Riots

হিন্দুত্ববাদের নতুন পরীক্ষাগার?

সাম্প্রতিক কিছু বছরে, দেশের বহু জায়গাতেই হিংসা, নজরদারি এবং নানা ধরনের অসহিষ্ণুতার ঘটনা বেড়েই চলেছে।

Advertisement

পূর্ণিমা ভরদ্বাজ, ঈশ্বর সুন্দরেসন

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২২ ০৫:১৬
Share:

কর্নাটক হাই কোর্ট ২০২২-এর ১০ ফেব্রুয়ারি নির্দেশিকা জারি করে জানায়, ইউনিফর্মের সঙ্গে হিজাব বা গেরুয়া শাল পরে, কিংবা ধর্মীয় পতাকা নিয়ে পডুয়ারা রাজ্যের কলেজগুলিতে ক্লাস করতে পারবেন না, যত দিন না বিষয়টি নিয়ে আদালতে ফয়সালা হচ্ছে। কোন ঘটনাক্রমে এই নির্দেশিকা এল, কর্নাটকের বহু জায়গায় কী ভাবে ফেটে পড়ল হিংসা, আর নিষেধাজ্ঞার নৈতিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তর লেখা হয়েছে। রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের এটাই কিন্তু একমাত্র উদাহরণ নয়। ধর্মান্তরণ-বিরোধী বিল থেকে হিন্দু ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানদের দোকান দিতে না দেওয়া, স্কুলের পাঠ্যক্রমে ভগবদ্‌গীতাকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব, গত কয়েক মাসে কর্নাটকে ঘটে গিয়েছে এমন অনেকগুলো ঘটনা, যার প্রতিটির মধ্যেই মুসলমান-বিদ্বেষের ছাপ অতি স্পষ্ট। প্রশ্ন হল, কেন?

Advertisement

এই প্রশ্নের একটা উত্তর হল, কর্নাটক গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সাম্প্রতিক কিছু বছরে, দেশের বহু জায়গাতেই হিংসা, নজরদারি এবং নানা ধরনের অসহিষ্ণুতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। মধ্যপ্রদেশে তা ধর্মান্তরণ-বিরোধী আইন, উত্তরপ্রদেশে গোহত্যা-গুজব, অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জিকে কেন্দ্র করে ডি-ভোটারের নামে মূলত মুসলমানদের হেনস্থা করা, পশ্চিমবঙ্গে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হুমকি দিয়ে যাওয়া যে রাজ্যে নয়া নাগরিকত্ব আইন চালু হবেই— যে দিকেই তাকাবেন, মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় হিংস্রতা চলছে। এত দিনে সবাই জানি, বিশ্ব জুড়েই অসহিষ্ণুতায় সমাজমাধ্যমের কী বিরাট অবদান! প্রায় প্রতিটি নাগরিকের হাতেই এখন প্রচারের নিজস্ব বিশাল চোঙা আছে। তার মাধ্যমে অনলাইনে অসহিষ্ণু মতপ্রকাশ মাত্রেই নিজগোষ্ঠীর উল্লাস, তৎক্ষণাৎ শিরায় শিরায় চেগে ওঠে ডোপামিন।

যে সব কারণে গোটা দেশে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কর্নাটকেও সেই কারণগুলি বর্তমান। প্রথমত, বর্তমান সরকারের প্রধান বিরোধীরাই তো নখদন্তহীন। কংগ্রেস অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে— কর্নাটকেও তার সাংগঠনিক শক্তিক্ষয় হয়েছে বহুলাংশে। বিরোধী রাজনীতির উপর সাধারণ মানুষের ভরসাও কমেছে। রাষ্ট্র যদি সংখ্যালঘুকে নিপীড়ন করে, তবে বিরোধীরা তার যথাসাধ্য প্রতিরোধ করবেন, এই আশা সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘু, কারও নেই— সরকারেরও নেই। ফলে, সংখ্যালঘুকে বিপন্ন করার ‘ঝুঁকি’ নিতান্ত কম।

Advertisement

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিপন্নতার অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই বিপন্নতার বোধ তৈরি করতে চাওয়া হিন্দুত্ববাদীদের শতবর্ষের সাধনা। এর ফলে, এক দিকে দেশের সাধারণ হিন্দুদের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ মুসলমানদের মনে করছেন নিজেদের স্বাভাবিক শত্রু; অন্য দিকে, ভারতীয়ত্বের সঙ্গে হিন্দুত্বের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে বিশ্বাসী হয়ে উঠছেন। ২০২১-এর পিউ রিসার্চ সেন্টার ৩০,০০০ প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়ের উপর সমীক্ষা করেছিল। তাতে দেখা গিয়েছে, হিন্দুদের মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ বলেছেন যে, প্রকৃত ভারতীয় হতে আগে হিন্দু হওয়া ভীষণ জরুরি। এই সমীক্ষাগুলির সহায়তায় ব্যাখ্যা করা যায়, ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে গৌরবের অনুভূতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষ কেন এত তাড়াতাড়ি আঁকড়ে ধরেন। তাঁরা নিশ্চিত যে প্রথম নলজাতক, প্রথম বিমানের জন্ম প্রাচীন ভারতেই। ৩০০০ বছর পুরনো চিকিৎসারও সূত্রপাত এখানেই, যা পশ্চিমে সবেমাত্র দেখা দিয়েছে। এই যে সাম্প্রতিক বায়োপিকগুলি তৈরি হচ্ছে— যেখানে দেশাত্মবোধ আর জঙ্গি দেশপ্রেমের মাঝখানের সীমারেখাটা গুলিয়ে দেওয়া হয়, তার মূল দর্শক এঁরাই।

এই কারণগুলোর সঙ্গে রয়েছে কর্নাটকের রাজ্য রাজনীতির কিছু নিজস্ব চলন। কেউ বলতেই পারেন যে, গুজরাত বা আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশের পর কর্নাটককে হিন্দুত্ববাদের নতুন পরীক্ষাগার হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু, তাতে একটা গোলমাল রয়েছে। গোটা দেশের মতোই কর্নাটকেও বিজেপির উত্থান আশির দশকের শেষে, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়, রাম জন্মভূমির রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু, রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভাবে গুজরাত বা উত্তরপ্রদেশে বিজেপি যতখানি গ্রহণযোগ্য হতে পেরেছে, কর্নাটকে তা সম্ভব হয়নি। রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকা চিরকালই উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে সমর্থন করেছে, কিন্তু বাকি রাজ্যের রাজনীতি মূলত চালিত হয়েছে জাতের সমীকরণ মেনে। লিঙ্গায়েত বনাম ভোক্কালিগা রাজনীতিই এই রাজ্যের প্রধানতম রাজনৈতিক বিভাজিকা— হিন্দুত্ববাদ নয়। রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপির যতখানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা এই জাতের সমীকরণ মেনেই হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ওয়াই এস ইয়েদুরাপ্পা।

কর্নাটকের ইতিহাসে এই প্রথম বার বিজেপির সামনে পথ পাল্টানোর সুযোগ এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইয়ের রাজনৈতিক ওজন তাঁর পূর্বসূরিদের তুলনায় কম, তাঁর কার্যত কোনও বিশ্বস্ত ভোটব্যাঙ্ক নেই। ইয়েদুরাপ্পার অনুপস্থিতিতে লিঙ্গায়েত ভোট ব্যাঙ্কের উপরও ভরসা করা বিজেপির পক্ষে কঠিন। ফলে, এখনই সঙ্কট এবং সুযোগ একই সঙ্গে উপস্থিত— রাজ্য রাজনীতির পরিচিত ছক থেকে বেরিয়ে সর্বভারতীয় মুসলমান-বিদ্বেষের রাজনীতির পথে কর্নাটককে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি। বিধানসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে, ফলে আগ্রাসনেরও গতি বেড়েছে। এক অর্থে বলা চলে, রাজ্যের নিজস্বতা ছেড়ে কর্নাটকের বিজেপি নিজেদের ঢেলে নিল সর্বভারতীয় ছাঁচে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement