আবহমান: জেমস প্রিন্সেপের লিথোগ্রাফে বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাট ও গঙ্গা।
অত্যন্ত জটিল এবং আয়াসসাধ্য পদ্ধতিতে সুলতান ফিরোজ তুঘলক যখন ১৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে হরিয়ানার টোপরা আর উত্তরপ্রদেশের মিরাট থেকে দু’টি অশোকস্তম্ভ দিল্লিতে নিয়ে আসেন, তখন এ দেশের পণ্ডিতরা স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। অশোক-যুগের প্রাচীন ব্রাহ্মীলিপির অর্থ তত দিনে সম্পূর্ণ বিস্মৃতির গর্ভে। মোগল সম্রাট আকবরও এই অশোকলিপি পড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
প্রাচীন ভারতীয় লিপিমালা পাঠের উদ্যোগ নতুন করে শুরু হয় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে। নজর পড়ে ভারতবিদ্যা চর্চার বিস্তৃত পরিসরে। ১৭৮৫-তেই চার্লস উইলকিন্স পালরাজা নারায়ণপালের বাদল (দিনাজপুর) স্তম্ভলিপি এবং দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার করেন। চার বছরের মধ্যে তিনি বিহারের গয়া জেলার নাগার্জুনি ও বরাবর পাহাড়ের গুহায় খোদিত মৌখরীরাজ ঈশানবর্মার লিপি পাঠ করেন। পালরাজাদের নবম শতকের লিপির পর ষষ্ঠ শতকের এই লিপির পাঠোদ্ধারের ফলে গুপ্তযুগে ব্যবহৃত ব্রাহ্মীলিপির অনেকটা কাছে পৌঁছনো সম্ভব হল, যদিও ক্যাপ্টেন ট্রয়ার ও মিল-এর সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি পড়তে (১৮৩৪) কেটে গেল আরও প্রায় অর্ধশতক।
ইতিমধ্যে ১৮১১ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক হয়েছেন কলকাতা মিন্ট বা টাঁকশালের অ্যাসে-মাস্টার হোরেস হেম্যান উইলসন। চার্লস উইলকিন্স আর হেনরি টমাস কোলব্রুকের উৎসাহে তাঁর সংস্কৃত চর্চার শুরু। পরের দুই দশকে সে চর্চা এতটাই উচ্চতায় পৌঁছয় যে, ১৮৩২-এ উইলসনকেই মনোনীত করা হয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের প্রথম বোডেন অধ্যাপক পদে। সে বছরের শেষে কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনি তাঁর উত্তরসূরির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন ডেপুটি অ্যাসে-মাস্টার জেমস প্রিন্সেপের হাতে। প্রিন্সেপ শুধু যে মিন্ট-এর অ্যাসে-মাস্টার হলেন তা-ই নয়, তিনিই মনোনীত হলেন এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক পদে। খুলে গেল ভারতবিদ্যা চর্চার নতুন দিগন্ত। সে বৃত্তান্ত তবু কিছুটা আলোচিত। কিন্তু প্রিন্সেপের বারাণসী পর্বের গুরুত্বও কিছু কম নয়।
প্রিন্সেপ পরিবারের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ অবশ্য শুরু হয়েছিল ১৭৭১ সালে, যখন জেমসের বাবা জন প্রিন্সেপ এই শহরে পা রাখেন কিছু রোজগারের আশায়। কলকাতার ‘খালি পদ ইতিহাসবিদ’ সদ্যপ্রয়াত পি টি নায়ার তথ্যপ্রমাণ-সহ দেখিয়েছিলেন যে, জন প্রিন্সেপই প্রথম ইউরোপীয়, যিনি পলতায় ৬০০ বিঘে জমিতে কারখানা খুলে কাপড় ছাপিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সরবরাহ করা শুরু করেন। পাশাপাশি বাংলায় নীলচাষও শুরু হয় তাঁর হাতে, কারখানা ছিল বারাসতের কাছে নীলগঞ্জে। ১৭৮৮ সালে দেশে ফেরার সময় তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার পাউন্ড! এই সূত্রেই তাঁর সাত ছেলে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন বিভিন্ন চাকরি ও পেশায়, যার মধ্যে জেমস প্রিন্সেপই (১৭৯৯-১৮৪০) সর্বাধিক পরিচিত।
১৫ সেপ্টেম্বর ১৮১৯, জেমস নামলেন কলকাতার চাঁদপাল ঘাটে। স্কুলের পড়াশোনা সামান্যই, কিন্তু যন্ত্রপাতি নিয়ে খুব আগ্রহ, আর তীক্ষ্ণ নজর খুঁটিনাটির দিকে। স্থপতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু মারাত্মক চোখের অসুখে তা আর হল না। বাবার সূত্রেই কলকাতার টাঁকশালে একটা চাকরির সুযোগ এল। লন্ডনের রয়্যাল মিন্ট-এ দু’বছর শিক্ষানবিশির শেষে মিলল নিয়োগপত্র: অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসে-মাস্টার। এক বছরের মধ্যে কর্মক্ষেত্র বদল, বেনারস টাঁকশালে-এ যোগ দিলেন অ্যাসে-মাস্টার পদে। জেমস প্রিন্সেপের প্রতিভার স্ফুরণ প্রথম দেখা গেল বেনারসে তাঁর দশ বছরের কর্মজীবনে।
অফিসের কাজের বাইরে তাঁর যে বহুমুখী কর্মকাণ্ড, সে সবই নিজের আগ্রহে, প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই মনের আনন্দে করা। বেনারস গিয়েই নতুন টাঁকশালের ছিরিছাঁদহীন পরিকল্পনা দেখে বিরক্ত হয়ে নিজে নকশা করে পাঠালেন কলকাতায়। কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে একই খরচে সে কাজ করেও ফেললেন সুষ্ঠু ভাবে। তৈরি করলেন গথিক শৈলীর সেন্ট মেরি’জ় চার্চ, যা উদ্বোধন করেন বিশপ হেবার। বেনারসের রাজার প্রাসাদ নন্দেশ্বর কোঠি তৈরি করা ছাড়াও পঞ্চগঙ্গা ঘাটে ঔরঙ্গজেব মসজিদের প্রায় দেড়শো ফিট উঁচু মিনার দু’টির অবস্থা বিপজ্জনক হয়ে উঠলে বিস্ময়কর দক্ষতায় তা পুনর্নির্মাণ করেন তিনি। এই পর্বে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কর্মনাশা নদীর উপর সেতু নির্মাণ। প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, কর্মনাশার জল স্পর্শ করলে তীর্থের পুণ্য নষ্ট হয়। সে জন্য তীর্থযাত্রীদের অনেক ঘুরপথে কাশী আসতে হত। ১৮২৯ সালে বেনারসের রায় পাটনি মল সেতু তৈরির খরচ দিতে রাজি হলে প্রিন্সেপ নিজে এর দায়িত্ব নেন। তাঁরই পরিকল্পনায় সেতু তৈরি হয়, কিন্তু এই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে এক বারও তিনি নিজের কথা উল্লেখ করেননি। কলকাতা থেকে বেনারসের পথে এই সেতু খুলে দেওয়া হয় ১৮৩১ সালের জুলাই মাসে, প্রিন্সেপ তখন কলকাতায়।
বরুণা আর অসি নদীর মাঝে গঙ্গার অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁকের উপর বেনারসের অবস্থান। প্রিন্সেপের সময় শহর মাইল তিনেক লম্বা আর মাত্র এক মাইল চওড়া। প্রিয় শহরটাকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুঁটিয়ে দেখেছিলেন প্রিন্সেপ। একাধিক বদ্ধ জলা শহরের পরিবেশ কী ভাবে দূষিত করছে, বুঝেছিলেন সেটাও। শহর জুড়ে নিকাশি ব্যবস্থার পরিকল্পনা করলেন তিনি, এমনকি শহরের জমা জল গঙ্গায় বার করে দেওয়ার জন্য চার-পাঁচ তলা বাড়ির নীচ দিয়ে ৭০০ ফুট টানেল তৈরি হল। তখনকার প্রযুক্তিতে ইটের খিলান করে টানেল তৈরি করতে গিয়ে একটা বাড়িও কিন্তু ভেঙে পড়েনি! সেই সময় এ দেশে আর কোথাও এমন নিকাশি ব্যবস্থা ছিল না। বদ্ধ জলা পরিষ্কার করে অনেক জমি উদ্ধার করে বাজার, বাগান ইত্যাদি তৈরি করান প্রিন্সেপ। শহরের মানুষ কৃতজ্ঞ হয়ে তাঁকে এই জমির একাংশ দিতে চেয়েছিল, তিনি বাজার তৈরির জন্য সে জমি শহরকেই উপহার দেন।
১৮২২ সালে সরেজমিন সমীক্ষার ভিত্তিতে বেনারসের প্রথম পশ্চিমি রীতির মানচিত্র তৈরি করেন প্রিন্সেপ, যা আজও অমূল্য আকর। সেই সঙ্গে সঙ্কলন করেন শহরের এক ডিরেক্টরি, যেখানে আছে প্রধান বাসিন্দাদের পরিচিতি-সহ তালিকা। বেনারসের যথাযথ জনগণনা তিনিই প্রথম করান— এ সবই নিজের খরচে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য উদ্ভাবন করেন নানা রকম যন্ত্র, তার মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য পাইরোমিটার অন্যতম। এটি উদ্ভাবনের জন্য লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি তাঁকে কনিষ্ঠ ফেলো মনোনীত করে, তখনও তাঁর ত্রিশ বছর হয়নি। আর তাঁর আঁকা বেনারসের ছবি, যা ‘বেনারস ইলাসট্রেটেড’ নামে ১৮৩১-৩৩ সালের মধ্যে লন্ডন থেকে লিথোগ্রাফ করে ছাপা হয়, তা সেই সময়ের এক আশ্চর্য দলিল।
কলকাতায় এসে এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে প্রিন্সেপের কাজের ব্যাপ্তি অন্য মাত্রা পেল। সোসাইটির নিজস্ব জার্নাল চালু করলেন। সারা দেশ থেকে আসতে শুরু করল বিচিত্র অনুসন্ধানের ফলাফল— পুরাতত্ত্ব থেকে প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদতত্ত্ব থেকে আবহবিজ্ঞান, প্রাচীন লিপি ও মুদ্রা— কত কী। শেষ দু’টিতে প্রিন্সেপের বিশেষ আগ্রহ। পূর্বজদের কাজ নিঃসন্দেহে তাঁকে এগোতে সাহায্য করেছে, কিন্তু প্রাচীন ব্রাহ্মীর পাঠোদ্ধারে চূড়ান্ত সাফল্য এসেছে তাঁর হাতেই। লিপির ‘পিয়দসি’ যে মৌর্য সম্রাট অশোক, টার্নারের এই অনুমান তিনি সুনিশ্চিত করেন, এবং তাঁরই গবেষণার ফলে অশোকের কাল চিহ্নিত করা সহজ হল। খরোষ্ঠী লিপির পাঠোদ্ধারেও তিনি অনেকটা সাফল্য পেয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অনেক জট তাঁর জন্যই কেটেছে। এর মধ্যেই মুদ্রা-সংস্কার করেছেন, সারা দেশে সমমানের মুদ্রা চালু করেছে কোম্পানি। হুগলি নদী থেকে সার্কুলার খাল খননের কাজ তিনিই সম্পূর্ণ করেন।
অতিরিক্ত পরিশ্রমে অসুস্থ হয়ে ১৮৩৮ সালের অক্টোবরে কলকাতা ছাড়েন জেমস প্রিন্সেপ। লন্ডনে গিয়েও কোনও উন্নতি হয়নি, তিনি প্রয়াত হন ১৮৪০ সালের ২২ এপ্রিল। কলকাতায় খবর পৌঁছয় জুন মাসে। শহর এই সর্বজনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল, আদ্যন্ত সৎ এবং পরোপকারী বিদেশিকে ভোলেননি। সাধারণ মানুষের চাঁদায় এক বছরের মধ্যে তৈরি হল প্রিন্সেপ ঘাট, পরবর্তী প্রায় সাত দশক যাবতীয় বিশিষ্টজনের আনাগোনা এই ঘাটেই হয়েছে।
এই ক্ষণজন্মা প্রতিভার ২২৫ বছর পূর্তিতে এশিয়াটিক সোসাইটি বিশেষ পত্রিকা সংখ্যা প্রকাশ করছে। পি টি নায়ারের লেখা তাঁর জীবনীটিও ফের ছাপা হয়েছে। আশা করা যায়, বিস্মৃত মনীষার এই পুনর্মূল্যায়নে ঔপনিবেশিকতার বহুমাত্রিক চরিত্র নবপ্রজন্মের কাছে কিছুটা স্পষ্ট হবে।