সাতাত্তর বছর স্বাধীন সার্বভৌমত্ব ভোগ করে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এ দেশ, অষ্টাদশ লোকসভা গঠনের মুখে। গত দশ বছরের অভিঘাতে নতুন লোকসভা গঠনের নির্বাচনের ফল বেরোবে কাল, শোনা যাচ্ছে নানা অজানা আশঙ্কার কথা। একমাত্রিক, একধর্মীয় ভারত গঠনের প্রকল্প থেকে এটাই সংবিধান-নির্ধারিত বহুদলীয় পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা আগলে রাখার শেষ লড়াই। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী শক্তি আর কর্পোরেট পুঁজির মেলবন্ধনে গণতন্ত্র বিপন্ন। গণতন্ত্র এক বিরাট পরীক্ষার সামনে। ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’-র আধিপত্য আর আস্ফালন অনেকটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণাকে ঘেঁটে দিতে পেরেছে।
এই আশঙ্কার সামনে মনে রাখা দরকার, পশ্চিমি উদারবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদলে ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়নি। পশ্চিমের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি বাজার অর্থনীতির প্রয়োজনে উদার সমাজব্যবস্থার ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছে, যেখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সমানাধিকারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইন্ধন পেয়েছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে তার সংঘাত এ ভাবেই সামলে দেওয়া গিয়েছে। এই পশ্চিমি মডেল কিন্তু গোটা বিশ্বের সভ্যতার মডেল হয়ে ওঠেনি। পিছিয়ে থাকা অনুন্নত দেশগুলোর কাছে গণতন্ত্রের মানে ছিল— অবদমিত শ্রেণির স্বপক্ষে এক রাষ্ট্রব্যবস্থা। শোষণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র যেন একটা নৈতিকতার দিকদর্শন।
অর্থাৎ, এশিয়া আফ্রিকার গণতান্ত্রিক গতিপথ একেবারে ভিন্ন ধারায় এগিয়েছে। তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় কোনও উদার সমাজের ভিত্তি ছিল না। সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতার কোনও প্রেক্ষাপটই ছিল না, যা গণতান্ত্রিক পরিসরের প্রাক্-কথন হতে পারে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণিচেতনা প্রসূত গণতন্ত্রের ধারণা বা অনুশীলন এ সব দেশে কষ্টকল্পনা। জাতীয়তাবাদী চেতনাই বিশ্বের এ-প্রান্তের দেশগুলোর গণতন্ত্রের ভিত। গণতন্ত্রের মন্ত্রেই উদার গণতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক শাসনকে প্রতিহত করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এক নয়া গণতন্ত্রের ধারণা এ ভাবে শিকড় খুঁজে পেয়েছে এই দেশগুলোয়, ভারত তার ব্যতিক্রম নয়।
গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় চেতনা আর আনুগত্য ঔপনিবেশিক অধ্যায়ে জাতীয়তাবাদে সংযোজিত হলেও, পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র নির্ভর করেছে প্রাক্-আধুনিক জাতিগোষ্ঠী সংহতি, সমন্বয় আর আধুনিক মূলধন লগ্নির উপর। কাস্ট, ক্যাপিটাল— এই দুই নির্ধারকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে কমিউনাল। অর্থাৎ ‘থ্রি সি’ ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্র। বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক আর সামাজিক বিন্যাসের পাশাপাশি এসেছে আদিসত্তা, ধর্মীয় সত্তাভিত্তিক রাজনৈতিক মেরুকরণ আর সংহতি। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে জাতি সমন্বয় আর সংহতি নির্বাচনী বাধ্যবাধকতা সূত্রে ভারতীয় গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। এর পাশাপাশি ধনতান্ত্রিক বিকাশ ভারতীয় গণতন্ত্রকে এক অগ্রবর্তী যাত্রা দিয়েছে। সেখানে এই ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের ভূমিকা বিরাট— এক অর্থে ভারতীয় গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছে সেই বৃহত্তর জনতা, অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত গরিব, নানাবিধ কায়িক পরিশ্রমে যুক্ত শ্রেণি, যারা আবার নানা জাতি-জনজাতিতে বিভক্ত। নির্বাচনী ভ্রাতৃত্বের তাগিদ জাতি-জনজাতি বিভাজনকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে।
আবার, প্রাথমিক গণতন্ত্রীকরণের ‘টপ-ডাউন’ চরিত্রের মতোই একসূত্রে বাঁধা রয়েছে আর্থিক উন্নয়নের মডেল। অবধারিত ভাবে উপর থেকে পরিচালিত এই নির্বাচনী গণতন্ত্র জন্ম দিয়েছে গ্রামীণ বিত্তশালী শ্রেণি। সাবেক সামন্তশ্রেণির আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাস আর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আন্তঃজাতি সমন্বয় জরুরি। দলিত শ্রেণির রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সেটাই সূত্রপাত। নেহরু-উত্তর ভারতে ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান দলিত আর পিছিয়ে পড়া অবদমিত শ্রেণির গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের এক চমকপ্রদ দিকনির্দেশ করে। এই মোড় ঘোরানো সমাজগঠনের সহযোগী পদক্ষেপ ছিল নানা অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীকরণ। প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রীকরণের বদলে ক্ষমতার চরম কেন্দ্রীয়করণ অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ঘটে জরুরি অবস্থায়। জরুরি অবস্থার অভিঘাতে সাবেক ভারতীয় সমাজ-কাঠামোর গোষ্ঠী বিভাজন আর আঁতাঁত নতুন ধারায় বিবর্তিত হয়। এই গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় বিবাদ-আঁতাঁতের ক্রমবিবর্তনই ভারতীয় গণতন্ত্রের স্তম্ভ।
জরুরি অবস্থার পরবর্তী সময়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বরূপ তৈরি হয় রাজ্যস্তরীয় প্রাদেশিক দলের রমরমা। সংখ্যাতত্ত্বের হিসাব ছাড়াও মধ্যবর্তী গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সেই শুরু। গ্রামীণ সমাজ যত বেশি করে মূলধনি আওতায় আসতে থাকে, তত বেশি সাবেক উচ্চ জাত-দলিত জোট দুর্বল হতে থাকে। নিশ্চিত ভাবে ভারতীয় অর্থনীতি বেরিয়ে আসতে থাকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন মডেল থেকে।
নব্বইয়ের দশক শুধুমাত্র বিশ্বায়ন আর উদার অর্থনীতির দশক নয়, ওই একই সময়ে ভারতীয় সমাজ প্রত্যক্ষ করে বহুজন-পিছড়ে বর্গের ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের রসায়নে মূলধনি সংযোগ ছাড়াও অর্থপূর্ণ মাত্রা এনে দেয় সর্বভারতীয় স্তরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সক্রিয় রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের এই বদলের সঙ্গে সামনের সারিতে উঠে আসে ধর্মীয় পরিচয় সত্তার রাজনৈতিক প্রয়োগ। জাতীয়তাবাদ গঠনে ধর্মীয় আত্মসাতের চোরাস্রোত প্রাক্-স্বাধীনতা দশকগুলোয় থাকলেও ধর্মীয় সত্তার আগ্রাসী রাজনীতিকরণ সম্পাদিত হয় এই সময়ে। এই দশকে আমরা সাক্ষী থাকি ভারতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় হিন্দুত্বের সূত্র ধরে এক নয়া জাতীয়তাবাদের, যা আবার বাহ্যত বেখাপ্পা বিশ্বায়নের মূল সুরের পাশে।
এক দিকে শ্রম, মূলধন, তথ্য, প্রযুক্তির অবাধ আদান-প্রদান, অন্য দিকে সনাতন ধর্মীয় সত্তার উত্থান। রক্ষণশীল, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির পালে হাওয়া লেগেছে এই বিশ্বায়িত নয়া উদার পর্বে। দ্রুত বিশ্বায়নের যুগে আদি সত্তায় (ভারতের প্রেক্ষাপটে, ধর্মীয়) আকর্ষণ তৈরি হয়। প্রশ্ন হল, ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিতে বাস্তব সঙ্কটকে সাজিয়ে এই যে রাজনৈতিক মোবিলাইজ়েশন তা কতটা জুতসই।
ধর্মীয় আবেগ নির্ভর রাজনৈতিক সক্রিয়তার দুটো আলাদা মাত্রা আছে। একটা সমষ্টিগত, অন্যটা ব্যক্তিশৈলী নির্ভর। স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরে শাস্ত্রীয় সামাজিক আচার-ব্যবহারের বৈষম্যের বাধা দূরে সরিয়ে আন্তঃজাতি বা সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী সমন্বয় আর ক্ষমতায়নের রসায়ন ভারতীয় গণতন্ত্রকে এক বিশেষ চরিত্রে চিহ্নিত করে। এই গণতন্ত্রকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যায় মূলধন লগ্নির বিকাশ আর গ্রামীণ প্রসার। এর পর লগ্নির অবাধ অনিয়ন্ত্রিত বিশ্বায়নের পর্বে উঠে আসে অতি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। কোন সামাজিক বিন্যাসে স্ববিরোধী দুই ধারা সর্বজনীন বিশ্বায়ন আর স্বাতন্ত্র্য সত্তা একই সঙ্গে উদ্যাপিত হতে পারে? এই নয়া উদার সময়ে নির্দিষ্ট ভাবে কোন শ্রেণি সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত আর সক্রিয়? সেই শ্রেণির সংহতিই একমাত্র এই নয়া ব্যবস্থাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী জাতীয় পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির। নেহরুর ভারতে বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক শিল্প, প্রতিষ্ঠান বিকাশে গড়ে উঠেছিল শিক্ষিত পেশাদার মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা উন্নয়নশীল ভারতীয় মডেলের মূল প্রবক্তা। টপ-ডাউন মডেল সৃষ্ট এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমে বিভাজিত হতে থাকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বিকাশ-অর্থনীতি পিছু হটার সঙ্গে। মেট্রোনির্ভর মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে ছোট শহর বা গ্রামীণ মধ্যবিত্তের ফারাকগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। উন্নয়নমূলক রাষ্ট্রের উদার অর্থনীতির হাতছানিতে প্রথমে আকৃষ্ট হয় মেট্রো মধ্যবিত্ত। পুরনো বাঁধাধরা জীবিকাযাপন ছেড়ে তারাই হয়ে ওঠে নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তার সঙ্গে ছোট শহর আর গ্রামীণ ভারতে জারিত হয় মেট্রো-গ্লোবালমুখী উচ্চাশা-আকাঙ্ক্ষা। এই দুই অংশের মিশেলে তৈরি হয় নয়া বিশ্বায়িত ভারতের নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি। হিন্দুত্ব আদর্শের সেটাই মূল সামাজিক ভিত্তি। প্রশ্ন হল, আদৌ কি স্থিতিশীল এই ভিত্তি?
নয়া উদারনীতি অর্থনীতিতে নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির নিহিত স্বার্থ-বিভাজন রেখা আগলে রেখেছে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার উত্থান। অনির্দিষ্ট কালের জন্য তা কাজ করে যেতে পারে না। মানুষ তো শুধু বায়বীয় অনুভবে বাঁচে না। দৈনন্দিন জাগতিক অস্তিত্বের অভিঘাতে অনুভবে বিবর্তন আসে। তা ঠেকিয়ে রাখতে পারে একমাত্র ব্যক্তিশৈলী। একঘেয়েমি, হতাশা, বাস্তব জীবনের সঙ্কট থেকেই অপ্রচলিত মুখের আবির্ভাব হয়। এই ব্যক্তিশৈলী-নির্ভর কার্যকারিতা কিন্তু সমাজ-সময়ের প্রেক্ষিতে সীমাবদ্ধ। বৃত্তাকারে ফিরে আসে একঘেয়েমি।
নয়া মধ্য শ্রেণির উত্থানের আড়ালে চলে যাওয়া বৃহত্তর, নানা পরিচিতি-স্বার্থে বিভক্ত ভারতীয় সমাজ এই সমকালীন মডেলের কাছে অস্বস্তির বড় কারণ। আধুনিকতা কোনও মায়া বা বিভ্রমকে চিরকাল ধরে রাখতে দেয় না। গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিয়ে ‘বাস্তব আশঙ্কা’কে ভারতীয় সমাজ তাই আশ্বস্ত করতে পারে। রুখে দিতে পারে এই একমুখী, একমাত্রিক আগ্রাসী প্রকল্প। ভারতীয় গণতন্ত্র স্বতন্ত্র। শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের কার্যকারিতার উপর এর বিবর্তন নির্ভর করে না।