দিল্লির উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। দেশকে কী ভাবে আমূল বদলে দেওয়া যায় সেই বিষয়ে বক্তব্য পেশ করতে উঠে নীতি আয়োগের এক পদস্থ কর্তা বললেন, মেয়েরা যদি কর্মী-সংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশ হতেন তবে দেশের আয় বেড়ে যেত কয়েক লক্ষ কোটি। আরও মেয়ে কর্মী চাই। সবার চোখেমুখে ‘তালিয়াঁ তালিয়াঁ’ বলার মতো দিব্যভাব! চিরন্তন ফাটা কাঁসর আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “তার আগে বুঝতে হবে না, যথেষ্ট সংখ্যায় মেয়েরা কাজে না আসার পিছনের কারণগুলো কী?”
আইনশৃঙ্খলার দুরবস্থা, সন্তানকে অফিসে বা ক্রেশে রাখার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকা, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির প্রতিকার না হওয়া, অফিসে পথে শৌচাগার না থাকা— বিশ্রামকক্ষের তো প্রশ্নই নেই। মঞ্চে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সামনে এই দেশনিন্দায় অপ্রস্তুত সকলে। অন্য কারও মুখে কথা নেই, বিষয়ান্তরে চলে গিয়ে মান বাঁচালেন স্মার্ট অফিসার। বিশ্ব শ্রম সংস্থার খবর অনুযায়ী, ২০০০ সালে ৩৪ শতাংশ থেকে ২০১১-য় কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যোগদান নেমেছে ২৭ শতাংশে। তার জন্য যে কেবল উপরের কারণগুলি দায়ী, তা বলা যায় না। পারিবারিক কারণও আছে। পরিবারে মাথাপিছু আয় বাড়তে থাকলে, বাইরের কাজ ছেড়ে মেয়েরা ঘরের ভিতর চলে যান। মানে, ঘরের ভিতর ডেকে নেওয়া হয় তাঁদের।
নিজের লাগানো আগুনে দগ্ধ এক জন মহিলা চিকিৎসক, যিনি আবার এক অটিস্টিক সন্তানেরও মা— তাঁর মৃত্যুসংবাদে গভীর বেদনা আর ক্ষোভের সঙ্গে ভাবছিলাম, মেয়েরা কেন আরও বেশি সংখ্যায় আসেন না তার চেয়েও জটিল প্রশ্ন, মেয়েরা কেন কাজ করতে চান এবং কী ভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখেন কাজের ক্ষেত্রে? বিদ্যাসাগরের দু’শো বছরপূর্তির পর পরই এসে গেল স্বাধীনতার ৭৫ বছরপূর্তিও। আজও শিক্ষিতা শহরের মেয়েদের উপর থেকে এই সাঁড়াশি চাপ গেল না। তাঁরা ঘরের কাজ করলে তার দাম নেই। বাইরে কাজ করলে দোষ, তাঁরা সব কিছু চান! ঘরের কাছে পোস্টিং, অফিসে শৌচালয়, সন্তান জন্মের আগে ও পরে ছুটি, তার উপর পান থেকে চুন খসলেই হয়রানির অভিযোগ। এত সব যদি চাই তো ঘরে থাকলেই হয়?
আট বছরের অটিস্টিক সন্তানকে সহায়কের কাছে রেখে কাজে যাতায়াত করছিলেন যে মা, তাঁর প্রত্যাশা ছিল দীর্ঘ দিন বাইরে থাকার পর কলকাতায় পোস্টিং। পুনর্বার বাইরে পোস্টিং-এর আদেশ তাঁকে হতাশ করেছিল। সমালোচনা করা সহজ তাঁর আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের। অল্প দিনের মধ্যে পর পর নিকটজনদের হারানোর বিষাদ, অটিস্টিক সন্তান পালনের চাপ, না হলে এমন ভাবে কেউ মৃত্যু বেছে নেন? সাহসের অভাব যে এ নয়, তা বিলক্ষণ জানি। হয়তো চার পাশে ঘন হয়ে আসছিল অন্ধকার, নিকটজনকে হারিয়ে বেশি করে আঁকড়ে ধরছিলেন সন্তানকে, আবার তার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার বাধ্যতায় মেয়েটির পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছিল।
হাজার হাজার চাষি আত্মহত্যা করেন কোনও বিকল্প না দেখে, তবু শোনা যায় তাঁরা মানসিক ভাবে দুর্বল ছিলেন, না হলে নিজের জীবন কে নেয়?
এ দেশের কোনও সরকারি বেসরকারি দফতরে কর্মীদের ব্যক্তিগত সুবিধে-অসুবিধে বোঝার ব্যবস্থা থাকে না। পুরুষরা স্ত্রীর উপর দায়িত্ব দিয়ে দূরের চাকরি বজায় রাখতে পারেন। মেয়েদের, মায়েদের বিকল্প ব্যবস্থা থাকে না। অটিস্টিক শিশু মানেই মানসিক প্রতিবন্ধী নয়, অটিজ়ম সম্বন্ধে বিশেষ সচেতনতা নেই আমাদের শিক্ষিত বর্গেই। সাধারণ স্কুলে পরিকাঠামো নেই। এমনিতেই সন্তান প্রতিবন্ধী হলে তার দায়িত্ব অব্যর্থ ভাবে মায়ের উপর এসে পড়ে। কানাকানি হয়— গর্ভের দোষ না থাকলে কি এমন সন্তান হয়? শুনতে পাই, এমন কারণে বহু স্ত্রী পরিত্যক্ত বা বিবাহবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্তানকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন একার চেষ্টায়।
যে মৃত্যু প্রসঙ্গে এই সব কথার অবতারণা তার পিছনে এমন কিছু কারণ ছিল, তা বলতে চাইছি না। কিন্তু জলে ছোড়া পাথর যেমন ভেঙে দেয় প্রতিবিম্ব, তেমন অনেক কিছু যেন ভেঙে দুলে উঠল এই খবরটি পেয়ে। জানি না, তিনি বদলি রদের কোনও দরখাস্ত করেছিলেন কি না। তা কি কেউ পড়েছিলেন? কারও বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত তাঁর কাছে পৌঁছেছিল? যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পর কত মেয়েকে কাজ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, তার হিসেব আছে? আজও একটি মেয়ের শরীরে মনে জমে থাকে নিজেকে বয়ে নিয়ে চলার অপরিসীম ক্লান্তি। সন্তানধারণের, সন্তানধারণ না করার সিদ্ধান্তের। বিবাহজনিত দায়িত্বের, অবিবাহের সমালোচনার। অফিসে যাতায়াতের, খেতের বা ইটভাটার কাজের। জল আনা, কাঠ বওয়া, রেশন তোলা, বাজার করা, রোগীর সেবার, শিশুপালনের, খাবার সংগ্রহ করে জমিয়ে রাখার, পরিবার উৎখাত হলে তাকে আবার বসানোর। তার উপর শিশু যদি হয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, দায় পুরো মায়েরই উপর।
এই ক্লান্তির খবর কেউ রাখে না, তাঁর নিকটতম জনটিও না। এর উপর থাকে কর্মরতা মেয়ের জন্য ঘরে বাইরে বিদ্রুপ। কৃতী মেয়ের অবদানে উজ্জ্বল হয়ে আছে উচ্চশিক্ষার পরিসর। তাঁদেরও লড়াই অন্য মাত্রার। আর, সাধারণ এক মেয়েকে জবাবদিহি করতে হয় পরনের জিনস থেকে বাড়ি ফেরার দেরি— সব কিছু নিয়ে। অপরিষ্কার লেডিজ় টয়লেট থেকে শরীরে আসে সংক্রমণ। তাঁর টাকায় সংসার চলে, তবু তাঁর চাকরি করা শখেরই। শাড়ি, গয়না কেনার পকেটমানি।
মেয়েদের যাত্রা থামেনি, কিন্তু কেবল বেঁচে থাকার জন্য, একটু স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এত লড়াই কি সমাজের সভ্যতার পরিচয়? পরিবার, সমাজ, সরকার সকলে মিলে তাঁর চলার ক্লান্তি কি একটু কম করতে পারে না? তাতে কতই বা বেশি খরচ? পথে অফিসে শৌচাগার। বিশ্রামকক্ষ। ফিডিং রুম। শিশুর ক্রেশ। রাতের ডিউটিতে গাড়ির ব্যবস্থা। রাস্তায় পুলিশের গাড়ির টহল। অফিসে সচল যৌন হেনস্থা কমিটি। ঘরের কাছে পোস্টিং। কাজের জায়গায় হেল্পলাইন। মেয়েদের জন্য সুলভে গৃহঋণ। বাজারের ফর্দের মতো শোনাচ্ছে?
সরকার এগিয়ে এলে সমাজও আসবে।
অন্তত সেটাই আশা করছি। আসবে তো? যাঁরা গাড়ি চড়েন না, গণপরিবহণে যান, তাঁদের শারীরিক নিগ্রহ বন্ধ হবে ভিড়ের বাসে ট্রেনে? বলা বন্ধ হবে, না পোষায় তো ট্যাক্সিতে যান না? মেট্রোয় শিশুকে স্তন দেওয়া মায়ের ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে ঘিরে ধরবে না লোলুপ যুবকের দল? নিয়ন্ত্রিত হবে অ্যাসিডের বিক্রি? অনেক রাতে কাজ থেকে ঘরে ফেরা মেয়ের পিছু নেবে না নরশ্বাপদের দল? একা মেয়ে, সংখ্যালঘু মেয়ে, দলিত মেয়ে বাড়ি ভাড়া পাবেন? তবু হে পৌরুষদৃপ্ত রাষ্ট্র, ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির খোয়াব দেখা রাষ্ট্র, তুমি মেয়েদের পাশে এসে দাঁড়াও, অন্ধ মূক বধির হয়ে তামাশা দেখো না।
এত সব সত্ত্বেও মেয়েরা কেন এত কষ্টে কাজ আঁকড়ে থাকেন? সংসারখরচ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচের ভাগ দেওয়ার পরও তাঁরা কাজের জায়গায় বন্ধু পান, আয়নায় পান এক নতুন মুখ, অনেক সময়েই নিজের মেধা, শ্রম, ব্যবহার করে বেঁচে থাকার মানে। যার পোশাকি নাম ক্ষমতায়ন। কোনও মেয়ে সাধ করে মরতে চায় না, ঘরে নির্ভরশীল সন্তানকে রেখে। স্বাধীনতার বয়স যখন ৭৫ হল, মেয়েদের কি বাঁচতে দেওয়া যায় না আরও একটু স্বাচ্ছন্দ্যে— ক্লান্তিমোচনের সুবিধাযুক্ত, সমালোচনামুক্ত পৃথিবীতে?