সুদের হার বাড়লেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে, সেই ভরসা নেই
Inflation

বিপদ ঘনাচ্ছে দুনিয়া জুড়ে

ভারতে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে, ভোগ্যপণ্যের সূচকের নিরিখে মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাত শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

পরন্তপ বসু

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩৩
Share:

গোটা দুনিয়াতেই একটি নতুন সমস্যার কালো মেঘ ঘন হয়ে উঠছে— ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। ভারতে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে, ভোগ্যপণ্যের সূচকের নিরিখে মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাত শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতেও এই হার ছিল ছয় শতাংশের বেশি। বুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিক্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকার ভোগ্যপণ্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৮৯ শতাংশ। অফিস অব ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্স দেখাচ্ছে যে, বিলেতে এই হার ৬.২ শতাংশ; আবার ইউরোস্ট্যাট পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে, ইউরোপে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬.২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এই হার পশ্চিমি দেশগুলির ধার্য করা লক্ষ্যমাত্রা দুই শতাংশের চেয়ে বেশি। অন্য দিকে, সে দেশগুলিতে বেকারত্বের হার আবার অস্বাভাবিক রকম কম। একই সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকায় শ্রমিকদলের ৩.৮ শতাংশ বেকার। বিলেতেও এই হারটি আমেরিকার কাছাকাছি। অর্থাৎ, জিনিসপত্রের দাম যত বাড়ছে, বেকারের সংখ্যা তত কমছে। অনেক চাকরির পদ শূন্য থাকছে শ্রমিকের অভাবে।

Advertisement

১৯৫৮ সালে নিউ জ়িল্যান্ডের এক অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ফিলিপ্স একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। প্রবন্ধটির মূল প্রতিপাদ্য ছিল যে, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বেকারত্বের একটি বিপরীতমুখী সম্পর্ক আছে। দেশের অর্থনীতি যখন চাঙ্গা, ভোগ্যপণ্যের যখন প্রচুর চাহিদা— দোকানে, কলকারখানায় তখন শ্রমেরও চাহিদা বাড়বে। সঙ্গে মজুরি বাড়বে, জিনিসপত্রের দামও বাড়বে, আর বেকারত্ব হ্রাস পাবে। মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের এই বিপরীতমুখী প্রবণতাটি অর্থনীতির তত্ত্বে শিক্ষক ফিলিপ্স-এর নাম অনুযায়ী ‘ফিলিপ্স রেখা’ হিসেবে পরিচিত। সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি এই ফিলিপ্স রেখাটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। যখন অর্থব্যবস্থা রমরমিয়ে চলে এবং অতিবৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়, তখন বাজারে চাহিদা কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কেও সুদের হার বাড়ে, ঋণ মহার্ঘতর হয়। তার ফলে লোকজন কেনাকাটা কম করেন। বিনিয়োগও হ্রাস পায়, কারণ বিনিয়োগ করতে গেলে টাকা ধার করতে হয়। অন্য দিকে, যখন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা ঘনীভূত হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার কমিয়ে অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা করতে সচেষ্ট হয়। সুদের হার বাড়িয়ে-কমিয়ে অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিটির পথনির্দেশ করেছিলেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জন টেলর। তাঁর নাম অনুযায়ী এই সুদ নীতিটি অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বে ‘টেলর রুল’ বা টেলর বিধি নামে পরিচিত।

আমেরিকার শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারাল রিজ়ার্ভ দিনকয়েক আগেই সুদের শীর্ষ হারটি ০.২৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। ২০১৮ সালের পর সে দেশে এই প্রথম সুদের হার বাড়ল। বিলেতে ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডও শীর্ষ হারটি বাড়িয়েছে ০.৫ থেকে ০.৭৫ শতাংশ। গত চার মাসের মধ্যে ইংল্যান্ডে এই তৃতীয় বার সুদের হার বাড়ল। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অবশ্য সুদের হার এখনও বাড়ায়নি।
জন টেলরের নির্দেশিকা অনুযায়ী এই মুহূর্তে সুদের হার বাড়ানো কি সমীচীন? মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে এই মুহূর্তের মূল্যস্ফীতি কিন্তু অধিক চাহিদার জন্য নয়। কোভিডের জন্য সাপ্লাই চেন বা জোগান শৃঙ্খলের সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তেলের দাম বৃদ্ধিতে অবস্থা আরও জটিল হয়েছে। ফেব্রুয়ারির পরিসংখ্যানে আমেরিকার উৎপাদন মূল্যসূচক বেড়েছে দশ শতাংশ। সুতরাং, সামগ্রিক অর্থব্যবস্থায় এই মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদনজনিত সমস্যা থেকে উদ্ভূত, চাহিদাবৃদ্ধির জন্য নয়। মজার ব্যাপার হল, পশ্চিমি দুনিয়াতে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বেকারত্ব হ্রাস পাচ্ছে ঠিক ফিলিপ্স-এর রেখাটি মেনেই। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্বের এই ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের সঙ্গে চাহিদা বৃদ্ধির কোনও সম্পর্ক নেই। বেকারত্বের হার কম হওয়ার কারণ, মানুষ কাজ খুঁজছেন না। যার মূল কারণ কোভিড। এর সঙ্গে প্রৌঢ় লোকের সংখ্যাও বেড়ে যাওয়াতে অনেক মানুষ অবসর নেওয়াই প্রকৃষ্ট পন্থা মনে করছেন।

Advertisement

এ বারে ভারতের দিকে তাকাই। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সম্প্রতি জানাল যে, এই মুহূর্তে সুদের হার না বাড়ানো হলেও ব্যাঙ্ক তার অবস্থান পরিবর্তন করছে— আর্থিক বৃদ্ধি নয়, অতঃপর ব্যাঙ্ক মূল্যস্ফীতির সমস্যাকেই গুরুত্ব দেবে। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.০৭ শতাংশ, মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৯৫ শতাংশ। মার্চের আগের আট মাসে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছিল ঠিকই, তবে এখন যতখানি বিপদ অনুভূত হচ্ছে, আগে তা হয়নি। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পিছনে খাদ্যপণ্যের ভূমিকা সর্বাধিক। তার উপর রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এবং পণ্য সরবরাহের সমস্যা। পশ্চিমি দুনিয়া যেখানে সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে, সেখানে ভারতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কত দিন তা অপরিবর্তিত রাখতে পারবে, সেই প্রশ্নটি ক্রমশ প্রবলতর হচ্ছে।

টেলরের সুদনীতি অনুসরণ কতটা যুক্তিযুক্ত? যদি এই সুদনীতি কার্যকর হয়, তা হলে সুদের হার আর মূল্যস্ফীতির হার বিপরীত পথে চলবে। পরিসংখ্যান কিন্তু তা বলে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুদের হার আর মূল্যস্ফীতির হারের মধ্যে কোনও পরিষ্কার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা মনে রাখতে হবে যে, সুদের হার নির্ধারিত হয় ঋণের বাজারের চাহিদা আর জোগানের যুগ্ম প্রভাব থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক শীর্ষ সুদের হার পরিবর্তন করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলে বিনিয়োগকারীদের আগামী দিনের সুদের হার সম্বন্ধে প্রত্যাশা অনাবশ্যক ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। এর ফলে দেনার বাজারে ফাটকাবাজির দরুন অস্থিরতা বাড়বে, যার সামগ্রিক ফল সুদূরপ্রসারী হবে বলেই মনে হয়।

সঙ্গে এটিও মনে রাখা দরকার যে, ফিলিপ্স রেখাটি কিন্তু এক জায়গায় বসে নেই। বাজার যদি মনে করে যে, ভবিষ্যতে মূল্যবৃদ্ধি কমবে, রেখাটি সে ক্ষেত্রে নিম্নমুখী হবে। আমেরিকার ফেডারাল রিজ়ার্ভের সুদের হার বাড়ানোর পিছনে একটি উদ্দেশ্য অবশ্য কাজ করছে। তা হল বাজারের মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের শীর্ষহারটি বাড়িয়ে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, এই বলে নাগরিকদের আগাম নির্দেশিকা দিচ্ছে যে, জিনিসপত্রের দাম খুব শীঘ্রই কমে যাবে, যাতে ফিলিপ্স রেখাটি নীচের দিকে সরে যায়। এই ধরনের নির্দেশিকা কিন্তু বাস্তবে খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না— কারণ, ভবিষ্যৎ মূল্যবৃদ্ধি সম্বন্ধে এক জনের ধারণার সঙ্গে অন্য এক জনের প্রত্যাশা না-ই মিলতে পারে।

মূল্যবৃদ্ধির উৎস অনুসন্ধান না করে টেলর সাহেবের রীতি অনুযায়ী সুদের হার বাড়ালে অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে। যখন ক্ষুদ্র এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলি অতিমারির আঘাত অতিক্রম করে সদ্য মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, সুদের হার বেড়ে গেলে, এই সংস্থাগুলি ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের উচিত সুদের হার পরিবর্তন না করে, মুদ্রা সরবরাহের উপর বেশি নজর রাখা। মূল্যস্ফীতি যদি অতিরিক্ত চাহিদার কারণে হয়, মুদ্রা সঙ্কোচনের পথ নেওয়া উচিত। যদি সরবরাহের সমস্যা থেকে মূল্যস্ফীতি হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সে ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত সংস্থাগুলিকে সরাসরি অনুদান অথবা কম সুদে ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করাই বিধেয়। এই কাজটি করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন।

অর্থনীতি বিভাগ, ডারহাম ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement