নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় এক চকলেটের বিজ্ঞাপন ‘কুছ খাস হ্যায়’। ২০২১-এ এর পুনর্নিমাণে লক্ষণীয় ভাবে বদলে গেল পাত্রপাত্রীদের লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা। গত শতকের বিজ্ঞাপনটিতে ক্রিকেট মাঠে ব্যাট করছিল এক ব্যাটসম্যান। দর্শকাসনে একটি লম্বা চুলের মেয়ে, সম্ভবত তার গার্লফ্রেন্ড। ব্যাটসম্যান উত্তেজক ছক্কা হাঁকিয়ে জয়সূচক রান করলে উল্লসিত হয়ে ওঠে মেয়েটি, এবং নাচতে নাচতে ঢুকে পড়ে মাঠে। পুনর্নির্মিত বিজ্ঞাপনটিতে ক্রিকেট ম্যাচটা মেয়েদের, আর ভিড়ে-ঠাসা দর্শকাসনে বসে এক পুরুষ, মহিলা ব্যাটারের বন্ধু কিংবা বয়ফ্রেন্ড।
এই বদলটা সমাজের অন্তত এক শ্রেণির মানসিকতার বদল তো নিশ্চয়ই। হয়তো মেয়েদের ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তারও সূচক। এই তো মেয়েদের আইপিএল হতে চলেছে ২০২৩ সাল থেকে। এর ফলে জনপ্রিয়তায় ফুলেফেঁপে উঠতে থাকা মেয়েদের ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণের পথ প্রশস্ত হল নিশ্চয়ই। কিন্তু, শুধুই কি বাণিজ্য? এ আসলে এক বদলে যাওয়া সমাজের খণ্ডচিত্র।
পরিবর্তন-বিন্দুটা হল ২০১৭-র মেয়েদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। যেখানে মিডিয়ার মাতামাতির প্রায় বাইরে থেকেই ফাইনালে ওঠে ভারতের মেয়েরা। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে হরমনপ্রীত কউরের অপরাজিত ১৭১-এর তুলনা হয় ১৯৮৩-তে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিলদেবের মহাকাব্যিক ইনিংসের। দেশ জুড়ে পরিচিত হন মহিলা ক্রিকেটাররা। অবশ্য ভারতের মেয়েরা ২০০৫-এর বিশ্বকাপেও ফাইনালে উঠেছিলেন। সেটা তো ‘কুছ খাস’ হয়ে ওঠেনি তখন! আসলে ওই বছর সব খেলা দেখায়নি টিভিতে। সোশ্যাল মিডিয়াও তখন হামাগুড়ি দিচ্ছে। সমাজের মানসিকতায় একটা ছোট্ট ধাক্কা দিতে এ সবের অবদান অস্বীকার করবে কে! তাই ক্রিকেট-পাগল দেশেও জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসতে মেয়েদের ক্রিকেটকে অপেক্ষা করতে হয় আরও এক যুগ।
ইতিমধ্যে অবশ্য ২০১৬ সালের জনপ্রিয় হিন্দি টিভি সিরিজ় তমন্না এই বদলের সলতেটা পাকিয়ে রাখতে খানিক সাহায্য করেছে। ধারা সোলাঙ্কি নামে একটি মেয়ের ক্রিকেটার হয়ে উঠার আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নপূরণের জন্য তার ত্যাগ স্বীকার, এবং স্বপ্নের বাস্তবায়নের দিকে তার যাত্রাপথের গল্পকথা এটি। সব মিলিয়ে তাই সমাজও প্রস্তুত হচ্ছিল একটু করে।
ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলিও ছেলেদের আর মেয়েদের ক্রিকেটকে ভিন্ন চোখে দেখে এসেছে। ২০১৬ সালে পুরুষদের সঙ্গে মেয়েদেরও টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর বসে ভারতে। আইসিসি সব দেশের পুরুষ খেলোয়াড়দের ভারতে আসার জন্য বিজ়নেস ক্লাসের বিমান টিকিট দেয়, কিন্তু মহিলা খেলোয়াড়দের জন্য বরাদ্দ হয় ইকনমি ক্লাসের টিকিট। এ সবের কারণ হিসেবে ‘আয়’ করার ক্ষমতার তারতম্যকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে এত দিন। কিন্তু মেয়েদের ক্রিকেটের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পরীক্ষা কি সত্যিই হয়েছে এত দিন? ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ ক্রিকেট লিগে মেয়েদের আলাদা লিগ শুরু হওয়ার পরে সমীকরণ কিন্তু বদলে গিয়েছে অনেকটাই। অস্ট্রেলিয়ায় দর্শক-সংখ্যার নিরিখে মেয়েদের বিগ ব্যাশ এখন জনপ্রিয়তায় চার নম্বরে।
অন্যান্য খেলার চালচিত্রও অনেকটা এমনই। আমেরিকায় ২০১৯-এর মেয়েদের বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালের টিভি দর্শক ছিল ২০১৮-র ছেলেদের বিশ্বকাপের থেকে ২২ শতাংশ বেশি। টেনিসে ২০১৩-র ইউএস ওপেনের ফাইনালে সেরেনা উইলিয়ামস আর ভিক্টোরিয়া আজ়রেঙ্কার খেলার টিভি রেটিং ছিল ৪.৯, ও-দিকে পুরুষদের ফাইনালে রাফায়েল নাদাল আর নোভাক জোকোভিচের খেলার রেটিং ছিল মাত্র ২.৮। কে বলতে পারে, ক্রিকেটেও হয়তো লুকিয়ে রয়েছে অনেক বিস্ময়। শুধুমাত্র প্রকাশের অপেক্ষায়।
সত্তরের দশকে মহিলা টেনিস খেলোয়াড়দের পুরস্কারের অর্থ ছিল পুরুষদের এক-চতুর্থাংশ। প্রতিবাদে বিলি জিন কিং-এর নেতৃত্বে হয় ঐতিহাসিক আন্দোলন। স্থাপনা হয় উইমেন্স টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের। পুরুষদের সমান পুরস্কার অর্থ না দিলে ১৯৭৩-এর ইউএস ওপেন খেলতে অস্বীকার করলেন বিলি জিন। মেয়েদের টেনিসে এই কাঙ্ক্ষিত ‘সমতা’ পুরোটা আসতে অবশ্য কেটে যাবে আরও চৌত্রিশ বছর।
স্মৃতি কিংবা মিতালিরা অবশ্য বিপ্লবের পথে হাঁটেননি। তাঁরা খেলে গিয়েছেন। সেই সঙ্গে করেছেন আবেদন-নিবেদন। ২০১৭-র বিশ্বকাপের পর থেকেই মিতালি রাজ বলে আসছেন মেয়েদের আইপিএল-এর কথা। এমনকি ইতিমধ্যে নানা মহল থেকে বার বার উঠেছে পুরুষ আর মহিলা ক্রিকেটারদের মিশ্র টিমের কথাও।
যা-ই হোক, জনপ্রিয়তার রোলারকোস্টারে চড়ার জন্য মহিলা ক্রিকেটের হয়তো আজ আর পুরুষ ক্রিকেটের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। মিতালি রাজের অবসর গ্রহণ উপলক্ষে সমাজ জীবনে যে পরিমাণ হইচই হয়, তা শীর্ষস্থানীয় পুরুষ খেলোয়াড়ের অবসরের কথা মনে করায়। আজ মেয়েদের ক্রিকেট অনায়াসে হয়ে উঠেছে টিভি সিরিজ় কিংবা বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু। মহিলা ক্রিকেটাররা আজ বিলাসবহুল গাড়ির বিজ্ঞাপনে বলিউড মহাতারকার চালানো গাড়ির সওয়ারি। হয়তো বা প্রকৃত অর্থেই। সেই বিজ্ঞাপনে দেখি, এক ক্রিকেটার শাহরুখ খানকে অনুরোধ করছেন মেয়েদের ক্রিকেট টিম তৈরি করতে। মেয়েদের আইপিএল-এর ঘোষণা তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। বোঝাই যাচ্ছে, ক্ষেত্রটা তাই প্রস্তুত ছিলই। সমাজের এক অনিবার্য বদলের প্রেক্ষাপটে। ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’ সেখানে ছোটে সমাজের মননকে সঙ্গে নিয়েই। স্থবিরতার আস্তরণ সরিয়ে সমাজও ক্রমে একটু একটু করে উপলব্ধি করতে থাকে, ‘গেম লেড়কে লেড়কিয়োঁ কা নেহি, স্ট্যামিনা কা হোতা হ্যায়!’ ক্রিকেট তো সেখানে একটা প্রকাশভঙ্গি মাত্র। ধারা সোলাঙ্কিদের ‘তমন্না’ (‘ইচ্ছা’) আর ‘মনোবল’ এই লড়াইকে বিস্তৃত করতে থাকে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। দশ দিকে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।