International Mother Language Day

International Mother Language Day: শাসন তুচ্ছ করে মাথা তুলে দাঁড়াক বাংলা, ভাষা দিবসের প্রত্যাশা

ইংরেজি ভাষাকে ব্রাত্য না করেই বাংলা ভাষার ভিত ‘গড়ে তোলবার কাজে’ সমবেত হোক সরকার, নাগরিক সমাজ, সাধারণ মানুষ।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:৩৬
Share:

আমি কি ভুলিতে পারি: মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে চলছে প্রস্তুতি। রবিবার, অ্যাকাডেমির সামনে। ছবি: সুমন বল্লভ

দেশের স্বাধীনতার পর পর, ১৯৫০ এবং তার মাঝামাঝি সময়ে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুলশিক্ষা পদ্ধতি (যেগুলো বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পরিণত হয়েছে) প্রবলভাবে প্রাদেশিক বা রাজ্য শিক্ষা বোর্ডের (এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা) শিক্ষানীতি, কায়দা আত্মস্থ করতে চেয়েছিল। ‘‘কিন্তু ভাষা-ইতিহাসে পরিবর্তন হয়েছে পরবর্তীকালে। বাংলা মাধ্যমের স্কুলশিক্ষা পদ্ধতি এখন ইংরেজি শিক্ষা পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে চাইছে।’’—বলছিলেন শিক্ষাবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য।

Advertisement

আজ, সোমবার ভাষা দিবস। বিবর্তন বাংলা ভাষাকে বিপন্ন করে তুলেছে কি না, প্রতি বছরের মতো ভাষা দিবসের আলোচনায় সেই পুরনো প্রশ্নই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রশ্ন এটাও, ভাষা দিবস কি ক্রমশ না-বাঙালি হয়ে ওঠা একটি শ্রেণির মরসুমি উদ্যাপন হয়ে উঠেছে?।

এ ক্ষেত্রে নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করছেন ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন তিনি নিয়ম চালু করেছিলেন, সমাজবিজ্ঞানের কোনও পড়ুয়া বাংলাতেও গবেষণাপত্র জমা দিতে পারবেন। সুরঞ্জনবাবুর কথায়, ‘‘তবে তা নিয়ে অনেকেরই অনীহা ছিল। কারণ, বাংলার তুলনায় ইংরেজি ভাষায় গবেষণাপত্র জমা দিলে তার মর্যাদা বেশি হয় বলে ধারণা রয়েছে! ফলে নিয়ম প্রণয়ন, তা পালনের দায় সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের উপরেও বর্তায়। তাই বাংলা-ইংরেজি দুটোই শেখা হোক।’’

Advertisement

এ ক্ষেত্রে অবধারিত ভাবে চলে এসেছে মাস দুয়েক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ঘোষণা— সরকারি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা জানাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যদিও ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে সরকারি কাজকর্মের মাধ্যম হয়ে ওঠে ইংরেজি ভাষা। ইংরেজি শাসনের আগে আবার অন্য ভাষার প্রাধান্য ছিল। তাই রামমোহন রায়-সহ সে সময়ের বিদ্বজ্জনেদের ফারসি ভাষায়, আবার বিদ্যাসাগরের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি ছিল।

প্রাক্তন আইপিএস তুষার তালুকদার জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় সদিচ্ছা প্রকাশ পেলেও বাস্তবে তা কার্যকর করা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘ইংরেজি ভাষা শুধুই ঔপনিবেশিক ভাষা নয়। ইংরেজি আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক ভাষা।’’ ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্য আবার বলছেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষায় পরিবর্তন আসবে, কিছু অনভিপ্রেত উপাদান জড়িয়েও যেতে পারে। এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তাতে ভাষার ক্ষতি হবে কেন?’’

একই বক্তব্য অন্যদেরও। সৌরীনবাবু যেমন বলছেন, ‘‘যে কোনও ভাষা থেকে দু’হাতে ঋণ গ্রহণ করলে ভাষা লাভবানই হয়। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত অক্সফোর্ড অ্যাডভান্সড লার্নার ডিকশনারির একটি সংস্করণের বিশেষ সাপ্লিমেন্ট ছিল, ‘ওয়ার্ডস অব ইন্ডিয়ান অরিজিন’। অর্থাৎ তা ছিল ভারতীয় ভাষা থেকে গৃহীত শব্দ।’’

বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে এই সংশয়-আস্থার পারস্পরিক দোদুল্যমানতার প্রসঙ্গে বিদ্বজ্জনেদের একাংশ আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের বিমলা-নিখিলেশের কথোপকথনের অংশটুকু মনে করিয়ে দিচ্ছেন। যেখানে বিমলা বলছেন,—‘স্বামীকে (নিখিলেশ) বললুম, বিলিতি জিনিসে তৈরি আমার সমস্ত পোশাক পুড়িয়ে ফেলব।

স্বামী বললেন, পোড়াবে কেন? যতদিন খুশি ব্যবহার না করলেই হবে।...

কেন এতে তুমি বাধা দিচ্ছ?

আমি বলছি, গড়ে তোলবার কাজে তোমার সমস্ত শক্তি দাও, অনাবশ্যক ভেঙে ফেলবার উত্তেজনায় তার সিকি পয়সা বাজে খরচ করতে নেই।’

তাঁদের বক্তব্য, একই ভাবে ‘ইংরেজি না শেখার বিনিময়ে মাতৃভাষা বাংলা শিখব’— এটা সমাধান নয়। বরং ইংরেজি ভাষাকে ব্রাত্য না করেই বাংলা ভাষার ভিত ‘গড়ে তোলবার কাজে’ সমবেত হোক সরকার, নাগরিক সমাজ, সাধারণ মানুষ। যাতে বাংলা ভাষা পরবর্তী প্রজন্মে বাহিত হয়ে সঞ্জীবনী সুধা জোগায় স্বাভাবিক ভাবেই। যেমন ভাবে গাছের শিকড় জলের অভিমুখে ছুটে যায় বার বার।

সুরঞ্জনবাবুর কথায়, ‘‘কোনও শাসকবর্গ বাংলা ভাষাকে অবদমিত করার যখনই চেষ্টা করেছে, তখনই তার পাল্টা আন্দোলন তৈরি হয়েছে, তার সব থেকে বড় প্রমাণ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ।’’

তাই অতীতে যেমন যাবতীয় শাসন তুচ্ছ করে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল বাংলা, আগামী দিনেও তেমন ভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াবে এই ‘বৃষ্টিভেজা বাংলা ভাষা’! প্রত্যাশা সবারই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement