তামিলনাড়ু, কেরল কিংবা রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ অথবা উত্তর পূর্বাঞ্চলে কই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এত হিংসা ছড়ায় না!
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সঙ্গেই হিংসার একটা যোগ আছে। আজ নয়, চল্লিশ বছর আগে থেকেই…
ছিল বলে রয়েই যাবে? পরিস্থিতি বদলাবে না?
দায়ী তো আপনারা। আপনাদের নেতাদের তীব্র উস্কানিমূলক ভাষণই পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করেছে…
গরম ভাষণ আপনারা দেননি? তা ছাড়া ভাষণের বদলা বাড়ি জ্বালিয়ে, দোকান লুট করে নিতে হবে?
এক পক্ষের লোকই করেছে, কে বলল? আমাদেরও অনেকে মারা গিয়েছে, আহত হয়েছে। আর তার কারণ আমরা প্রায় তিন কোটি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছি আপনারা মানতে পারছেন না।
আমরা সওয়া দু’কোটির বেশি ভোট পেয়েছি। অন্যরাও কিছু পেয়েছে। সবাইকে মেরে ফেলবেন?
কেউ কাউকে মেরে ফেলছে না।
ইতিমধ্যেই পনেরো জনের বেশি…
ফেক ভিডিয়ো দেখিয়ে যা খুশি বললেই তো মেনে নেব না! হ্যাঁ, বিক্ষিপ্ত কয়েকটা ঘটনা ঘটছে, সেটা দুর্ভাগ্যজনক।
ফেক? মানিকতলায় যে ছেলেটি খুন হল, অসুস্থ কুকুর ঘরে এনে সেবা করত, ওকে সবাই চিনত…
বর্ধমানে আমাদের এক জন খুন হয়েছেন, রোজ কুড়িটা গরিব শিশুকে নিজের খরচে খাওয়াতেন…
— টিভির পর্দায় এই তর্কের দৃশ্য আর দেখতে মন চায় না, মৃত দুটো লোকের কথা মাথায় ভিড় করে, এক জন রাস্তা থেকে অসুস্থ কুকুরদের তুলে এনে খাওয়াতেন আর এক জন গরিব শিশুদের মধ্যে টিফিন বিলি করতেন! দু’জন দুটো ভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করতেন। সেটা কি গৌণ নয়, মুখ্য কি এটাই নয় যে দুজনই খুব সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন?
অথচ, একটা রাজনৈতিক খোলসের মধ্যেই থাকতে হবে, সেই প্রাক্শর্ত মেনে যে-কোনও কথা শুরু বা শেষ করার নিয়ম এখন। টক-শো থেকে চায়ের দোকান বা সমাজমাধ্যম, ‘অন্য সবাই মন্দ বটে, নিজে তো কেউ মন্দ না’। অতএব কোভিডের সর্বনাশের ভিতর অতিরিক্ত সর্বনাশ যাদের ঘটল, দোষ তাদেরই। তারা কেন বোঝেনি, উঁচু তলার অবিমৃশ্যকারিতার দায় নিচু তলাকেই চোকাতে হয়?
অঙ্কটা সহজ। কোনও দলের বুথ-এজেন্ট যদি গেটে কেয়ারটেকার বসে থাকে এমন কমপ্লেক্সের তিন নম্বর বাড়িটার পাঁচতলায় থেকে থাকে, সে আপাত-নিরাপদ। কিন্তু সে যদি গলি দিয়ে ঢুকে বাঁ হাতের অ্যাসবেস্টসের চাল আর দরমার বেড়ার বাসিন্দা হয়? লাথিটা পড়ে তাদের দরজাতেই যারা শুধু ‘পরাজিত’ নয়, ‘দরিদ্র’ও। অবস্থা যাকে আধমরা করে রেখেছে, ব্যবস্থা তাকে ‘মরা’ বানিয়ে ছাড়ে।
সেই ব্যবস্থা পাল্টানোর কথা শোনা যায় না কেন? না, এখানে কোনও রাষ্ট্রবিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে নেহাতই কাণ্ডজ্ঞানের কথা। এখানে বলা দরকার, পশ্চিমবঙ্গে যদি অপার শান্তি বিরাজ করত তা হলেও এক কিংবা দুই দফায় নির্বাচন করানো যেত না, কারণ এক লাখের বেশি বুথে এক লপ্তে নির্বাচন করাতে যত সরকারি কর্মী দরকার, কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে এখানে তত কর্মী নেই। তাই বহু মানুষকে (কো-মর্বিডিটি থাকলেও) দু’বার-তিন বার করে ভোটের ডিউটিতে যেতে হয়েছে। এ বার, ধরা যাক, আপনি তাঁদের এক জন। দু’-দু’বার প্রিসাইডিং বা পোলিং অফিসার হয়ে আপনার কানে এসেছে বুথের ভিতরকার ফিসফাস, “রেজ়াল্ট বেরোলে পরে বোঝাই যাবে কার ভোট কোন দিকে পড়েছে।”
মানেটা স্পষ্ট। গ্রামের একটি বুথে ছ’শো ভোটার মানে কমবেশি একশোটা বাড়ি। পঞ্চাশটা ভোট যদি এ-দিক থেকে ও-দিক হয়, কোন বাড়ির কতগুলো লোক কোন বোতাম টিপেছে, বার করা জলভাত! আগে সব ব্যালট এক সঙ্গে মিশিয়ে গোনা হত, তাই একটি মহল্লার খুঁটিনাটি কারও হাতে আসত না। এখন আসে এবং তা হিংসায় ইন্ধন দেয়। নির্বাচিত বিধায়ক জয়ের আনন্দে উদার হয়ে সবাইকে মিলেমিশে থাকতে বলতেই পারেন, বুথ-স্তরের কর্মী ততটা উদার হবেন কী করে? আসছে মিটিংয়ে চারশো বুথের মধ্যে ‘লিড’ না আনতে পারা একশো দশটা বুথের এক জন হিসেবে টিটকারি শুনতে হবে না? তখন তাঁর মনে পড়তে বাধ্য কাকে কী পরিষেবা তিনি দিয়েছিলেন বছরভর আর তার পরও…
আদ্যিযুগে ফিরে না গিয়েও প্রতিহিংসা জন্মানোর আঁতুড়ঘরটিকে ভেঙে ফেলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীর খাতা থেকে নামের জায়গা ছিঁড়ে আলাদা করার ব্যবস্থা আছে। খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা নির্বাচকের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠায় লেখকের নাম গোপন রেখে। কেন করা হয় এগুলো, নিরপেক্ষ বিচারের জন্যই তো! তা হলে একটা বিধানসভা কেন্দ্রের তিনশোটা ইভিএম-এর ঠিকানা গোপন রাখা যায় না কেন? গোবর্ধনপুরের হর্ষবর্ধনের পরিবার কাকে ভোট দিয়ে থাকতে পারে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার দরকার আছে কি?
মণ্ডন মিশ্র শঙ্করাচার্যের কাছে তর্কযুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এখন চায়ের দোকানেও দুই তার্কিকের এক জন যদি বলে, “ঠিকই বলেছিস, ভুল আমারই”, জয়ীর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে: “ও হার মেনে নিল কেন?” আরে মশাই, সমর্থক মাত্রেই কি অভিমন্যু না কি যে, মরবে কিন্তু হারবে না? আপনার রাগ আপনি নেতার উপর ঝাড়ুন! সেই ছেলেটাকে মারছেন কেন, যে আপনাকে অক্সিজেন পৌঁছে দিয়েছিল? কেন মারবেন সেই মিষ্টির দোকানের মালিককে, যাঁর রসগোল্লা খেয়ে আপনার বোনের বিয়ের বরযাত্রীরা ‘বাহ্ বাহ্’ করেছিল? কী অপরাধ করেছে লোন করে শাড়ির দোকান দেওয়া মেয়েটা, যে সামান্য লাভ রেখে আপনাদের বিবাহবার্ষিকীতে আনন্দের ভিয়েন আরও ঘন করে দিয়েছিল? সার্বিয়ার এক কবির সেই দু’টি লাইন আপনিই তো পড়িয়েছিলেন: “শত্রু খুঁজতে বেরিয়েছি যতবার, ততবার একটা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি!”
আপনার সঙ্গে এক মিছিলে, এক মঞ্চে যে থাকতে পারেনি, মেনে নিলাম, সেই লোকটা খুব খারাপ! আপনি তো ভাল। প্রতিপক্ষের অশীতিপর মাকে কেউ মারতে এলে আপনি বাঁচাবেন না? যে শূন্য হয়ে গিয়েছে সেও যে পূর্ণেরই সন্তান, মনে করানোর দায়িত্ব আপনার নয়? শাসক আর বিরোধীর অবস্থান তো স্বৈরতন্ত্রেও থাকে, শাসক আর বিরোধী(দের) সহাবস্থানের নামই গণতন্ত্র।
“আজকে যে রক্তজবা/ কালকে তারই স্মরণসভা”, পিঠে লিখে পথে বেরিয়ে পড়েছে একটি অটো। আপনার ওই গল্পটা আবার শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। আপনিই ভুলে গিয়েছেন? শুনুন তবে। নিউ অর্লিন্স, সান ডিয়েগো ইত্যাদি বেশ কিছু শহরে ছোট মাঝারি রেস্তরাঁর বেশির ভাগ চালায় ভিয়েতনামের মেয়েরা। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের স্বামী আমেরিকান, যাঁদের অনেকে প্রাক্তন যোদ্ধা। ভিয়েতনামের মেয়েরা আমেরিকার কোনও আহত সৈনিক বন্দি হলে আন্তরিকতার সঙ্গে শুশ্রূষা করত, বহু ওয়ার ভেটারান তিন বছর, পাঁচ বছর, সাত বছর পর ভিয়েতনামে ফিরে গিয়ে সেই মেয়েটার মতো অন্য একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গী করে ফিরে এসেছে; অনেক আমেরিকান-ভিয়েতনামিজ় সংসার পল্লবিত হয়েছে আমেরিকার এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্তে। সেই সব সংসারে বোমা-গুলির শব্দ নেই, শুধু বাচ্চাদের খলবল শোনা যায়।
গল্প সব সময়ই তার স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে। বলতে বলতেই তাই ওই কবিতাটার কথা মনে পড়ে, “আমাকে যে খুন করে তার সঙ্গে প্রায়শই হয় সাক্ষাত/ সেও তো আমিই কারণ আমার বুকের রক্তে ভিজে আছে তার দুই হাত।”
আপনার হাতে আমার জন্য এক গেলাস জলই আছে আমি জানি। বড় তেষ্টা পেয়েছে। একটু হাতটা বাড়াবেন?