—প্রতীকী ছবি।
ভারতের অর্থব্যবস্থার বর্তমান হাল কেমন? অর্থব্যবস্থা কি কোভিডের অভিঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে? গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বৃদ্ধির হারের দিকে এক ঝলক তাকালে মনে হতেই পারে যে, দেশের অর্থব্যবস্থার গতি বেড়েছে। যেমন, ২০২২-২৩ সাল সংক্রান্ত সদ্য প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এই বছরে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৭.২%। এপ্রিল মাসে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) বিশ্ব অর্থব্যবস্থা সংক্রান্ত যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৪ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হবে ২.৮ শতাংশ। এমনকি চিনের বৃদ্ধির হার ভারতের চেয়ে বর্তমানে কম। তা হলে কি ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটি দখল করেই ফেলল?
এই মূল্যায়নটি যথার্থ নয়। মোট জিডিপি-র পরিমাণ অথবা তার বৃদ্ধির হার দেশের অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য পরিমাপের একমাত্র মাপকাঠি নয়। অমর্ত্য সেন গোটা জীবন ধরে তাঁর গবেষণার মাধ্যমে এই কথাটি বারংবার আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তবু, আপাতত এই প্রসঙ্গে বিতর্ক না করে, বৃদ্ধির হারকেই উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি ধরে নিই। এই যে ৭.২ শতাংশ বৃদ্ধির হার, তা কিন্তু ২০২১-২২ সালে ছিল ৯.১ শতাংশ। তার মানে ২০২২-২৩ সালে আসলে আর্থিক বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু তাই বলে ভারতের অর্থব্যবস্থা শ্লথতার শিকার হয়েছে, এই ধারণা করলে ভুল হবে, কারণ ২০২০-২১ সালে দেশে লকডাউন ছিল। সেই বছর জিডিপি-র পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল অনেকখানি। তার পরের বছরে আর্থিক বৃদ্ধির হার চড়া হওয়ার কারণকে অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় বলে ‘লো বেস এফেক্ট’— আগের বছর আয় কমেছিল, তাই পরের বছরের বৃদ্ধিকে অনেক বেশি দেখাচ্ছে। অতএব ২০২১-২২ সালের বৃদ্ধির হারকে আলোচনার বাইরে রাখা ভাল। তা হলে কি ২০২২-২৩ সালের আর্থিক বৃদ্ধি সত্যিই দেশের অর্থব্যবস্থার প্রবল উন্নতির ইঙ্গিত দিচ্ছে?
সেটা বোঝার জন্য কোভিড-এর আগের সময়ের সঙ্গে তুলনা করা দরকার। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি-র পরিমাণ (২০১১-১২ সালের অর্থমূল্যে) ছিল ১৪৫ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ১৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৯-২০ এবং ২০২২-২৩ সালের মধ্যে অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার মাত্র ১০.৩ শতাংশ। ইতিমধ্যে কেটে গেছে তিনটি বছর। যদি আমরা কোভিডের বছরটিকে (২০২০-২১) হিসাবের বাইরে রাখি, তা হলে দেখা যাবে যে, ভারতের অর্থব্যবস্থা কোভিড-পূর্ব বছরের তুলনায় বছরে গড়ে ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে।
কোভিডের আগে ভারতীয় অর্থনীতি গড়ে যে হারে বাড়ছিল, সেই বৃদ্ধির হার যদি বজায় থাকত তা হলে এখন জিডিপি-র অঙ্কটি কত হত? ২০১৯-২০ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৪ শতাংশের কাছাকাছি। ধরা যাক, কোভিড না হলে ভারতে অন্তত প্রত্যেক বছর এই বৃদ্ধির হার বজায় থাকত। তা হলে, ২০২২-২৩ সালে ভারতের জিডিপি-র পরিমাণ হত ১৬৩ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে তা হয়েছে ১৬০ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোভিড-পূর্ব সময়ে যা বৃদ্ধির হার ছিল, সেটুকু বজায় থাকলেও ভারতের জিডিপি-র অঙ্কটি আজকের জিডিপি-র পরিমাণের চেয়ে বেশি হত। অর্থাৎ, শুধুমাত্র জিডিপি-র নিরিখে দেখলেও ভারত কোভিডজনিত মন্দাবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পারেনি।
অস্বীকার করা যায় না যে, ৭.২% বৃদ্ধির হার নিশ্চিত ভাবেই বেশ ভাল। কিন্তু অর্থব্যবস্থার সমস্ত ক্ষেত্র একই হারে বৃদ্ধি পায় না। যেমন মোট আর্থিক বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের উপরে থাকলেও শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার মাত্র ১.৩%। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রথম পাঠেই বলা হয় যে, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার অন্যতম সূচক হল শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি। ভারতে বর্তমানে তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার হয়েছে ৪%। ২০২২-২৩ সালের ৭% বৃদ্ধির হারের নেপথ্যে রয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রের বিপুল বৃদ্ধি। যেমন খুচরো ও পাইকারি ব্যবসা, যানবাহন পরিষেবা এবং হোটেল রেস্তরাঁ পরিষেবায় বৃদ্ধির হার ছিল ১৪%। অন্য দিকে ফাইনান্স, রিয়েল এস্টেট ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল ৭%। নির্মাণ ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ। এই তিনটি ক্ষেত্রের বৃদ্ধির হারই ২০২২-২৩ সালের মোট জিডিপি-র বৃদ্ধির হারের মূল চালিকাশক্তি।
খেয়াল রাখা ভাল যে, ২০২২-২৩ সালের ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির হারের দিকে তাকালে দেখা যাবে খুচরো ব্যবসা, হোটেল রেস্তরাঁ এবং ফাইনান্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার প্রত্যেক ত্রৈমাসিকে কমেছে। মনে রাখতে হবে যে, ২০২১-২২ সালেও আংশিক লকডাউন ছিল। এমনকি ২০২১-২২ সালের শেষ ত্রৈমাসিকেও ওমিক্রনের আক্রমণে মানুষ ব্যতিব্যস্ত ছিল। অতএব ২০২১-২২ সালের তুলনায় মানুষের চলাচল বেড়েছে। শপিং মল, রেস্তরাঁয় আনাগোনা ইত্যাদি বেড়েছে, তাই ২০২২-২৩ সালে এই ধরনের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু এক বার সেই অবদমিত চাহিদাগুলি পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে এই হার বজায় থাকবে কি?
এই সংশয় আরও বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্য কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে। যেমন জঁ দ্রেজ় গণনা করে দেখিয়েছেন যে, বিগত ২০১৪-১৫ সাল থেকে ২০২১-২২ সাল অবধি গ্রামীণ এলাকায় প্রকৃত মজুরির বৃদ্ধির হার এক শতাংশেরও কম রয়েছে। গ্রামীণ শ্রমিকদের মজুরির বৃদ্ধির হার যদি শূন্যের কাছকাছি থাকে তা হলে গ্রামীণ বাজারে চাহিদা কমবে এবং আর্থিক বৃদ্ধির হারের উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়ত, সিএমআইই-র সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, ভারতে বেকারত্বের হার ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে ৮ শতাংশের বেশি রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯-২৯ বছর বয়সি যুবক-যুবতীদের মধ্যে যাঁদের স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে, তাঁদের বেকারত্বের হার ২০২১-২২ সালে ছিল ২৯.১%। দেশের শিক্ষিত যুব সমাজের এক-চতুর্থাংশের বেশি যদি কর্মহীন থাকে, তা হলে বৃদ্ধির হার আকাশ ছুঁলেও তা নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। অন্য দিকে, একশো দিনের কাজে কর্মরত মানুষের সংখ্যা কোভিডের পরেও অত্যন্ত বেশি রয়েছে। ২০১৯-২০ সালে ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করেছিলেন মোট ৭.৭৭ কোটি মানুষ, যা ২০২১-২২ সালে বেড়ে হয় ১১.১৯ কোটি। ২০২২-২৩ সালে কিছুটা কমে সংখ্যাটি হয়েছে ১০.৬১ কোটি। কিন্তু ২০২৩-২৪ সালে মাত্র দুই মাসে (এপ্রিল-মে) এই প্রকল্পে কাজ করেছেন প্রায় ৪ কোটি মানুষ। ১০০ দিনের কাজ মূলত দৈহিক শ্রমের কাজ, যার মজুরি খুব বেশি নয়। তবু, এর জন্য এত মানুষের চাহিদা প্রমাণ করছে যে আসলে দেশে কর্মসংস্থানের সমস্যা গুরুতর, যা শুধু জিডিপি-র পরিমাণ বা বৃদ্ধির হার দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।
অতএব, আর্থিক বৃদ্ধির মাপকাঠিতে দেখলেও বলতে হচ্ছে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থার হাল কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় এখনও খুব বেশি উন্নত হয়নি। কর্মসংস্থানের সমস্যাও গুরুতর। দুইয়ের নিরিখেই বলা যেতে পারে যে, এখন উচ্ছ্বাসের সময় নয়। উন্নয়নের পথে এখনও বহু দূর চলা বাকি।