যা দেখার দেখে নেন, আর কিছু দিন পরে দেখতে পাবেন না।” কথাগুলো বললেন ভুটভুটি মালিক শ্রীকান্ত দাস। তাঁর অধীনে সাত জন ‘জেলুয়া’ বা জেলে মোটর বোট করে সমুদ্রে মাছ ধরতে যান, মন্দারমণির সমুদ্রতটের দাদনপাত্রবাড় খরপাই মৎস্যজীবী খটি থেকে। ‘খটি’ হল সমুদ্রতটে নির্দিষ্ট একটি জায়গায়, যেখানে ধরে-আনা মাছ শুকানো হয়। প্রবীণ শ্রীকান্তবাবুর আক্ষেপ, এই অঞ্চলের ‘খটি’গুলো বিপন্ন। পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী অন্তত পাঁচ হাজার ছোট মৎস্যজীবী জীবিকা হারানোর মুখে। কাজেই মৎস্যপ্রিয় বাঙালির পাতের পমফ্রেট, রুলি, পাটিয়া, ভোলা, চিংড়ি আরও মহার্ঘ হবে। তার কারণ, দিঘা থেকে হলদিয়া পর্যন্ত চার লেনের ‘মেরিন ড্রাইভ’ তৈরি হচ্ছে। শ্রীকান্তবাবুর খটি, যা ৮০ বছরের বেশি সময় ধরে মৎস্যজীবীদের জীবিকা জুগিয়েছে, তার অস্তিত্ব আর থাকবে না।
খটির ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা অগভীর সমুদ্রে জাল পাতেন। বালির তটভূমির উপর বিছিয়ে দিয়ে, কিংবা বাঁশের পালা বানিয়ে সেই মাছ শুকনো হয় বিক্রির জন্য। সমুদ্রের মতো, তার তটভূমিও মৎস্যজীবীদের কর্মক্ষেত্র। তাকে বাঁচাতে আন্দোলন করছেন মৎস্যজীবীরা। ১৯৮৯ সালে মৎস্যজীবীদের একটা ‘লং মার্চ’ হয়, একটা যাত্রা মহারাষ্ট্র থেকে বেরোয়, আর অন্যটা বেরোয় সুন্দরবন থেকে। এই দুই যাত্রা শেষ হয় কন্যাকুমারীতে। ভিড় সামলাতে পুলিশ গুলি চালায় নিরস্ত্র মৎস্যজীবীদের উপর, ২১ জন আহত হন। সরকার নড়েচড়ে বসে। পরিবেশ সুরক্ষা আইনের অধীনে নির্দেশনামা জারি করে, উপকূলের সর্বোচ্চ জোয়ারের জলসীমা থেকে ৫০০ মিটার তটভূমিকে নিয়ন্ত্রিত এলাকা, বা ‘সিআরজ়েড’ এলাকাভুক্ত বলে ধরা হয়। এখানে নির্মাণ-সহ বেশ কিছু কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, আর কিছু কাজ অনুমতিসাপেক্ষে করা যেতে পারে। তৈরি হয় ‘কোস্টাল জ়োন এরিয়া ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’।
তার পর? তার পর কি আরও সুরক্ষিত হল ভারতের উপকূলের বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ? ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান পাশ হওয়ার পর আজ পর্যন্ত পঁচিশটি সংশোধনী পাশ হয়েছে। উপকূলে নির্মাণ-সম্পর্কিত বাধানিষেধগুলিকে শিথিল করা হয়েছে। বার বার উপকূল জুড়ে প্রতিবাদ করেন মৎস্যজীবীরা। ২০১১ সালে উপকূল এলাকা সম্পর্কে নতুন নির্দেশ জারি করা হয়, যা সব দিক থেকে ১৯৯১ সালের নির্দেশের চাইতে অনেক দুর্বল ছিল। এই নির্দেশিকাতে উপকূলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা সিআরজ়েড, বিমান বন্দর, বৃহৎ আবাসন প্রকল্প ও পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পকে ছাড় দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে যে নতুন নির্দেশ জারি হয়েছে, তা উপকূলকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে পর্যটন, খনিজ তেল, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বেসরকারি সমুদ্রবন্দর-সহ নানা কাজের জন্য। কাজেই আরও বিপন্নতা বাড়ছে সমুদ্র-নির্ভর ছোট মৎস্যজীবীদের। সরকারি বিধি থাকলেও তা মানা হয় না, তার প্রমাণ তো মন্দারমণিতেই মেলে। যে জায়গা ছিল পরম্পরাগত ভাবে মৎস্যজীবীদের, পর্যটন শিল্পের জন্য তাঁরা আজ ক্রমেই সঙ্কুচিত। এখন আইনই বৃহৎ নির্মাণের দরজা খুলে দিয়েছে। চার লেনের ‘মেরিন ড্রাইভ’ তৈরি হলে খটি বন্ধ হবে। রাস্তাটা তৈরি হচ্ছে দিঘা-শঙ্করপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটির তত্ত্বাবধানে। দিঘা থেকে শঙ্করপুর মেরিন ড্রাইভ রাস্তাটি তৈরি হচ্ছে সমুদ্রতটের একেবারে গা ঘেঁষে। শোনা যাচ্ছে, পরবর্তী কালে রাস্তাটি বর্ধিত করে হলদিয়া পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। তাজপুরের কাছে সমুদ্র থেকে ওই রাস্তার দূরত্ব ১৫ থেকে ২০ মিটারের বেশি নয়। দিঘা থেকে মন্দারমণি পর্যন্ত আগে একটা সরু রাস্তা ছিল। ইয়াস সাইক্লোনের সময় সমুদ্রের জলের ধাক্কাতে সেই পুরনো রাস্তা একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। নতুন মেরিন ড্রাইভ সমুদ্রের গা ঘেঁষে হচ্ছে। সমুদ্রতটে যে লাল কাঁকড়া এবং অন্যান্য জীব থাকে, তাদের বাসস্থান বিঘ্নিত হবে। গাড়িঘোড়ার ধোঁয়া ও শব্দে দূষণ বাড়বে। দাদনপাত্রবাড় খটির মৎস্যজীবীরা ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ‘মেরিন ড্রাইভ’-এর কাজ বন্ধ করার জন্য সরকারি নানা দফতরে ডেপুটেশন দিয়েছিলেন। এখনও অবধি কাজ হয়নি।
এই চার লেনের রাস্তা নির্মাণ, যা তাঁদের জীবিকা বিপন্ন করছে, তা কী করে অনুমোদন করল সরকার? জানা গিয়েছে রাস্তাটি সিআরজ়েড এলাকার ভিতরেই। দিঘা-শঙ্করপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রাস্তার কাজে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, তার কোনও বিশদ রিপোর্ট তৈরি হয়েছে কি? ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে চিঠির উত্তরে দিঘা-শঙ্করপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটি জানিয়েছে, এই কাজের কোনও ডিটেলড প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরি হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রককে প্রশ্ন করা হয়, এই রাস্তা তৈরির জন্য তাদের থেকে কি কোনও ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে? এ বছর ১২ জানুয়ারি উত্তর মিলেছে, কেন্দ্রীয় পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন দফতরের কাছে এই বিষয়ে কোনও তথ্য নেই।
অর্থাৎ রাষ্ট্র যাকে বলছে ‘উন্নয়ন’, তার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত দফতরগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। সুস্থায়ী উন্নয়নের খোঁজ মেলে কেবল পাঠ্যবইয়ের পাতায়। সরকারি নীতিতে, কার্যকলাপে তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন।