মেলাবেন, কেউ মেলাবেন?
Rahul Gandhi

বিরোধী জোটের মডেল: আগে কাজ করেনি, এ বার করবে কি

শুধু লোকসভা আসনের অঙ্ক কষে উপরে উপরে জোট করলে কোনও দিনই দুইয়ে দুইয়ে যোগ করে চার হবে না। আগে মানুষের এককাট্টা হওয়া দরকার।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২১ ০৫:২৬
Share:

যৌথ: বিরোধী নেতাদের প্রাতরাশ বৈঠকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী। নয়া দিল্লি। ৩ অগস্ট। পিটিআই

হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ সাধারণত হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। কিন্তু সে দিন তিনি এতটাই হতাশ ছিলেন যে, তিন মূর্তি লেনের বাড়ি থেকে সাংবাদিকদের ‘সরি’ বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, তাঁর বরাবরের ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ মুলায়ম সিংহ যাদব শেষ মুহূর্তে ডিগবাজি খেয়েছিলেন।

Advertisement

সালটা ১৯৯৯। অটলবিহারী বাজপেয়ীর ১৩ মাসের সরকারের পতনের পরে সনিয়া গাঁধীকে সামনে রেখে একটা ধর্মনিরপেক্ষ সরকার তৈরির চেষ্টা চলছিল। সূত্রধরের ভূমিকায় সুরজিৎ, সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৯৬-এর যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় থেকেই প্রায় এক দশক তাঁর প্রিয় কাজ ছিল বিজেপি-বিরোধী জোট তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু ১৯৯৯-এ শেষবেলায় বেঁকে বসেন মুলায়ম। সনিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠনে কংগ্রেসকে দাক্ষিণ্য দেখাতে তিনি রাজি হননি। অগত্যা ফের লোকসভা নির্বাচন এবং ভোটে জিতে বাজপেয়ী সরকারের প্রত্যাবর্তন।

জাতীয় রাজনীতিতে যে কোনও বিরোধী জোট তৈরির প্রথম ও প্রধান সমস্যাই হল এই বাঘ ও গরুকে এক ঘাটে জল খাওয়ানো।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির হারের পরে বিজেপি বিরোধী শিবির নতুন করে জোট নিয়ে উৎসাহিত। তৃণমূল নেত্রী দিল্লিতে জাতীয় স্তরে বিরোধী ঐক্যের প্রয়োজনের কথা বলেছেন। রাহুল গাঁধীও বিরোধী ঐক্য নিয়ে সক্রিয়। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন এখনও তিন বছর বাকি। প্রশ্ন হল, ভোটের আগেই কি বিরোধী জোট তৈরি হবে? না কি ভোটের পরে? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, আমজনতা কি আদৌ মোদী সরকারকে হটাতে হবে বলে মনস্থির করে ফেলবেন?

ইতিহাস বলে, ১৯৭৭-এ জরুরি অবস্থা পরবর্তী নির্বাচনে ও ১৯৮৯-এ বফর্স কেলেঙ্কারি পরবর্তী নির্বাচনের আগেই বিরোধী জোট তৈরি হয়েছিল। প্রথম বার ইন্দিরা গাঁধীর বিরুদ্ধে জনতা পার্টির নেতৃত্বে। দ্বিতীয় বার রাজীব গাঁধীর কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের রাষ্ট্রীয় মোর্চা। দু’বারই রাজনীতির হাওয়া-মোরগ জানান দিচ্ছিল, কংগ্রেস সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী। কংগ্রেসকে হটানোর বিষয়ে মানুষ মনস্থির করেই ফেলেছিলেন। জোট সরকারের স্থায়িত্ব কত দিন হবে, তা নিয়ে কেউ ভাবেননি। অন্য দিকে, ১৯৯৬-এ যুক্ত ফ্রন্ট বা ২০০৪-এ বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে ইউপিএ জোট তৈরি হয়েছিল নির্বাচনের পরে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ দশ বছর ক্ষমতায় থাকলেও, ১৯৭৭, ১৯৮৯ বা ১৯৯৬-এর জোট সরকার দু’-আড়াই বছরের বেশি টেকেনি।

এখানেই নরেন্দ্র মোদী জাতীয় রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন এনেছেন। তিনি মজবুত নেতৃত্ব, স্থায়ী সরকারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মানুষকে বোঝাতে পেরেছেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগেও একটা বিরোধী জোট তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। তা সফল হয়নি। মানুষের সামনে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনও মজবুত নেতৃত্বের মুখ বিরোধী জোটে ছিল না। লোকসভা ভোটের আগে রাজস্থানে অশোক গহলৌত, ছত্তীসগঢ়ে ভূপেশ বঘেল, মধ্যপ্রদেশে কমলনাথরা বিজেপির সরকার ফেলে দিয়েছিলেন। লোকসভা ভোটের পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত সোরেন, অরবিন্দ কেজরীবালরা নিজের নিজের রাজ্যে বিজেপিকে টেক্কা দিয়েছেন। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। এখনও সেই শূন্যস্থান বিদ্যমান।

এই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন রণকৌশলের কথা বলছেন— যে রাজ্যে যে দল বিজেপির বিরুদ্ধে শক্তিশালী, সেখানে তারা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বে। বাকিরা পূর্ণ সমর্থন জানাবে। অনেকটা লোকসভা নির্বাচনকে ভেঙে ভেঙে রাজ্যওয়াড়ি বিধানসভা নির্বাচন হিসেবে দেখা। এই রণকৌশলকে অঙ্কের হিসেবে ফেললে দেখা যাবে, গোটা দেশে ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে প্রায় ৩৭৫টি আসনে বিজেপির সঙ্গে বিরোধীদের জোর মোকাবিলা হয়। এর মধ্যে প্রায় ২০০টি আসনে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের সরাসরি লড়াই। বাকি ১৭৫টির মতো আসনে বিজেপির লড়াই নানা আঞ্চলিক দলের সঙ্গে। তৃণমূল নেত্রীর সূত্র অনুযায়ী, ওই ২০০টি আসনে আঞ্চলিক দলগুলি পুরোপুরি কংগ্রেসের পিছনে থাকবে। বাকি ১৭৫টিতে কংগ্রেস নাক গলাবে না।

শুনতে যত সহজ, এর বাস্তব রূপায়ণ ততটাই কঠিন। প্রথমত, লোকসভা ও বিধানসভা ভোট এক নয়। ভোটাররা এখন বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের ফারাক খুব সহজেই করতে পারেন। ওড়িশায় লোকসভা ও বিধানসভা ভোট একই সঙ্গে হয়েছিল। একই ভোটার লোকসভায় বিজেপিকে, বিধানসভায় বিজু জনতা দলকে ভোট দিয়েছেন। ২০১৮-য় রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেও, ২০১৯-এর লোকসভায় ওই সব রাজ্যের সিংহভাগ আসনে বিজেপি জিতে এসেছে। একই ভাবে বিজেপি দিল্লির লোকসভায় সব আসন জিতলেও, বিধানসভায় দাঁত ফোটাতে পারেনি।

দ্বিতীয় ও আরও বড় সমস্যা হল, কোন রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে কে শক্তিশালী, তা কে ঠিক করবেন? উনিশের লোকসভা নির্বাচনের ফল বলে, বিজেপি উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহারে সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছিল। চব্বিশের লোকসভা ভোটে কি কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টিকে, বিহারে আরজেডি-কে সব আসন ছেড়ে দিতে রাজি হবে? মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, এনসিপি, কংগ্রেস মতাদর্শগত ভাবে বিপরীত অবস্থানে থেকেও বিজেপিকে হটিয়ে জোট সরকার তৈরি করেছে। সেখানে কি এনসিপি, কংগ্রেস শিবসেনাকে ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দেবে?

কংগ্রেস আর আগের মতো শক্তিশালী নেই। মহারাষ্ট্রের জোট, তার আগে কর্নাটকে জেডিএসের সঙ্গে জোট করে সনিয়া-রাহুল গাঁধী বুঝিয়েছেন, বিজেপিকে হারাতে কংগ্রেস ছোট শরিকের ভূমিকা নিতেও তৈরি। কিন্তু তা বলে কি কংগ্রেসের পক্ষে উত্তরপ্রদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের সব আসন অন্যদের ছেড়ে দেওয়া সম্ভব? রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেস বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ হলেও এই সব রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক দল অল্পবিস্তর আসনে লড়ে। তারাও কি পুরোপুরি সরে দাঁড়াতে রাজি হবে? সে ক্ষেত্রে অন্য উপায় হল, ভোটের পরে জোট বাঁধা।

১৯৭৭-এর ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে জনতা পার্টির জোট, ১৯৮৯-এ ভি পি সিংহের রাষ্ট্রীয় মোর্চার সময়ও কংগ্রেস বিরোধী নেতাদের এই ধাঁধার মুখে পড়তে হয়েছিল। সিপিএম আনুষ্ঠানিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ভোট বিভাজন রুখতে তারা জনতা পার্টির বিরুদ্ধে প্রার্থী দেবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম জনতা পার্টিকে ৫২ শতাংশ আসন ছাড়তে রাজি হলেও, অনড় জনতা পার্টি দুই-তৃতীয়াংশ আসন দাবি করে। শেষে জ্যোতি বসু জনতার দরবারের হাতেই ফয়সালা ছেড়ে দেন। একই ভাবে ১৯৮৯-এর নির্বাচনের পরে বিজেপি ভি পি সিংহের সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু ভোটের আগে সিপিএম, বিজেপি একে অপরের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছিল। নির্বাচনের মাধ্যমেই পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম কংগ্রেসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছিল।

আবারও বলতে হয়, ১৯৭৭ ও ১৯৮৯, দুই নির্বাচনে মানুষই কংগ্রেসকে সরানোর বিষয়ে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। গত সাত বছরে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনীতির ঢিমে গতির মোকাবিলায় ব্যর্থতা থেকে হিন্দু-মুসলিম, উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করার অভিযোগ উঠেছে। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কোভিড মোকাবিলা, টিকার জোগানে অব্যবস্থা থেকে রুজিরুটির অভাব, পেট্রল-ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অভিযোগ। মোদী সরকারের মৌখিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কাজের ফারাক নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন। বিরোধীরা টের পাচ্ছেন, মানুষের মধ্যে অনেক অসন্তোষ। কিন্তু সেই অসন্তোষকে তাঁরা খুব যে পুঁজি করতে পেরেছেন, এমন নয়।

আগামী তিন বছর বিরোধীদের প্রধান কাজ তাই নিঃসন্দেহে মানুষের সমস্যা নিয়ে সরব হওয়া। শুধু লোকসভা আসনের অঙ্ক কষে উপরে উপরে জোট করলে কোনও দিনই দুইয়ে দুইয়ে যোগ করে চার হবে না। আগে মানুষের এককাট্টা হওয়া দরকার। বিরোধীদের বুঝতে হবে, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহও হাত গুটিয়ে বসে থাকার পাত্র নন। তাঁরাও মানুষের অসন্তোষ দূর করা বা আসল সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টায় কসুর করবেন না।

হাল না ছেড়ে, জোরে ‘কণ্ঠ ছাড়া’ই একমাত্র পথ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement