Hunger Index

ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর করার লক্ষ্য দূরে রয়ে গিয়েছে, আর কোনও সরকারই তো সমালোচনা পছন্দ করে না

আমরা মেদিনীপুরে প্রথম জেলার প্ল্যান তৈরি করেছিলাম। এই প্ল্যানে টার্গেট নেওয়া হয়েছিল ২০০০ সালে শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনা হবে ৩.৫ শতাংশে।

Advertisement

অর্ধেন্দু সেন

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২২ ১১:০৯
Share:

গোটা বিশ্বেই অপুষ্টি একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ছবি: পিটিআই।

চাকরি জীবনের গোড়ায় জিপ নিয়ে গ্রামে ঢুকলে দেখতাম, বাচ্চাদের দঙ্গল ধাওয়া করছে পিছনে। জামাপ্যান্টের বালাই নেই। হাত-পা সরু সরু। পেট মোটা। প্রত্যন্ত গ্রাম ছাড়া সে দৃশ্য এখন চোখে পড়ে না। এক, রাস্তাঘাট ভাল হওয়াতে বাবুদের আনাগোনা বেড়েছে। গাড়ি দেখে কারও মনে হয় না ‘ফ্লাইং সসারের’ মতো কোনও অচেনা বিস্ময়। বার্থ রেট তখন ছিল হাজারে বত্রিশ। এখন সেটা দশের ঘরে। ইশকুল যাওয়া বেড়েছে, তাই জামাপ্যান্ট এখন আর অসহ্য অতিরিক্ত নয়। আইসিডিএস সেন্টারে পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যাচ্ছে। ইশকুলে মিড ডে মিল পাওয়া যাচ্ছে। গ্রামবাসীকে প্রশ্ন করে শুনেছি, দারিদ্র আছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মানুষ অনাহারে নেই।

Advertisement

কিন্তু ক্ষুধা এবং অপুষ্টি দূর করার লক্ষ্য যে বহু দূরে তার প্রথম আভাস পাই বছর দশেক আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কথায়। তিনি স্বীকার করেছিলেন, দেশে অপুষ্টি একটা বড় সমস্যা। ২০২২ সালের ‘ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার রিপোর্ট’ দেখে মনে হল সে সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। ক্ষুধা দূরীকরণ এখন রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্মসূচিতে দু’নম্বর লক্ষ্য— দারিদ্র দূরীকরণের ঠিক পরেই। রাষ্ট্রপুঞ্জ চাইছে, ২০৩০-এর মধ্যে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর করতে। এই লক্ষ্যের দিকে কতটা এগোনো গেল তার হিসাব পাওয়া যায় প্রতি বছর প্রকাশিত এই রিপোর্টে। দেখা যাচ্ছে, ইদানীং সাফল্য কমই এসেছে। গোটা পৃথিবীর ক্ষুধাসূচক ২০১৪ সালে ছিল ১৯.১। তা একটু উন্নত হয়ে এখন হয়েছে ১৮.২। বলা বাহুল্য এই প্রগতি যথেষ্ট নয়।

ভারতের কি অবস্থা? রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ভারতের অবস্থায় অবনতি হয়েছে। ২০১৪ সালে ভারত ছিল ৯৯ নম্বর স্থানে। ২০২১ সালে আমরা ছিলাম ১০১। ২০২২ সালে আমরা নেমে গিয়েছি ১০৭ নম্বরে। পাকিস্তান বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা রয়েছে আমাদের উপরে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থা একমাত্র আফগানিস্তানের তুলনায় ভাল। স্বাভাবিক ভাবেই ভারত সরকার এ রিপোর্ট মেনে নেয়নি। সরকার বলেছে, রিপোর্টে পদ্ধতিগত ভুল আছে। ইদানীং একের পর এক রিপোর্টে সমালোচনা হয়েছে ভারতে সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে, পরিবেশের প্রতি সরকারের উদাসীনতা নিয়ে, এমনকি, ‘ইজ অফ ডুইং বিজনেস’ নিয়েও। কোনও সমালোচনাই সরকার মেনে নেয়নি। সরকারের অভিমত স্পষ্ট। হিন্দু ভারতের ক্রমোন্নতিতে এবং শক্তিবৃদ্ধিতে বিশ্ব ঈর্ষায় কাতর। তাই ভারতের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করবার যত প্রয়াস।

Advertisement

খিদের জ্বালায় জ্বলছে দেশ। ছবি: শাটারস্টক।

আমরা বাংলার মানুষ। তা-ও এক বার দেখে নিতে চাই, রিপোর্টে ঠিক কী বলা হয়েছে। বিশ্ব ক্ষুধাসূচক চারটে উপাদান দিয়ে তৈরি। এক হল শিশুমৃত্যুর হার। এর হিসাব প্রতি বছর পাওয়া যায় ‘ইউনিসেফ’ থেকে। এ ছাড়া দেখা হয় বয়স এবং উচ্চতার হিসাবে শিশুর ওজন স্বাভাবিক কি না। এই তথ্য আসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) থেকে। চতুর্থ উপাদান হল অপুষ্টির পরিমাপ, যা নেওয়া হয় বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে। প্রথম তিনটি উপাদান নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম। কারণ, তিনটি সংখ্যাই গবেষকদের সুপরিচিত। ভারত সরকার অবশ্য প্রশ্ন তুলেছে ক্ষুধাসূচক তো সবার জন্য। এই সূচকে শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? মজার কথা, এই আপত্তি জানিয়েছে কিন্তু কেন্দ্রীয় শিশুকল্যাণ মন্ত্রক। তাদের আপত্তি কিসে? শিশুস্বাস্থ্যের উপর জোর দেওয়াতে যদি আমরা বাংলাদেশ, পাকিস্তানের তুলনায় পিছিয়ে পড়ি, তা হলে বিপদটা তো ওদেরই!

বাকি রইল অপুষ্টির মাপ। ভারত সরকারের বক্তব্য, এফএও অপুষ্টি মাপে একটা ছোট্ট সমীক্ষার সাহায্যে। এই সমীক্ষার স্যাম্পেল সাইজ মাত্র ৩০০০। ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি। এত ছোট স্যাম্পেল থেকে কখনই সঠিক সিদ্ধান্তে আসা যায় না। হক কথা। কিন্তু ঘটনা এই যে, এফএও নিজের প্রয়োজনে কিছু সমীক্ষা করলেও সে রকম কোনও সমীক্ষার ফল ক্ষুধা সূচকে ব্যবহৃত হয়নি। প্রশ্ন উঠবে ভারতের ভাবমূর্তি কিসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি, এ ধরনের রিপোর্টে, না কি সরকারের বিবেচনাহীন মন্তব্যে?

অর্থনীতিবিদরা জানেন এবং বলেনও যে, অর্থনীতিতে বৃদ্ধি এলে অসাম্য বাড়ে। সাইমন কুজনেতস প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন এই সম্পর্ক। ভারতে বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। এ কথা কি আমরা বুক ফুলিয়ে বলি না? ক্ষুধাসূচকে বৃদ্ধি সেই মুদ্রারই উলটো পিঠ। বিশ্বব্যাঙ্কের এক সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, অতিমারির ধাক্কায় বিশ্বে যে ৭ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে তলিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ৫ কোটি ভারতীয়। তাই যদি হয় তা হলে ক্ষুধাসুচক বাড়বারই কথা। তার মানে এই নয় যে, সরকার দুঃস্থদের সাহায্য করেনি। অতিমারির মোকাবিলায় সরকার প্রত্যেক রেশন প্রাপককে মাসে পাঁচ কিলো চাল, গম ফ্রিতে দিয়েছে। সূচক তৈরি করার সময় কি সে কথা মাথায় রাখা হয়নি? আমার মেয়ে রোজ পড়াশোনা করে। সময় মতো হোম ওয়ার্ক জমা দেয়। তবু কম নম্বর পায় কেন? এ এক অনন্ত জিজ্ঞাসা।

ক্ষুধা এবং অপুষ্টি। ছবি: পিক্সাবে।

আগেই বলা হয়েছে গোটা বিশ্বেই অপুষ্টি একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। গুরুত্ব দিয়ে লড়েও এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এমন নয় যে কোনও দেশই তার অবস্থানে উন্নতি করতে পারেনি। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলি অর্থনীতিতে আমাদের অনেক পিছনে থেকেও এই সূচকে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। শ্রীলঙ্কা আছে ৬৪ নম্বরে। নেপাল ৮১। বাংলাদেশ ৮৪। এবং পাকিস্তান ৮৯ নম্বরে। আপাত অবিশ্বাস্য এই পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের গভীর ভাবে ভাবা দরকার। আইসিডিএস আর মিড-ডে মিলে বরাদ্দ ছাঁটাই করলে, বাচ্চাদের ডিম বন্ধ করলে কী ফল হয়, তা একটু বোঝা দরকার। চিনের রেকর্ড ঈর্ষণীয়। তার অবস্থান কখনওই পাঁচের নীচে নামেনি। গালওয়ানে আমরা ওদের হারিয়ে দিয়েছি। মার খেয়ে ওরা আর ওমুখো হয় না। ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কিন্তু ওরা গেম সেট ম্যাচ সব জিতে নিয়েছে।

অপুষ্টি একটা বড় সমস্যা। যদিও সেটা একমাত্র সমস্যা নয়। গোটা পৃথিবীতে অপুষ্ট মানুষের সংখ্যা ২০১৮ থেকে ২০২১ সালে ছিল ১৪.৬ শতাংশ। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ১৬.৩ শতাংশ। মোট অপুষ্ট মানুষের সংখ্যা এখন ৮২ কোটি। দুঃখের বিষয় এর মধ্যে ২২ কোটি ভারতীয়। উচ্চতার অনুপাতে ওজন কম এমন শিশুর সংখ্যাও ভারতে সর্বাধিক ১৯.৩ শতাংশ। অন্য দিকে, ২০১৪ সালের পরে ভারতে বয়সের অনুপাতে ওজন কম এমন শিশুর সংখ্যা কমেছে। ৩৮.৭ শতাংশ থেকে ৩৫.৫ শতাংশে। শিশুমৃত্যু কমেছে ৪.৬ শতাংশ থেকে ৩.৩ শতাংশে। মনে আছে, আমরা মেদিনীপুরে প্রথম জেলার প্ল্যান তৈরি করেছিলাম। এই প্ল্যানে টার্গেট নেওয়া হয়েছিল ২০০০ সালে শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনা হবে ৩.৫ শতাংশে। এই লক্ষ্য মোটেই বাস্তবসম্মত ছিল না। ছিল নব নির্বাচিত পঞ্চায়েতকে নিয়ে আমাদের উৎসাহ উদ্দীপনা এবং পাগলামির পরিচায়ক।

কোনও সরকারই সমালোচনা পছন্দ করে না। মোদী সরকার এ ব্যাপারে বিশেষ স্পর্শকাতর। কেন? সমাজবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। সরকার বহু পরিশ্রম করে এবং কোটি কোটি টাকা খরচ করে এক ভক্তমণ্ডলী তৈরি করেছে। এদের কীর্তনের বিকট আওয়াজে বেশির ভাগ সমালোচনা চাপা পড়ে যায়। তা সত্যেও যেটুকু সরকারের কানে যায়, তার জন্য রয়েছে দেশদ্রোহিতা বিরোধী আইন। যা এখন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সব সমালোচনাই যে চক্রান্ত বা দেশদ্রোহিতা, তা নয়। কিন্তু আপনার সমালোচনায় চক্রান্ত নেই তা প্রমাণ করতে হবে আপনাকেই। যত ক্ষণ না করছেন, সরকার দেশ সমাজ সবাই ধরে নেবে আপনি দেশদ্রোহী।

মুশকিল হল বিদেশিদের নিয়ে। তাদের তো দেশদ্রোহিতার আইনে ধরা যায় না! নিউ ইয়র্ক টাইমস আর ওয়াশিংটন পোস্টে সর্দার পটেলের মূর্তির ছবি দিয়ে ঘন ঘন বিজ্ঞাপনও দেওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে স্রেফ উপেক্ষাই শ্রেয়। তবে সেখানেও ব্যতিক্রমের প্রয়োজন আছে বৈকি। সমালোচনা যদি আসে পেট্রোলিয়াম-সমৃদ্ধ দেশ থেকে তা হলে অ্যাকশন নেওয়া দরকার। যে কথা নূপুর শর্মা বুঝলেন, একটু দেরিতে। আর ভক্তরা তো দেশি-বিদেশি কোনও রিপোর্টই পড়েন না। এক হোয়াটস্যাপেই জানতে পারেন দেশবিরোধী চক্রান্তের কথা। তাদের জ্ঞাতার্থে তাই সরকারকে মাঝে মধ্যে ফোঁস করতেই হয়।

কেউ যেন মনে না করেন সরকার রিপোর্টকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement