প্রতীকী ছবি
কয়েকজন বন্ধু আড্ডা দিতে আসেন স্কাইপে। বাড়ি থেকে কথা বলতে থাকার মাঝেই আচমকা মেসেজ আসতে থাকে তাঁদের মৃত এক বান্ধবীর কাছ থেকে। স্কাইপ, ফেসবুক মেসেঞ্জার, ই-মেল সর্বত্রই তিনি জানান দিতে থাকেন তাঁর উপস্থিতি। দিন কয়েক আগে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ভূমিকাও ছিল তাঁর বন্ধুদের।
প্রথমে নিছকই ‘কেউ মজা করছে’ বা ‘মৃত বান্ধবীর প্রোফাইল হ্যাক্ড হয়েছে’ ভাবলেও আড্ডায় যোগদানকারীদের সঙ্গে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকার কারণে ক্রমে বিষয়টা আর হালকা থাকেনি। ২০১৪ সালের সিনেমা ‘আনফ্রেন্ডেড’-এর গল্প এই রকমই। প্রায় দেড় ঘণ্টা জুড়ে পর্দায় কেবল কম্পিউটার স্ক্রিনই দেখা যায়। বিভিন্ন সাইট, সার্চ হিস্ট্রি, মাউসের নড়াচাড়ার মধ্য দিয়ে মানসিক টানাপোড়েন, লিখেও ব্যাক স্পেস দিয়ে মুছে ফেলা— এ ভাবেই আধুনিক যাপনকে ফ্রেমবন্দি করা হয় সেই ছবিতে। কিন্তু মৃত্যুর পরেও এই ভার্চুয়াল উপস্থিতি মনের গভীরের শান্ত, নীরব রাতে নাড়া দিয়ে যায়। ‘ক্যাঁচ’ শব্দে দরজা খুলে যাওয়া বা নাচবাড়ির ঘুঙুরের শব্দের মতোই যা শিড়দাঁড়া দিয়ে শীতল রক্তের স্রোত বইয়ে দিতে পারে মুহূর্তে। কারণ সে মৃত। কিন্তু বিলীন হয়ে যাওয়া দেহের বাইরেও সে বেঁচে আছে ফেসবুকে।
আমাদের বন্ধু তালিকা জুড়ে থাকেন অসংখ্য মানুষ। বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বলতে গিয়ে আগের দিনে শোনা যেত, ‘রাজদ্বারে-শ্মশানে’ যে সঙ্গে থাকে। ক্রমে ‘ফ্রেন্ডলিস্ট’ কথাটা সবক’টা উপস্থিতিকেই ভার্চুয়াল করে দিয়েছে। ভার্চুয়াল মানুষ আর সামনে থাকা মানুষের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সামনে থাকা মানুষ কখনও আনন্দে দিন কাটান, কখনও ডুবে যান গভীর বিষাদে। কিন্তু তার জন্য ‘আপডেট’ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কাছের মানুষ আচরণে বোঝেন সবটা। তবে ভার্চুয়ালে জানান দিতে হয় বিষাদ-আনন্দের। অনেক সময় সব বন্ধু চেনা হন না। লম্বা ফ্রেন্ডলিস্টের কে, কেমন আছেন জানা হয় না। আবার কখনও বা মৃত্যুসংবাদ জানতে পারা বন্ধুরাও তালিকায় থেকে যান। গভীর রাতে নাড়াচাড়া করতে করতেই যদি সেই ‘মৃত’ নামের পাশে সবুজ আলো জ্বলতে দেখেন কেউ? একটা ‘না থাকা’ মানুষ বিভিন্ন ভাবে ‘ফেসবুক মেমরি’-তে ফিরে ফিরে আসার সূত্রে তার প্রোফাইলে ঢুকে দেখতে গেলে যদি মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগের স্ট্যাটাস জ্বলজ্বল করে ওঠে?
সামনে থাকা জীবন্ত মানুষের ‘স্ট্যাটাস’, ‘রিঅ্যাকশন’, ‘কমেন্ট’— সব কিছুই সাধারণ, অনিবার্য। সেই শরীর ফুরিয়ে গেল, নেটদুনিয়া কিন্তু ফুরলো না। প্রতীকী ছবি
সামনে থাকা জীবন্ত মানুষের ‘স্ট্যাটাস’, ‘রিঅ্যাকশন’, ‘কমেন্ট’— সব কিছুই সাধারণ, অনিবার্য। সেই শরীর ফুরিয়ে গেল, নেটদুনিয়া কিন্তু ফুরলো না। ‘প্রোফাইল’ আটকে থেকে গেল এক অতীতের ঘেরাটোপে। আর সেই কারণেই আধুনিককালের ভয় তথা ভূতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে জড়িয়ে থাকে এই না থেকেও থেকে যাওয়ায় স্বীকৃতি। হোয়াটসঅ্যাপের ‘লাস্ট সিন’ দেখে অপরদিকে থেকে যাওয়া এক জন মানুষের মানসিক অবস্থার কথা আন্দাজ করতে চান অনেকে। বেশ কিছুদিন অনলাইন না দেখলে মনের ভিতর উঁকি মারে অনির্দেশ্য আশঙ্কা। যন্ত্র ও প্রযুক্তি ক্রমান্বয়ে এ ভাবেই যখন আমাদের জীবনে জড়িয়ে গেল, আমরা ভয়কেও অন্য ভাবে সঞ্চারিত হতে দেখলাম।
সিগমুণ্ড ফ্রয়েড তাঁর ‘দাস আনহেইমলিচ’ ( ১৯১৯ ) প্রবন্ধে ‘অ্যানিমেট’ আর ‘অ্যালাইভ’-এর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, আদৌ চেতনা থাকলেই সজীব আর সজীব মাত্রেই চেতন বলা যাবে কিনা। ‘পোস্ট জিনোম’ সময় থেকে, যখন মানুষের ফ্ল্যাটের নম্বর, পিএফ অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড, টিকা নেওয়ার শংসাপত্র— সবকিছুই ‘ডিজিটাল’ হয়ে গেল, তখন থেকেই তার সংখ্যায় ‘বেঁচে থাকা’। আর সেই বেঁচে থাকা তার ফোন নম্বর, আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, বিভিন্ন ভাবে, নানা সংখ্যায় চিরকালীন ‘থেকে’ যাওয়াই হয় না কি? ব্যাপারটা ভয়ের তো বটেই। মৃত মানুষের ফোন নম্বর আপনার ফোনে সেভ করা আছে হয়ত। তাঁর মৃত্যুর পর বহুদিন অব্যবহৃত থাকা নম্বরটি গিয়ে অন্য কারওর কাছে। আপনি সেই নতুন ব্যবহারকারীকে হোয়াটসঅ্যাপে এক দিন অনলাইন দেখলে, বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠবে না?
এই প্রযুক্তি ঘেরা সময়ে বেঁচে থাকার সঙ্গে ভয়ের সমীকরণও বদলে গিয়েছে। একা স্টেশনে বৃষ্টির দিন কথা দিয়ে নিতে আসা বন্ধু, পরে জানতে পারা যে সে আর বেঁচে নেই— এই কাঠামোর গল্প নির্মাণ যেমন আর হয় না, ঠিক তেমনই ভয়ের গল্পে ঢুকে যায় আধুনিক প্রযুক্তিও। কিছুটা হাস্যকর হলেও এটা সত্যি যে, বিচিত্র শখ নিয়ে যাঁরা নিজেদের ‘ঘোস্ট হান্টার’ বলে দাবি করেন, তাঁদের ভূত খুঁজে পাওয়ার সমস্ত যন্ত্রই অত্যন্ত আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত। যুক্তিবুদ্ধির বাইরে, আমাদের সীমিত ক্ষমতায় এ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ‘বিজ্ঞানের ক্ষমতা সীমিত’— এই যুক্তিতে ভূতকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেও ‘ঘোস্ট হান্টিং কিট’ নিয়ে ভূত খোঁজার বিষয়টিতে এক ধরণের জটিলতা থেকে যায়। তাতে ‘যুক্তিগ্রাহ্যতা’ খুঁজে পাওয়া সমস্যার। তবে আর যা-ই হোক, ওঝা বা গুনিনদের লাঠি, আয়না, বিভিন্ন মন্ত্রপড়া জল, এ সবের জায়গায় স্থান পেয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন এই উপকরণগুলো, সে কথা মানতেই হবে।
মৃত্যুর মতো অমোঘ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ভয় থেকে যায়, তা আসলে নিজেকে ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত। প্রতীকী ছবি
ধারাবাহিক ভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে যন্ত্র তথা প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ফিরে যেতে হয় নিকোল টেসলার হাত ধরে ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বালানোর সময়ে। মানুষের মনে হয়েছিল এ যেন এক ভোজবাজি। নিশ্চয়ই কোনও অতিপ্রাকৃত শক্তির ভূমিকা রয়েছে। ৫০ বছর আগেও গল্পে যদি ঘরের মধ্যে দেওয়ালে কোনও দূরে-থাকা মানুষের মুখ ভেসে উঠত, তাকে অলৌকিক কিছু বলেই মনে করা হত। বর্তমানে এ নিয়ে আর কোনও রহস্য নেই। টেলিগ্রাফি থেকে টেলিফোনের ব্যবহার এবং সামাজিক স্তরে তার বিচিত্র প্রভাব নিয়ে জেফ্রি স্কটের ‘হন্টেড মিডিয়া’ (২০০০) আলোকপাত করেছে। রিচার্ড স্টিভার্স তাঁর গবেষণাধর্মী আলোচনা ‘টেকনোলজি অ্যাজ ম্যাজিক’-এ ‘অযৌক্তিকের জয়লাভ’ সম্পর্কে বলেছিলেন সমসাময়িক মিডিয়া এবং গণপ্রচারে ম্যাজিকের মোড়কে প্রযুক্তির বিক্রি প্রসঙ্গকে চিহ্নিত করে। মেশিন আর প্রযুক্তি নিত্যদিন সবথেকে বেশি ব্যবহার করা মাধ্যম হলেও একটা বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে এর খুব প্রাথমিক কার্যপ্রণালীও অজানা। যুক্তিবাদী সমাজের কাছেও নিত্যদিনের ব্যবহার করা অনেক প্রযুক্তি রক্ষণশীল রহস্যময় খোলসে ঢাকা থাকে।
ইউরোপে শিল্প বিপ্লব, আমাদের এখানে নবজাগরণ— যুক্তিযুক্ত প্রশ্নোত্তরের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল। এর ফলে মানুষের মনে অনেক অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের বিলোপ ঘটবে বলে ভাবা হলেও বিভিন্ন নতুন নতুন ক্ষেত্র ধরে ভয় তথা অন্ধবিশ্বাসের সূত্রগুলো থেকে গিয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে বিস্ময় থেকে ক্রমে ভয় তৈরি হওয়ার পিছনে ফটোগ্রাফি আর সিনেমার ‘ডাবল রোল’- এর ভূমিকা থেকেছে। প্রযৌক্তিক-আধ্যাত্মবাদীরা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রেডিয়োর মাধ্যমে এই ভৌতিক জগতে প্রথম পা ফেলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আকাশবাণী’ গল্পটির কথা। প্রিয়তোষবাবু রেডিয়োর মাধ্যমে কথোপকথন চালাতেন তাঁর পরলোকগতা স্ত্রী-র সঙ্গে। এ ভাবেই আধুনিকের ভয় এগিয়েছে আরও নিত্যনতুন প্রযুক্তির দিকে।
ভয়ের অনুভূতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বিভিন্ন কেস স্টাডি বা মনোবিদদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে হয়। অনেকেই বলেন, তাঁদের মনে হচ্ছে, কেউ তাঁদের আড়াল থেকে দেখছে বা অনুসরণ করছে। কেউ একজন আছে। যে কেবল চেয়ে থাকে, নজর রাখে অপরের গতিবিধির ওপর। ‘আমি অনুসৃত হচ্ছি’— এই বোধটাই একটা চরম অস্বস্তি তৈরি করে। একই সঙ্গে বার বার নিজেকে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। অফিস, কার-পার্কিং, শপিং মল প্রতি মুহূর্তেই আমি ধরা পড়ছি সিসিটিভি ফুটেজে। কোথাও জমা হচ্ছে আমার চলমানতা। থেকে যাচ্ছে আমার অতীত। অদৃশ্য কারও অনুসরণের মতোই এই ঘটনাও তো ভুতুড়ে! মানে এই সিসিটিভি-র অদৃশ্য নজরদারিটা? আত্মা অবিনশ্বর বলেন বিশ্বাসীরা। কিন্তু সাইবার জগতে সত্যিই কিন্তু ‘নশ্বর’ বলে কিছু নেই। ফোন থেকে, অন্য ডিভাইস থেকে মুছে ফেললেও কোনও না কোনও প্রত্যন্ত ডেটা সেন্টারে থেকে যায় সব তথ্য। নিজের মুখোমুখি নিজে দাঁড়িয়ে পড়তে হতে পারে এই ভয়। কোথাও আবার অনুসরণের ভয় হয়ে ফিরে ফিরে আসে সে সব।
মৃত্যুর মতো অমোঘ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ভয় থেকে যায়, তা আসলে নিজেকে ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত। আমার, আমি-র থাকা ফুরিয়ে গেলে কী হবে, সেই থেকেই ক্রমে আমাদের আরও বেশি দেহ তথা ইন্দ্রিয় সচেতন হয়ে ওঠা। পছন্দ, অপছন্দ, গোপন সার্চ হিস্ট্রির সুবাদে আচমকা অস্বস্তিকর বিজ্ঞাপনের স্ক্রিন জুড়ে ভেসে ওঠা, ফেক প্রোফাইলের সঙ্গে কথা বলে নিজের মতামত বদলে ফেলা— সাধারণ বিষয়গুলো আচমকাই হয়ে উঠতে পারে অচেনা, ভীতিপ্রদ। অনলাইন থাকার সময় আচমকা মৃত মানুষের প্রোফাইল থেকে মেসেজ আসা বা মোবাইলে বার বার অন্য কাউকে খুঁজে ফোন আসা— আসলে হয়তো সেই মানুষটা বেঁচেই নেই— আধুনিক প্রযুক্তির থেকে ভয় ভাবনার প্রাপ্তি তো এমনই।
ফাঁকা রেলস্টেশন, পুরনো বাড়ি, অভিশপ্ত গাছ, অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া গাড়ি— কোনও বিশেষ স্থান বা বস্তুর সঙ্গে থেকে যাওয়া অতীত ফিরিয়ে আনে ভয়ের আবহ। প্রযুক্তি বোধহয় তাকেও পার করে সময়কেও ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনে। সেই ফটোগ্রাফি থেকে ডিলিটেড চ্যাট হিষ্ট্রি— এও তো এক ধরনের ‘রিটার্ন অফ দ্য রিপ্রেসে্ড।’
(লেখক গবেষক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)