আন্দোলন।
আদালতের নির্দেশ পালন করতে পুলিশ এসে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের জোর করে সরিয়ে দিয়েছে এবং তার প্রতিবাদে কলকাতায় মিছিল ও অবস্থান চলছে— এই ঘটনাপরম্পরাকে আর যা-ই হোক, বিস্ময়কর বলা চলে না। চাকরি-প্রার্থীদের দাবিদাওয়ার যে যুক্তিই থাকুক, আদালতের নির্দেশকে সম্মান জানিয়ে তাঁরা নিজেরাই সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে সরে গেলে বৃহস্পতিবার রাত্রের অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটত না। তাঁরা সেটা করেননি। অবস্থানের কারণে লোক চলাচলের কোনও অসুবিধা হয়নি— তাঁদের এই দাবিও বাস্তবের ধোপে টেকে না, সুতরাং প্রশাসনের কর্তব্য প্রশাসন সম্পন্ন করতে উদ্যোগী হলে সেই উদ্যোগকে অন্যায় বলার যুক্তি নেই। পুলিশ অবস্থান ভাঙতে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে কি না, প্রতিবাদী মহিলাদের প্রাপ্য আইনি রক্ষাকবচগুলি তাঁরা যথাযথ ভাবে পেয়েছেন কি না, এই সব প্রশ্ন অবশ্যই প্রাসঙ্গিক, প্রয়োজনে এই বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার এবং পুলিশ অন্যায় করে থাকলে শাস্তিও দেওয়া দরকার, কিন্তু সেই প্রতিকারও তথ্য এবং যুক্তির পথেই করণীয়। সমস্যা এই যে, জনচিত্ত মন্থনে আবেগ বরাবরই যুক্তিকে দশ গোল দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও নাগরিক প্রতিবাদের শোরগোলে সেই আবেগের শক্তি প্রতিফলিত হয়ে চলেছে। প্রতিবাদীদের একাংশ অনশন করছিলেন, ফলে আবেগের মাত্রা অনিবার্য ভাবে স্ফীত হয়েছে। বস্তুত, তাঁদের অনশনই যে রাজ্য প্রশাসনকে আরও বেশি তৎপর করে তুলেছে, সেটা সহজেই অনুমান করা চলে। অনশন চিরকালই প্রশাসনকে ভয় পাইয়ে দেয়, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ ছিল না। রাত্রিকালে চড়াও হয়ে আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে, সে-কথা রাষ্ট্রযন্ত্রীরা অবশ্যই জানতেন, কিন্তু অনশন আরও কিছু দূর গড়ালে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বহুগুণ তীব্র হয়ে পড়বে— এই হিসাবটি কষে ফেলতেও তাঁদের নিশ্চয়ই ভুল হয়নি। সুতরাং— অ্যাকশন।
বড় প্রশ্ন পুলিশি সক্রিয়তার উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে নয়, তার প্রেক্ষাপট নিয়ে। কী ভাবে আন্দোলনের মোকাবিলা করা হল, আবেগের রাজত্বে প্রধান বিচার্য হয়ে দাঁড়ালেও আসলে সেটা গৌণ ব্যাপার। মুখ্য প্রশ্ন এটাই যে, পরিস্থিতি এইখানে এসে পৌঁছল কেন? সরকার যাঁরা চালাচ্ছেন তাঁরাও বিলক্ষণ জানেন, শিক্ষক নিয়োগের গোটা ব্যবস্থাটি থেকে যে দুর্গন্ধ নিঃসৃত হচ্ছে তাকে আর কোনও ভাবেই চাপা দেওয়া বা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। শিক্ষামন্ত্রী আজ স্বাধীন নাট্যকার হিসাবে দিনাতিপাত করলে এই দুর্গন্ধের উৎস বিষয়ে নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ করে নাম কিনতে পারতেন। দুর্নীতির মাত্রা ঠিক কতখানি, অভিযুক্তেরা তার জন্য কে কতটা দায়ী, আরও কত অপরাধ এবং অপরাধী এখনও গভীর জলে ডুবে আছে, তাদের কত জন শেষ অবধি জলের উপরে মাথা তুলতে বাধ্য হবে এবং কত জন ডুবেই থাকবে— এই সবই জল্পনার বিষয়। কিন্তু এই রাজ্যে যে আপাতত অনাচারের বিতত বিতংসটি যে এক অকল্পনীয় আকার ধারণ করেছে, সেই সত্য বোধ করি সমস্ত জল্পনার ঊর্ধ্বে। ইতিমধ্যে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আইন-আদালতের মারপ্যাঁচে এতটাই জড়িয়ে গিয়েছে যে এখন এক একটি মামলায় আদালতের নির্দেশ নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করছে। তার দায় আইন বা আদালতের নয়— প্রশাসনের, প্রশাসন যাঁরা চালান তাঁদের। এই অতলান্ত পঙ্কস্তূপ তাঁরা তৈরি করেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না, তাঁরাও সে কথা জানেন। এর থেকে উদ্ধার পেতে হলে এখন তাঁদের সামনে একটিই সদুপায়: সমস্ত তঞ্চকতা এবং প্যাঁচপয়জার ছেড়ে সত্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা। এবং এর ফলে যদি ক্ষমতার সাজানো বাগান তছনছ হয়, তা-ও মেনে নিতে হবে। স্পষ্টতই, তার জন্য প্রয়োজন শাসকের সৎ সাহস। অর্থাৎ, সোনার পাথরবাটি।