এই ঘটনায় বৃহত্তর রাজনীতি টেনে আনাতেই মুখ্যমন্ত্রীর সুবিধা
SSC recruitment scam

বাইশ কোটির প্রতিক্রিয়া

গ্রেফতারের পরে মহিলা বলেছেন, তিনি এ সবের ‘কিছুই’ জানেন না। বিষয়টি বিচারসাপেক্ষ। তাই মন্তব্য করা সমীচীন নয়।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২২ ০৪:৪২
Share:

রাজনীতি মাথায় থাক! নেতাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তো আরও দূরের কথা। এটা মানতেই হবে যে, সাধারণ মানুষ নিজেদের বুদ্ধিতে যা বুঝে নেয়, তার উপর কারও হাত থাকে না। তাই আপাত ভাবে মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে জনমনে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটা রাতারাতি বদলে যাবে ভাবলে অতি সরলীকরণ হবে।

Advertisement

‘চক্রান্ত’? ভবিষ্যৎ হয়তো তৃণমূলের এই অভিযোগের উত্তর দেবে। এখনকার যুক্তি বলে, কারও হেফাজত থেকে নগদে প্রায় বাইশ কোটি টাকা ‘উদ্ধার’ হওয়া কোনও মামুলি ঘটনা নয়। তার উপর মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা। এসএসসি-নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে নাম জড়িয়ে পড়া পার্থবাবুর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত মহিলার বাড়িতে সেই টাকা রাখা থাকলে তার আঁচ মন্ত্রীর গায়ে লাগবেই।

বিশেষ করে যাঁর বাড়ি থেকে ওই টাকা মিলেছে বলে জানা গিয়েছে, তিনি নিজে কোনও নেতা-মন্ত্রী-এমএলএ-এমপি নন। অতএব তাঁর কাছে নিশ্চয় কোটি কোটি টাকার ‘তহবিল’ থাকবে না বা সরাসরি কেউ তাঁকে ঘুষ দিতেও যাবেন না। এ ক্ষেত্রে তাঁর একমাত্র পরিচিতি হল তিনি মন্ত্রী পার্থবাবুর ঘনিষ্ঠ। ধন্দ তাতে আরও বাড়ে।

Advertisement

গ্রেফতারের পরে মহিলা বলেছেন, তিনি এ সবের ‘কিছুই’ জানেন না। বিষয়টি বিচারসাপেক্ষ। তাই মন্তব্য করা সমীচীন নয়। শুধু সংশয় জাগে, এত পরিমাণ টাকা কি রাতারাতি ‘গোপনে’ রেখে দিয়ে আসা সম্ভব? মনে হয় না। যে ভাবে পার্থ-ঘনিষ্ঠর বাড়িতে থরে থরে প্যাকেটে সেগুলি সাজানো ছিল, তাতে দীর্ঘ মেয়াদে ‘গুছোনো’র ছাপই বরং স্পষ্ট।

বাইশ কোটি টাকা নগদে রেখে দেওয়াও কম বিস্ময়ের নয়। কতটা বেপরোয়া হলে, ‘ক্ষমতার শিরদাঁড়া’ কতটা শক্ত হলে এটা করা যায়? পুলিশ-প্রশাসন-দল কেউ টেরও পেল না! এ শুধু লজ্জা নয়, পাপও।

অতএব রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী পার্থবাবুকে ঘিরে এই সব কাণ্ড এবং ইডি-র হাতে তাঁর গ্রেফতার হওয়া তৃণমূল ও সরকারকে যে রীতিমতো বিড়ম্বনায় ফেলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আইনের বিচার কী হবে, সে সব পরের ব্যাপার। তবে নির্মম সত্য হল, জনগণের দৃষ্টিতে তিনি নিজের মুখ পোড়ালেন, দল এবং সরকারের মুখেও কালি লেপে দিলেন।

বিজেপি এটা হাতিয়ার করবেই। যে কোনও বিরোধী দলের তা স্বাভাবিক ধর্ম। ফলে নিজেদের নড়বড়ে অবস্থায় অন্তত লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত এই ঘটনা থেকে বিজেপি খানিকটা ‘অক্সিজেন’ নেওয়ার চেষ্টা করবে, ধরে নেওয়া যায়।

রাজনীতিতে ‘সময়’ একটি মূল্যবান অস্ত্র। যদিও সঠিক ক্ষণে প্রয়োগ না করলে অনেক সময় তার ধার কমে যেতে পারে। অনেকের মনেই প্রশ্ন, তৃণমূল নেতৃত্ব কি এই অবস্থায় পার্থবাবুকে সরকার এবং দলের দায়িত্ব থেকে তৎক্ষণাৎ সরিয়ে দিতে পারতেন না? তাঁরা গোড়াতেই সেই পথ নিলেন না কেন?

বস্তুত শুক্রবার রাতে দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের একটি প্রতিক্রিয়া থেকে মনে হয়েছিল, দল বোধ হয় অবিলম্বে পার্থবাবুর সঙ্গে ‘দূরত্ব’ তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু সেটা হয়নি। শনিবার দেখা গেল, ঘটনার সঙ্গে জড়াতে না চাইলেও দল কার্যত পার্থবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছে। বলা হল, মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ দু’টিই থাকবে পার্থবাবুর। বিচারে যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তখন ব্যবস্থা।

এই গুরুতর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটি ঘোষণার আগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচনায় ডেকেছিলেন ববি হাকিম, অরূপ বিশ্বাস ও কুণালকে। ঘোষণার দায়িত্ব ছিল তাঁদের। বিষয়টি অর্থবহ। কারণ, তৃণমূলের ভিতরে সূক্ষ্ম টানাপড়েনে ‘হেভিওয়েট’ পার্থবাবুর পাল্লা সব সময়ই যে ভারী থাকে, এমন নয়।

বস্তুত এ বারেই সরকার গঠনের সময় পার্থবাবুর দফতর বাছাই করা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছিল। সেটা বাস্তবে রূপ পেলে মন্ত্রিসভাতে তাঁর অবস্থান অনেক আগেই হয়তো ‘লঘু’ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুরনো দিনের এই রাজনৈতিক সতীর্থকে অন্তত কাগজে-কলমে ‘মর্যাদা’ দিতে চেয়েছিলেন। তাই কিছুটা ‘মধ্যপন্থা’ নেওয়া হয়। পার্থবাবুকে শিল্পমন্ত্রী করেও তাঁর দফতরের মাথায় মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে কমিটি বসানো তার এক উল্লেখযোগ্য প্রমাণ।

একই ভাবে এখনই পার্থবাবুকে ছেঁটে দেওয়ার পক্ষে বহু যুক্তি তৈরি থাকা সত্ত্বেও তৃণমূল নেতৃত্ব প্রথমেই তাঁকে সমান্তরাল ‘আঘাত’ না করে বিষয়টিকে আগে বৃহত্তর রাজনীতিতে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। মমতা নিজে সরাসরি কেন্দ্রের শাসক বিজেপির দিকে কড়া ভাবে আঙুল তুলে তার সুর বেঁধে দিয়েছেন।

পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, এটা মূলত পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা। রাজনীতিতে অনেক কিছুই হয়ে থাকে। অনেক কিছু করাও যায়। পার্থবাবু এখন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের হেফাজতে। জেরায় তাঁর মুখ থেকে কী বেরোবে, তার অভিঘাত কী হবে, সবই অনুমানসাপেক্ষ। সেই জন্যই মোকাবিলায় মমতা হয়তো আগাম বিস্ফোরক হলেন।

ভেবে দেখলে মমতার পক্ষে এটা খুব ভুল চাল বলা যাবে না। পার্থ-কাণ্ডের চাকা যে ভাবে গড়াল, তাতে কেউ রাজনীতির উপাদান খুঁজে পেতে চাইলে সহজেই পাবেন। একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণানোর পর দিনই কাকভোরে পার্থবাবু ও তাঁর পরিচিতদের বিভিন্ন ঠিকানায় ইডি-র সংগঠিত অভিযান।

কাকতালীয় হোক বা না-হোক, তৃণমূল নেতৃত্ব যদি এর পিছনে কোনও রকম ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ দেখতে পান, তা হলে তাঁদের দৃষ্টিকে দোষ দেওয়ার বিশেষ কিছু নেই। আবার আইনের দিক থেকে দেখলে এই অভিযানকে ‘অসঙ্গত’ বলার সুযোগ কম। ফলে, সবটাই রাজনীতির আঁচে গা সেঁকা। সকলেই মানবেন, বাংলায় শাসক তৃণমূলের পক্ষে এই রাজনীতির ‘সুবিধা’ অনেক। যাকে বলে, ‘অফেন্স ইজ় দ্য বেস্ট ডিফেন্স’।

মমতা আরও জানিয়ে রেখেছেন, তাঁর গায়ে কালি লাগানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা হলে তিনি ‘ছেড়ে কথা’ বলবেন না। ঘটনা হল, দল এবং সরকারের সর্বময় কর্ত্রী হিসাবে তাঁর এমন হুঁশিয়ারি তৃণমূলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের উপর ‘মন্ত্রশক্তি’র মতো কাজ করে। তাই মনে হয়, তিনি সর্বাগ্রে সেই জায়গাটি ‘বেঁধে’ নিতে চেয়েছেন।

বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে অবশ্য মমতা বরাবরই সরব। এই রাজ্যে শাসকের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের তালিকাটিও দীর্ঘ। আবার এক যাত্রায় পৃথক ফলের নজির একাধিক। একই ধরনের অভিযোগে রাজ্যে বিজেপির নেতারা কেন্দ্রীয় তদন্তের আওতায় পড়েন না! তবে সবাই জানেন, এই প্রবণতা শুধু বাংলায় নয়, দেশের অন্যত্রও তীব্র। বিরোধীদের মধ্যে এ নিয়ে বিস্তর কথা হয়েছে। সংগঠিত ভাবে মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তাও সামনে এসেছে। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির মাঠে বিরোধী-মঞ্চ থেকে তৃণমূল এখন নিজেদের কিছুটা সরিয়ে রেখেছে। অন্য দিকে, পার্থ-কাণ্ডে রাজ্যে বিজেপির মতোই বাম, কংগ্রেস সকলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে।

এটা তাই মমতার একার লড়াই। সাংগঠনিক শক্তির জোরে বাংলায় তিনি লড়তে ‘অক্ষম’ তা বলব না। তবে তৃণমূলের জামা গায়ে পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যত পাঁক ছড়িয়েছেন, তার দুর্গন্ধ থেকে নিস্তার পেতে কিছু হ্যাপা দলকে পোহাতেই হবে।

শুধু টাকার পাহাড়ই তো নয়। রাজ্যের অন্যতম এই শাসক-নেতার আরও যে সব কদর্য কীর্তিকাণ্ড ইতিমধ্যে বেরোচ্ছে, তার কিয়দংশ ঠিক হলেও তাঁর স্থান হওয়া উচিত জেলখানা। রাজনীতির নিয়মে তার খানিকটা ধাক্কা দলের উপরেও আসবে।

যদিও এটা ঠিক, আজ নয় কাল পার্থবাবুর মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ যাবে। হয়তো বহিষ্কৃত হবেন। তৃণমূল তখন বলতে পারবে, দল কাউকে রেয়াত করে না।

তবে নেতৃত্বকে এটাও বুঝতে হবে, বিষবৃক্ষের শিকড় অনেক গভীরে ছড়ায়। পার্থ-কাণ্ড সেই সতর্কতার ঘণ্টাটিই বাজিয়ে দিয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement