গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
জমজমাট অ্যাকশন সিনেমার দৃশ্যে যেমন দেখা যায় আর কী! ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে বন্দুকবাজের এলোপাথাড়ি গুলি! একের পর এক হত্যা! টপাটপ পড়ছে লাশ!
সিনেমার সে সব দৃশ্যে ভরপুর বিনোদন থাকে। কিন্তু অবিকল সেই দৃশ্যই যখন ভরদুপুরে শহরের ব্যস্ত মোড়ে উঠে আসে, তখন তাতে মিশে থাকে হাড়হিম করা অসহায়ত্ব আর জীবনের অনিশ্চয়তা। খবরের ওয়েবসাইট এবং চ্যানেলের ‘ব্রেকিং নিউজ’-এ শুরু হয় কাটাছেঁড়া, বিশ্লেষণ। ঠিক কোন পরিস্থিতিতে এক জন মানুষ এ ভাবে ধুমধাড়াক্কা গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেন নিরীহ পথচারীদের, শেষ করে দেন নিজেকেও?
কনস্টেবল চোডুপ লেপচা।
প্রশ্নটা অবধারিত ভাবেই ওঠে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘ভিলেন’ হিসাবে যে কারণটা উঠে আসে, তার পোশাকি নাম ‘ডিপ্রেশন’ অর্থাৎ ‘অবসাদ’। তা সে বহরমপুরে প্রেমিকাকে কুপিয়ে খুন করা সুশান্ত চৌধুরী হোক বা পার্ক সার্কাসে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ে আত্মঘাতী পুলিশকর্মী চোডুপ লেপচা— ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ হয়ে উঠে আসে এই অবসাদের তত্ত্ব।
গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
কিন্তু অঙ্কটা কি এতটাই সরল যে, প্রত্যেক বার উত্তরটা ‘শূন্য’ অথবা ‘এক’-এই এসে ঠেকবে? নাকি প্রাথমিক ভাবে অবসাদের ঘাড়ে বন্দুক রাখার কারণে চোখের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে একাধিক জরুরি দিক? প্রতি বার এক একটা বিশেষ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনার পর অভিযুক্তকে অবসাদগ্রস্ত বলে দেওয়ার কারণে এক দিকে যেমন ঘটনার গুরুত্ব লঘু হয়ে যায়, তেমনই মনস্তত্ত্ব ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটিও অবস্থানগত দিক থেকে খাটো হয়ে পড়ে। অভিযুক্ত যিনিই হোন না কেন, তাঁর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র না জেনে, তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোনও খবর না রেখে, তাঁকে ‘অবসাদগ্রস্ত’ তকমা দিয়ে দেওয়াটা কি আদৌ কাজের? আমরা কি খতিয়ে দেখব না তাঁর পরিপার্শ্ব, তাঁর অতীত, তাঁর আত্মিক সঙ্কটের বিষয়গুলি?
চোডুপের কথাই ধরা যাক। ব্যস্ত পার্ক সার্কাসের রাস্তায় বাংলাদেশ উপ দূতাবাসের আউটপোস্টে দায়িত্বরত ওই পুলিশকর্মীর এলোপাথাড়ি গুলিতে মৃত্যু হয় এক পথচারী মহিলার। আহত হন দু’জন। তার পর ওই রাইফেলের গুলিতেই আত্মঘাতী হন চোডুপ। এবং এর পরেই কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সম্ভবত অবসাদে ভুগছিলেন ওই যুবক!
প্রশ্নটা এখানেই। ঠিক কিসের ভিত্তিতে অবসাদের দিকেই আঙুল তোলা হল? চোডুপের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এ বহাল থাকাকালীনই নানা অসংলগ্ন আচরণ করেছিলেন। অসংলগ্ন আচরণ মানেই কি অবসাদ? মনোরোগের এলোপাথাড়ি প্রয়োগ, উপসর্গের মিশ্র স্যালাডের প্রবণতা নজিরবিহীন। সেই সময় পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁর কোনও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না, তার জবাব মেলেনি। তবে কালিম্পঙের বাসিন্দা চোডুপের পরিবার জানিয়েছে, তাঁর কোনও মানসিক সমস্যা ছিল না।
দু’টি পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যে কোনটি সঠিক? জানার উপায় আর নেই। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয়, চোডুপের কিছু মানসিক সমস্যা ছিল, তা হলে সেটি যে অবসাদ বা ডিপ্রেশনই, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে কী করে? স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা অন্য মানসিক রোগ থেকেও অসংলগ্ন আচরণ করতে পারেন কেউ। চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়েই সেই রোগকে অবসাদ বলে দাগিয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা মারাত্মক।
একটু অন্য পরিসরে তাকানো যাক। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দাদের ‘অপর’ করে রাখার বিষয়টি দীর্ঘ দিন ধরেই সমতলের মানুষদের মধ্যে চলে আসছে। সরু চোখ, চাপা নাক আর হালকা হরিদ্রাভ বর্ণ দেখলেই তাঁদের গড়পড়তা নেপালি বা আরও একধাপ এগিয়ে ‘চিনা’ বলে দেগে দেওয়ার অপকর্মটি সমতলের রক্তে। শহুরে সমতলের প্রচলিত ভাষায় ওঁরা সকলেই ‘চিঙ্কি’! অভিজাত মেট্রো শহরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষদের হেনস্থা করার ঘটনাও নেহাতই জলভাত! অন্য দিকে, ‘ব্ল্যাক লাইভ্স ম্যাটার’ আন্দোলনের মূলেই রয়েছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ। ঠিক যেমন মার্কিন মুলুকে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’-র জেরে লাঞ্ছিত হন রঙিন গাত্রবর্ণের মানুষেরা, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরেও তার কোনও ব্যত্যয় নেই!
দিনের পর দিন অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত হতে হতে মনের গভীরে জমে ওঠা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ কি এক দিন হতে পারে না এলোপাথাড়ি গুলির মধ্যে দিয়ে? চিরকাল লাঞ্ছনা করে-যাওয়া সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে বন্দুকের নল কি হয়ে উঠতে পারে না প্রতিস্পর্ধার ভাষা? একেবারেই অসম্ভব কি তা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক শ্যুটআউটে নির্বিচারে হত্যার ঘটনা তো মাঝেমাঝেই উঠে আসে সংবাদের শিরোনামে।
গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
এই যে মূলনিবাসী জনগোষ্ঠীগুলিকে ‘ক্ষমতা’-র আদারাইজ করা, এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণে তাঁদের ব্যবহার করার মধ্যে যে পরস্পরবিরোধ, ‘অবসাদ’-এর তকমার আড়ালে সেই প্রশ্নটাকে বেমালুম লুকিয়ে যাওয়া, ক্ষমতার এই ‘স্নেহ’-র ভানটুকুকে আড়াল করার দায়টাও তাঁদের ওপরেই চাপিয়ে দেওয়ার নিয়মটাকে টিঁকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ‘অবসাদ’-এর আড়াল খোঁজার মধ্যে, মনোসামাজিক চর্চার প্রতি একটা ওপরচালাক ভেংচি-কাটা বোকা স্পর্ধাও কি নেই?
‘কালেক্টিভ অ্যাঙ্গার’ বা পুঞ্জীভূত ক্ষোভের দিকটি ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না।এবং এই অসহায়তা শুধুই কি ব্যক্তির দায়, না কি সিস্টেমের ব্যর্থতাও বটে? তেমনই ভাবাচ্ছে বিষাক্ত পুরুষকার (টক্সিক ম্যাসকিউলিনিটি)-এর দিকটিও। আজকের যুগে যে ভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলা ও পুরুষের কর্মক্ষমতা আর যোগ্যতার ব্যবধানটা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণ করতে পারছে না পুরুষ অহং। সেই জায়গা থেকেও আক্রোশ জমে জমে অস্ত্র তুলে নেওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
তা হলে এই সব ঘটনার পেছনে কি অবসাদের কোনও ভূমিকা নেই? থাকতেই পারে, কিন্তু অবসাদই যে একমাত্র কারণ, তা চোখ-কান বন্ধ করে বলে দেওয়া যাচ্ছে না মোটেই। অবসাদ সম্পূর্ণ ভাবে একটি মানসিক রোগ, সাধারণ মনখারাপের সঙ্গে তার কিছু তফাত রয়েছে। কিছু দিন আগে একের পর এক কমবয়সী মডেলের আত্মহত্যার ঘটনার পিছনেও তুলে ধরা হয়েছিল এই অবসাদের তত্ত্বকে। কিন্তু তাঁদের এই চরম সিদ্ধান্তের মূলে কতটা মানসিক অবসাদ আর কতটাই বা ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েন, তার খতিয়ান নেওয়ার চেষ্টা করতে কাউকে খুব একটা দেখা যায়নি।
সচেতনতার প্রসার দরকার এখানেই। যে কোনও অস্বাভাবিক হত্যা বা মৃত্যুর ঘটনাকে শুরু থেকেই অবসাদ বলে দাগিয়ে না দিয়ে অন্য সম্ভাব্য কারণগুলিও দেখা দরকার। তাতে এক দিকে যেমন সত্যিকারের গুরুত্ব দেওয়া হবে অবসাদের মতো জটিল সমস্যাকে, তেমনই ‘অপর’ করে দেওয়ার মতো মারাত্মক সামাজিক ভুলের দিকেও যথাযথ নজর দেওয়া সম্ভব হবে। সে পথে হাঁটব কি আমরা?
(লেখক মনোসমাজকর্মী। মতামত নিজস্ব)