নীতি আয়োগ ২০২০-র সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট রিপোর্ট প্রকাশ করল। ২০১৯ সালের এই প্রতিবেদনে ভারত সরকার স্বীকার করে যে, মেয়েদের কর্মিবাহিনীতে অংশগ্রহণ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ২০০৬-এ মেয়েদের শ্রমবাহিনীতে অংশগ্রহণ ছিল ৩৭% । ২০১৯-এ এই অংশগ্রহণ নেমে দাঁড়িয়েছে ১৮%-এ। ২০১৯-এ বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্যানুসারে প্রতিবেশী বাংলাদেশে এই পরিসংখ্যান ৩৬%-এরও বেশি। এমনকি পাকিস্তানও এই পরিসংখ্যানে ভারতের চেয়ে এগিয়ে। মেয়েদের শ্রমবাহিনীতে অংশগ্রহণের এই নিম্নগতির কারণে কেন্দ্রীয় সরকারকে যথেষ্ট সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সম্ভবত সেই কারণেই ২০২০-র প্রতিবেদনে এই ক্রমহ্রাসমান সংখ্যাকে চাপা দেওয়ার নানা ফন্দিফিকির লক্ষ করা যাচ্ছে। বলা হয়েছে, শ্রমবাহিনীতে যুক্ত মানুষের মধ্যে নারী পুরুষের অনুপাত এক জন পুরুষে ০.৩৩ জন নারী, যা অতিমারির আবহে অসম্ভব। উল্টো দিকে, ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’র তথ্য অনুসারে, অতিমারির পর নারী পুরুষ সকলের মধ্যেই বেকারত্ব বেড়েছে— ২০২০-র মে থেকে অগস্টের মধ্যে পুরুষের শ্রমবাহিনীতে অংশগ্রহণ ৬৭.৪% এবং মেয়েদের অংশগ্রহণ মাত্র ৯.৩%। লকডাউনের পরে, ২০২০-র অগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে যখন স্বাভাবিক জীবন শুরু হল, তখন ছেলেরা ছোট ব্যবসা, চাষ-আবাদ, পুরনো পেশা অথবা অন্য কাজে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু, মেয়েদের কাজে ফেরত আসার সংখ্যা খুবই নগণ্য।
অতিমারি আরও নানা দিক দিয়ে নারী জীবনে দুরবস্থা ডেকে এনেছে। সারা দুনিয়া যখন আন্তর্জালিক কাজে দক্ষতা বৃদ্ধি করছে, তখন ২০২১-এর মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে মাত্র ২৫% সাবালিকার নিজস্ব স্মার্টফোন আছে। জাতীয় মহিলা কমিশনের তথ্যানুসারে, মেয়েদের উপর পারিবারিক নির্যাতন অন্তত তিন গুণ বেড়েছে। নাবালিকা বিয়েও আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এহেন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে অকস্মাৎ সাত জন মহিলাকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নারীর লিঙ্গসাম্যের বড়াই করছেন। কিন্তু এ ভাবে কি লিঙ্গসাম্য সম্ভব?
বাস্তবে লিঙ্গসাম্য বিচ্ছিন্ন ভাবে হয় না। অন্যান্য বঞ্চিত অংশের মানুষের ক্ষমতায়নের সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত। নারীর অধিকারের প্রশ্নটিকে মানবাধিকারের অন্য মানদণ্ডগুলি থেকে আলাদা করার যে প্রচেষ্টা বর্তমানে রাষ্ট্রের মাথারা চালাচ্ছেন, তার মধ্যে গূঢ় ষড়যন্ত্রের আভাস। লিঙ্গসাম্য বিশ্ব জুড়েই প্রগতির মাপকাঠি। নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ দেখানো জরুরি। তাই পছন্দসই দলীয় অনুগামী মেয়েদের মন্ত্রী-সান্ত্রি বানানো হল। অথচ, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেনদের জামিন নাকচ হয়ে গেল, জেলের ভিতর জীবনধারণের ন্যূনতম পরিষেবাটুকুও দেওয়া হল না। প্রশ্ন হল, এতে কি মেয়েদের রাজনৈতিক কাজকর্মের অধিকারই খর্ব হল না? বিরোধী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলে মেয়েদের জামিন-অযোগ্য ধারায় বন্দি করা হবে, আর নিজেদের দলের সমর্থক মেয়েদের রাজনীতিকেই একমাত্র নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলে জাহির করা হবে— এ কেমন ধারা লিঙ্গসাম্য?
সমানাধিকারের প্রশ্নে নারীর বহুমাত্রিক পরিচিতির অন্তর্ভুক্তিও অবশ্যকর্তব্য। বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্র চালনার রশি যাঁদের হাতে, তাঁরা বিষয়টিতে কার্যত সুবিধাবাদী। হিন্দু উচ্চবর্ণের মেয়েরা অনেকেই হয়তো জাত ও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তুলনামূলক বেশি সুযোগ পান। তাঁদের এবং সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলিম এবং দলিত মেয়েদের জন্য গড়পড়তা একই ধারায় প্রকল্প রচনা করলে, সুবিধাভোগী মেয়েরাই সাধারণত বেশি সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ, বৈষম্য আরও বাড়বে। রূপান্তরকামী, ভিন্ন লিঙ্গ পরিচিতির এবং প্রতিবন্ধী মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সত্যিকারের লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ক্ষমতার সোপানতন্ত্রের নীচের দিকে অবস্থিত মেয়েদের জন্যও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
শেষ করা যাক রোশনিকে (নাম পরিবর্তিত) দিয়ে। রোশনির বিয়ে হয়ে যায় চোদ্দো বছরে। ছোট থেকে তাঁর স্বপ্ন ছিল, ট্যাক্সি চালাবে। যখন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দ্বারস্থ হলেন, তখন রোশনি তিন ছেলেমেয়ের মা। রোশনি স্থায়ী লাইসেন্স হাতে পাওয়ার পর থেকেই স্বামী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করলেন। ড্রাইভারের চাকরি পেতে সেই মারধর এবং সন্দেহ চরমে উঠল। থানা-পুলিশ করতে খানিকটা কমল অত্যাচার। কলকাতার নারী ট্যাক্সিচালক হয়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু ভাত-ডালের নিশ্চয়তার কিছু দিনেই এল কোভিড এবং লকডাউন। রোশনি আবার ঘরে বন্দি। স্বামীও স্বরূপ ধরলেন। রোজগার নেই, পারিবারিক নির্যাতন, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ। লকডাউন ওঠার পরও ট্যাক্সির বাজারে মন্দা রয়েই গেল, তায় পেট্রল অগ্নিমূল্য। এখনও রোশনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
রোশনি এবং তাঁর মতো মেয়েদের প্রয়োজন সরকারি সহায়তা। সংসার চালানোর টাকা, বাচ্চাদের জন্য স্মার্টফোন, ইন্টারনেট। জনধনের ৫০০ টাকায় তা হয় না। অতএব, রোশনিরা ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকেন শ্রমবাহিনী থেকে। তাঁদের শিশুরা হারিয়ে যেতে থাকে লেখাপড়ার বৃত্ত থেকে। এ সব দিকে নজর না দিয়ে যে রাষ্ট্র কয়েক জন মহিলা মন্ত্রী নিয়ে গলাবাজি করে, তার মুখে লিঙ্গসাম্যের বুলি ভাঁওতা বলে মনে হয়!