‘এক দেশ এক ভোট’ নীতিতে কার লাভ, কার ক্ষতি
One Nation One Election

গণতন্ত্রের নতুন পরীক্ষা

প্রস্তাবটি কার্যকর করতে গেলে সংবিধানে কিছু আবশ্যক পরিবর্তন প্রয়োজন, যার জন্য আবার দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থন থাকা জরুরি।

Advertisement

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:০৬
Share:

এক দেশ এক ভোট’ প্রস্তাব কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় গৃহীত হওয়ার পর গত ১৭ ডিসেম্বর লোকসভায় বিল হিসাবে পেশ করা হয়েছিল। প্রস্তাবটি কার্যকর করতে গেলে সংবিধানে কিছু আবশ্যক পরিবর্তন প্রয়োজন, যার জন্য আবার দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থন থাকা জরুরি। যে-হেতু লোকসভায় এই মুহূর্তে বিজেপি বা এনডিএ-র দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, এবং যে-হেতু ইন্ডিয়া জোট এই বিলের বিরোধিতা করছে, তাই আপাতত এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কিন্তু আপাতত অনিশ্চিত হলেও পরে কখনও অপরিবর্তিত কিংবা সংশোধিত অবস্থায় প্রস্তাবটি আবার ফিরে আসবে না, এমন মোটেই নয়। কারণ, এটি চালু করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশেষ আগ্রহী।

Advertisement

‘এক দেশ এক ভোট’ বিল ভারতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মৌলিক কিছু পরিবর্তন সাধনের কথা বলছে। মূল পরিবর্তন, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এক সঙ্গে লোকসভা এবং দেশের সমস্ত বিধানসভার নির্বাচন সম্পন্ন করা। স্বাধীনতার পর কিছু দিন অবধি লোকসভা এবং সমস্ত রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন এক সঙ্গে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। তার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্যের মন্ত্রিসভা বিভিন্ন কারণে ভেঙে যায়। শাসক পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে লোকসভাও একাধিক বার ভেঙে গিয়েছে। ফলে লোকসভার নির্বাচন এবং রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনের তারিখ এখন এক-এক রকম। আবার এক সঙ্গে নির্বাচন করতে গেলে কিছু রাজ্যের মন্ত্রিসভার বর্তমান মেয়াদ কমাতে হবে, কিছু বাড়াতে হবে।

এক বার নাহয় তোড়জোড় করে সব ক’টা নির্বাচন এক সঙ্গে করা গেল। কিন্তু তার পর আবার কোনও মন্ত্রিসভা পাঁচ বছর পূর্ণ করার আগে মুখ থুবড়ে পড়বে না, কে বলতে পারে? বিলে প্রস্তাব রয়েছে যে, সে ক্ষেত্রে আবার নির্বাচন করতে হবে— কিন্তু, তাতে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হবে, তার মেয়াদ হবে পাঁচ বছরের বাকি সময়টুকু। একে পূর্ণ নির্বাচন না বলে বলা হচ্ছে অন্তর্বর্তী নির্বাচন।

Advertisement

‘এক দেশ এক ভোট’-এর সপক্ষে কয়েকটা জোরালো যুক্তি আছে। প্রথমত, এর ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও মানবসম্পদের সাশ্রয় হবে। ভারতীয় নির্বাচনগুলিতে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় হয়— সরকারের তো বটেই, তার থেকেও বেশি রাজনৈতিক দলগুলোর। নির্বাচন এক সঙ্গে হলে বার বার অর্থব্যয় করতে হবে না। তা ছাড়া নির্বাচনের কারণে এক বড় সংখ্যক সরকারি কর্মচারীকে ভোটের কাজে বেশ কিছু দিন ব্যস্ত থাকতে হয়। স্কুল কলেজ বন্ধ রাখতে হয়। ফলে শিক্ষা, সুশাসন, উন্নয়নের গতি সবই বাধাপ্রাপ্ত হয়। এক সঙ্গে ভোট হলে পাঁচ বছরে এক বারই এই সমস্যা দেখা দেবে। আরও যুক্তি, নির্বাচনের আগে মডেল কোড অব কনডাক্ট প্রযুক্ত হলে উন্নয়নের কোনও কাজই আর করা যায় না। এক সঙ্গে সব ভোট হলে এই সমস্যাও কমবে। নির্বাচনের সময় বহু মানুষকে কাজ ফেলে ভোট দিতে যেতে হয়। যাঁরা ভিন রাজ্যে কাজ করছেন, তাঁদের এই সমস্যাটা সব থেকে বেশি। বার বার ভোট হলে অনেকে ভোট দিতে যেতেই পারেন না। এক বারে সব ক’টা ভোট হলে সম্ভবত মানুষের ভোট দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

তবে, উল্টো দিকেও জোরদার যুক্তি আছে। প্রথমত, প্রতিটা নির্বাচন জন-প্রতিনিধিদের একটা পরীক্ষা। পরীক্ষায় পাশ করতে গেলে কিছু ভাল কাজ করে দেখাতে হয়। পাঁচ বছরে এক বার পরীক্ষা হলে শুধু শেষের দু’এক বছর ভাল কাজ করলেই চলবে, কারণ জনস্মৃতি সচরাচর দীর্ঘস্থায়ী নয়। কিন্তু পাঁচ বছরে একাধিক বার নির্বাচন হলে জন-প্রতিনিধিদের টানা কাজ করে যেতে হবে, যে-হেতু সর্বদাই কোনও না কোনও নির্বাচন সামনে থাকছে। দ্বিতীয়ত, সার্বিক ভাবে ভোটদানের হার ভারতে খুব কম নয়। ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনে এই হার ছিল ৬৫.৭৯%। তাই ভোটের হার বাড়ানোটা তেমন দরকারি কোনও লক্ষ্য হতে পারে না।

‘এক দেশ এক ভোট’ প্রস্তাবের একটা বড় আপত্তি আসছে আঞ্চলিক দলগুলি থেকে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দু’টি সর্বভারতীয় দলকেই একাধিক আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু কিছু আঞ্চলিক দলকে রাজ্য স্তরে তাদের সঙ্গেই নির্বাচনে লড়তে হচ্ছে, যাদের সঙ্গে তারা কেন্দ্রে জোট বেঁধে আছে। কেন্দ্র এবং রাজ্যের ভোট আলাদা সময় সম্পন্ন হলে তবু এটা সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু ভোট এক সঙ্গে হলে এই আঞ্চলিক দলগুলি দ্বিচারিতার দায়ে পড়বে। অন্তর্বর্তী নির্বাচনের প্রস্তাবটাও আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্ব খানিকটা কমিয়ে দিচ্ছে। অন্তর্বর্তী নির্বাচনে জিতেও পুরো পাঁচ বছর সরকারে থাকা যাবে না। তাই প্রধান বিরোধী দলের কাছে ক্ষমতাসীন জোটের থেকে কোনও আঞ্চলিক দলকে ভাঙিয়ে এনে মাঝপথে আবার নির্বাচন করার উৎসাহ কমে যাচ্ছে। ফলে প্রধান বিরোধী দলের কাছে ক্ষমতাসীন জোটে থাকা আঞ্চলিক দলগুলোর গুরুত্ব কমছে তো বটেই, প্রধান ক্ষমতাসীন দলের কাছেও এদের গুরুত্ব কমছে, কারণ এই আঞ্চলিক দলগুলির শিবির বদলানোর সুযোগ ও সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।

‘বিহেভিয়রাল ভোটার্স ইন সিনক্রোনাইজ়ড ইলেকশনস: এভিডেন্স ফ্রম ইন্ডিয়া’ (বালসুব্রমনিয়াম, ভাটিয়া এবং দাস; ২০২৩) শীর্ষক গবেষণাপত্র ১৯৭৭ থেকে ২০১৮ অবধি লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচনী ফল এবং উত্তর-নির্বাচন বেশ কিছু সমীক্ষার ভিত্তিতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে। প্রথমত, ভোট এক সঙ্গে হলে ভোটারদের লোকসভা এবং বিধানসভায় একই দলকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে যায়। ফলে যেখানে লোকসভা এবং বিধানসভার ভোট এক সঙ্গে হচ্ছে, সেখানে সব দলের ক্ষেত্রেই বিধানসভা এবং লোকসভায় প্রাপ্ত ভোটের হার খুব কাছাকাছি চলে আসছে। এর পিছনে ভোটারদের ব্যবহারগত বা মনস্তাত্ত্বিক নানা রকম কারণ থাকতে পারে। অর্থাৎ, লোকসভা এবং বিধানসভার নির্বাচন এক সঙ্গে হলে দুটোনির্বাচনে একই রাজনৈতিক দলের জেতার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

দু’নম্বর সিদ্ধান্তটি সমীক্ষা-ভিত্তিক। ভোট হয়ে যাওয়ার পরে ভোটারদের সমীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, লোকসভা এবং বিধানসভার নির্বাচন এক সঙ্গে হলে প্রার্থীর মান, জাতপাত, স্থানীয় বা জাতীয় রাজনৈতিক ঘটনা ইত্যাদি সব কিছুকে ছাপিয়ে মানুষ ভোট দিচ্ছেন মূলত রাজনৈতিক দলের চিহ্ন দেখে। তা ছাড়া এক সঙ্গে ভোট হলে, ভোটের দিনের ঢের আগেই— বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রচারের সময়— মানুষ ঠিক করে ফেলছেন, কোন দলকে ভোট দেবেন। আলাদা আলাদা সময় ভোট হলে কিন্তু ভোটাররা দলের চিহ্ন ছাড়াও আরও অনেক কিছু দেখে ভোট দিচ্ছেন। কাকে ভোট দেবেন সেই সিদ্ধান্তও অনেক দেরিতে নেওয়া হচ্ছে।

দু’টি সিদ্ধান্তকে মেলালে এটাই দাঁড়ায় যে, এক সঙ্গে নির্বাচন হলে ভোটারদের প্রবণতা হবে দল দেখে ভোট দেওয়ার; এবং, লোকসভা ও বিধানসভায় একই দলকে ভোট দেওয়ার। অর্থাৎ ভোটাররা বিধানসভায় আঞ্চলিক দলকে এবং লোকসভায় সর্বভারতীয় দলকে ভোট দিচ্ছেন, এ রকম খুব বেশি দেখা যাবে না। একই দলকে ভোট দিতে হলে কোনও সর্বভারতীয় দলকেই দিতে হবে, যে-হেতু লোকসভায় আঞ্চলিক দলগুলি ততটা প্রাসঙ্গিক নয়, কিন্তু সর্বভারতীয় দলগুলি লোকসভা ও বিধানসভা দুটোতেই প্রাসঙ্গিক। এর ফলে সর্বভারতীয় দলগুলোর লাভ, এবং ভোটার আনুগত্যের নিরিখে যে সর্বভারতীয় দল সব থেকে এগিয়ে আছে, তার লাভ সর্বাধিক।

সেই নিরিখে, ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু হলে বিজেপি সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। আর ক্ষতি হবে সার্বিক ভাবে ভারতীয় গণতন্ত্রের; এবং যারা গণতন্ত্র ধরে রাখে, সেই ছোট-বড় আঞ্চলিক দলগুলোর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement