অতিমারির কারণে সারা দেশেই শিক্ষার যে অভূতপূর্ব ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে বহু মানুষ কমবেশি উদ্বিগ্ন। এমতাবস্থায় পঠনপাঠনকে কোভিড-পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এই মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন কাজ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিংবা সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় অনেক শিক্ষক ও সমাজমনস্ক মানুষ সীমিত পরিসরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শিশুকিশোরদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রাখতে, যা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। এ রকম সংবাদ যে সংবাদপত্রের পাতায় মাঝেমাঝেই স্থান পাচ্ছে তা দেখে ভাল লাগে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয় শিক্ষার রূঢ় সত্যটি হল কোভিডের ধাক্কার আগেও এ রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছতে পারেনি, অন্য রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে থেকেছে। তার সঙ্গে যদি এখন অতিমারির ক্ষতিকে একত্রে দেখি, তা হলে সঙ্কটের গভীরতার প্রকৃত ছবিটি পাওয়া যাবে। কোভিডের আগেও প্রতি বছর ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশ যে শিক্ষার অঙ্গন থেকে অকালে বিদায় নিচ্ছিল, এই জরুরি কথাটি স্পষ্ট বলা প্রয়োজন। রাজ্যের জনগণ যে শিক্ষায় ভারী দিগগজ ছিল এই সে দিনও, অতিমারি এসে সব্বোনাশটা করল, এই ভ্রান্ত ধারণার বেলুনটি এক লহমায় চুপসে যেতে পারে তথ্যের দিকে তাকালে।
বঙ্গবাসীদের মধ্যে উচ্চ-প্রাথমিক থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ করছে কত জন, তার পরিসংখ্যান থেকে কিছু উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু তা আলোচনায় আসেনি তেমন। আমাদের দুর্ভাগ্য, শিক্ষক নিয়োগ বা বদলি-সংক্রান্ত খবর সংবাদ-পরিসরকে যতটা সরগরম রাখে, শিক্ষা ও শিক্ষণ ততটা নয়, শিক্ষার সর্বজনীনতা তো নয়ই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার সর্বজনীনতার দিকে অগ্রগতি যে ভাবেই মাপা হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে এর শম্বুকগতি নজর এড়াবে না। প্রসঙ্গত, প্রাথমিক স্তরে শিশুদের বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তি প্রায় সম্পূর্ণতা ছুঁয়ে ফেলেছে বেশ কিছু কাল আগেই, অন্য সব রাজ্যের মতোই। এ রাজ্যের যে কোনও অঞ্চলের যে কোনও প্রাথমিক শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়, প্রাথমিকে ভর্তি হয়নি বা ভর্তি হলেও পঞ্চম শ্রেণির আগে ছেড়ে দিয়েছে এমন শিশু এখন এ রাজ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। এর সমর্থন পাওয়া যায় অ্যানুয়াল সার্ভে অব এডুকেশন রিপোর্ট (সংক্ষেপে ‘এসার’) থেকেও। আর এখান থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়-শিক্ষা নিয়ে ভ্রান্ত সন্তুষ্টিরও জন্ম দেয়। চাপা পড়ে যায় অন্য সত্যটি, যা হল এ রাজ্যে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুটের সংখ্যা কমেছে অতি ধীরে, অধিকাংশ রাজ্য বা সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায়।
জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (সংক্ষেপে, এনএসএস) পরিসংখ্যানকে যথেষ্ট নির্ভরশীল সূত্র বলেই ওয়াকিবহাল মহল জানে। ২০১৭-১৮ সালে করা একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের পুরুষদের মধ্যে মাত্র ৩৩.৫ শতাংশের মাধ্যমিক বা উচ্চতর ডিগ্রি আছে। যা শুধু সর্বভারতীয় গড়ের থেকে কম তা-ই নয়, যে কোনও রাজ্যের থেকে নীচে। যে কোনও রাজ্যের থেকে? বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের থেকেও? হ্যাঁ। তবে এর মধ্যেই কিঞ্চিৎ আলোর রেখা আছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে খানকয়েক রাজ্য পাচ্ছি যারা এ বাবদে পশ্চিমবঙ্গের নীচে। অর্থাৎ, শিক্ষিতের হার-এ মহিলা ও পুরুষের বৈষম্য এ রাজ্যে অন্য বেশ কিছু রাজ্যের তুলনায় কম। একে নারীশিক্ষার অতিমাত্রিক অগ্রগতি হিসাবে দেখব, না পুরুষদের শোচনীয় ভাবে পিছিয়ে পড়া বলব?
পনেরো-ঊর্ধ্ব সবাইকে হিসাবে ধরলে ষাট-সত্তর-আশি বছর বয়স্কও থাকছেন তার মধ্যে। কেউ বলতে পারেন, সে তো দূর অতীতের কথা, বহু কাল আগেই তাঁরা স্কুল-কলেজে যাওয়ার বয়স ফেলে এসেছেন। এখনকার ছেলেমেয়েরা কেমন করছে, সেটা বলুন। ধরা যাক উচ্চ মাধ্যমিকের কথা। একাদশ বা দ্বাদশে যত ছাত্রছাত্রী বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত আছে সেই সংখ্যাকে রাজ্যে ১৬-১৭ বয়সিদের মোট সংখ্যার শতাংশ হিসাবে দেখলে যা পাব, তাকে বলে ‘গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিয়ো’, সংক্ষেপে জিইআর। উল্লিখিত এনএসএস-এর তথ্য থেকেই পাচ্ছি পশ্চিমবঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকে জিইআর ৫৪.৪ শতাংশ। আর গোটা দেশে? ৭০.৩ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক-পরবর্তী স্তরেও মোটামুটি একই চিত্র: সর্বভারতীয় জিইআর পশ্চিমবঙ্গের জিইআর-এর তুলনায় অনেকটাই বেশি। এনএসএস সমীক্ষা নিয়ে সন্দেহ থাকলে অন্য সূত্রও দেখে নেওয়া যেতে পারে। যেমন, ২০১৯-২০’র অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশন দেখাচ্ছে, সমগ্র ভারতে উচ্চশিক্ষায় পুরুষদের জিইআর যেখানে ২৬.৯ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে তা ২০.৩ শতাংশ, নীচের দিক থেকে চার নম্বরে।
আন্দাজ করতে পারছি, অনেকেই বলবেন, ছেলেরা পড়তে না চাইলে কী আর করা যাবে? স্কুল কলেজে অনর্থক সময় নষ্ট না করে রোজগারের চেষ্টা করছে, সে তো ভাল কথা। কিন্তু, তামিলনাড়ু, কেরল থেকে মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ— সর্বত্র ছেলেরা আরও কয়েক বছর পড়তে চাইছে আর শুধু পশ্চিমবঙ্গেই চাইছে না, এ তো ভারী আজব কথা! আবার কেউ বলতে পারেন, অনেক রাজ্যেই দেখবেন ছেলেরা পাশ করে বেরোলেও শিখছে না তেমন। সে তত্ত্বও টেকে না। শিক্ষা-সক্ষমতার পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীরা কোথাও কোথাও এগিয়ে থাকলেও (এসার-এর এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যা নিয়ে খবরও হয়েছে) তার প্রকৃত কারণ সম্ভবত অন্য, সংখ্যাতত্ত্বের অতি সরল অঙ্ক। অধিক সংখ্যক ছাত্রছাত্রী, বিশেষত আর্থ-সামাজিক ভাবে প্রান্তিক পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েরা, শিক্ষাঙ্গন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে মাঝপথে। তাই বাকিদের শিক্ষা-সক্ষমতার গড় কিছুটা বেশি হওয়ার কথা, যে হেতু যারা বাইরে রইল, তাদের সক্ষমতা সামগ্রিক গড়ের থেকে কম হবেই। অর্থাৎ, শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি যত সম্পূর্ণতার দিকে যাবে সামগ্রিক সক্ষমতার গড় মান প্রথম দিকে খানিকটা কমতেই পারে। কিন্তু অন্তর্ভুক্তি অসম্পূর্ণ রেখে গড় মানের উচ্চতা নিয়ে শ্লাঘা বোধ করা নির্বুদ্ধিতা।
মাধ্যমিক শিক্ষা থেকেই ছেলেরা সরিয়ে নিচ্ছে নিজেদের, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ ভাবে এ এক গভীর সামাজিক সমস্যা। শিক্ষার স্বল্পতার কারণে কাজের বাজারের শ্রেণিবিন্যাসে তাদের জায়গা হচ্ছে নীচের দিকে। যদি ধরে নিই দারিদ্রের জন্যে শিক্ষা বেশি দূর এগোচ্ছে না (যা পুরোপুরি সত্যি নয়), আবার শিক্ষা অসম্পূর্ণ বলে কাজের বাজারে সুবিধা হচ্ছে না, যার ফলে দারিদ্রমুক্তিও হচ্ছে না, এ রকম একটা দুষ্টচক্রের মতো ব্যাপার হচ্ছে। যে কোনও সমস্যার সমাধানের রাস্তা খুঁজতে গেলে প্রথম কর্তব্যটি হল সমস্যাটি যে আছে, তা যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে স্বীকার করা। লিঙ্গবৈষম্য বিষয়ে অভ্যস্ত ভাবনায় মেয়েদের শিক্ষার কথাই অগ্রাধিকার পায়, কারণ শিক্ষা যে সক্ষমতা দেয় তা জীবনের অন্য মাত্রাগুলিকেও টেনে তোলে, নারীপুরুষের মধ্যে সুযোগের সমতা অভিমুখে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সাইকেল বিতরণ থেকে কন্যাশ্রী প্রকল্পের লক্ষ্য হয় মেয়েরা। সেখানে ভুল নেই। কিন্তু ছেলেরা অধিক সংখ্যায় বিদ্যালয়-ছুট হওয়ার ফলে মেয়েদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে, এও কাম্য হতে পারে না। বুঝতে অসুবিধা হয় না, পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার কারণগুলি মেয়েদের আর ছেলেদের ক্ষেত্রে অনেকটাই আলাদা।
কারণের কথায় অনেকেই বলেন শিক্ষার সুফল যদি কেউ ভবিষ্যৎ যাপনে দেখতে না পায় তা হলে পড়বে কেন? ‘লাভ’ কী? কথাটি বিভ্রান্তিকর। পড়ে একেবারেই লাভ নেই এ কথা কোনও মা-বাবাই মনে করেন না। যে কোনও ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকেই তা স্পষ্ট। তা হলে? লাভের হিসাবটিকে যদি ‘নিট লাভ’ ধরে দেখি— অর্থাৎ শুধু সম্ভাব্য প্রাপ্তির দিকে না দেখে ব্যয়কেও হিসাবে ধরি তা হলে সমস্যাটির গোড়ায় পৌঁছনো যায়। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও সত্যিটা হল পশ্চিমবঙ্গে স্কুলশিক্ষা-অর্জন এমন ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে যে, তা অনেক পরিবারের হিসাবে শিক্ষার সম্ভাব্য প্রাপ্তিকে ছাড়িয়ে গেছে। আর তার কারণ প্রাইভেট টিউশন। সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার খরচ যে শূন্য শুধু তা-ই নয়, মিড-ডে মিল থেকে সাইকেল এমন বিভিন্ন উপায়ে প্রাপ্তির দিকটিকেও বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু শুধু প্রাইভেট টিউশনের ব্যয়ভার যাবতীয় ভর্তুকির প্রভাবকে একেবারেই চাপা দিয়ে দিচ্ছে। প্রাইভেট টিউশন কি অন্য রাজ্যে নেই? আছে, তবে এ রাজ্যের মতো সর্বাত্মক নয়। টিউশন না দিতে পারলে পড়া চালিয়ে যাওয়ার মানে হয় না— এমন ভাবনা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আর কোথাও দেখা যাবে না। তবে কি এ বার টিউশনের খরচেও ভর্তুকির কথা ভাবতে হবে?
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা