয়। বাংলাদেশি দূতাবাসে তো হয়ই, অন্যান্য দূতাবাসেও পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।
এ বছর কলকাতায় রয়েছি। এ শহরে নিজের ভাষায় কথা বলতে পারার আনন্দ উপভোগ করি সব সময়। বাংলার প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভালবাসাও আমাকে আনন্দ দেয়। প্রতি বছরের মতো বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন এ বছরও পালন করছে শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রভাতফেরি হল পার্ক সার্কাস মোড় থেকে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...’ গানটি গাইতে গাইতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড হয়ে ডেপুটি হাইকমিশন প্রাঙ্গণে শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এই শহিদ মিনারটি কিন্তু ঢাকার আদলেই তৈরি। বিকেলে উদ্যাপিত হবে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। যেখানে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ভাষার উপস্থাপনা থাকবে।
বাংলা ভাষা নিয়ে কথা হলেই সকলে বাবার লেখার কথা বলেন। আমার বাবা কিন্তু ভাষার সর্বজনীনতায় প্রবল ভাবে বিশ্বাস করতেন। আমিও সব ভাষার প্রতি গভীর ভাবে শ্রদ্ধাশীল। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা আমার কাছে যতটা প্রিয়, আমি নিশ্চিত পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের কাছেই তাঁর মায়ের ভাষা মধুরতম। সকল ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং একই সঙ্গে নিজের মাতৃভাষার জন্য গর্ব— এই দুইয়ের সমন্বয় পৃথিবীর সব ভাষা, সব সংস্কৃতি, সব ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। এটা আমি বিশ্বাস করি।
(নিবন্ধলেখক কর্মসূত্রে কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার। জন্মসূত্রে বাংলাদেশের খ্যাতনামা লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুত্র। মতামত ব্যক্তিগত)