Mental Health

চাই মনোরোগের স্বাস্থ্যকর্মী

কোভিড-পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্ব জুড়ে মানসিক স্বাস্থ্যের ছবিটা বদলে গিয়েছে অনেকটাই।

Advertisement

রত্নাবলী রায়

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:১৮
Share:

অবশেষে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ কেন্দ্রীয় বাজেটে উঠে এল। ২০২২-২৩ সালের বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন, কোভিড অতিমারির আবহে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও কাউন্সেলিং দেওয়ার জন্য একটি জাতীয় টেলিমানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা খুব শিগগিরই শুরু করবে সরকার। দীর্ঘ দিন অবহেলিত থাকার পর কেন্দ্রীয় বাজেটে স্থান পাওয়া সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য। তবে এই আপাত ইতিবাচক পদক্ষেপের আড়ালে উঠে আসছে কিছু জটিল প্রশ্ন।

Advertisement

কোভিড-পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্ব জুড়ে মানসিক স্বাস্থ্যের ছবিটা বদলে গিয়েছে অনেকটাই। মানসিক সুস্থতার উপর কোভিডের প্রভাব নিয়ে পৃথিবীর ২০৪টি দেশে করা একটি সমীক্ষা ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। দেখা গিয়েছে, অবসাদ আর উদ্বেগজনিত সমস্যা বেড়েছে যথাক্রমে ২৮% ও ২৬%। ভারতে এই দু’টি ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির হার ৩৫% করে। ল্যানসেট আরও জানিয়েছে, ২০২০ সালের পর ১৭-২৪ বছর বয়সি ভারতীয়দের মধ্যে প্রতি সাত জনের এক জনকে গ্রাস করেছে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ আর উৎসাহহীনতার মেঘ। সরকার এই ভয়ানক সঙ্কটের সম্পর্কে কতটুকু ওয়াকিবহাল? এক দিকে মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার নড়বড়ে পরিকাঠামো, অন্য দিকে প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর অপ্রতুলতা, এই বিপুল অভাব মেটাতে গোটাকতক টেলিমেন্টাল হেলথ সেন্টারের জন্য অর্থবরাদ্দ নেহাতই অকিঞ্চিৎকর!

মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে শারীরিক অসুস্থতার কিছু পার্থক্য আছে। ব্যক্তিভেদে মানসিক গঠন যেমন পাল্টে যায়, তেমনই মানসিক অসুস্থতার রূপও বদলায়। কলকাতার মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির কোনও ব্যক্তি সিজ়োফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হলে রোগের যে প্রকাশ হবে, তার তুলনায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও ব্যক্তির সিজ়োফ্রেনিয়ার প্রকাশ আলাদা, লক্ষণও আলাদা হতে পারে, কারণ তাঁদের জীবনটাই আলাদা! ফলে লক্ষণ শুনে চিকিৎসা করতে চাইলে কারও কারও ক্ষেত্রে হেল্পলাইন কাজ করলেও, সবার ক্ষেত্রে করবে, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।

Advertisement

দ্বিতীয়ত, ২০১৭ সালে মানসিক স্বাস্থ্য শুশ্রূষা সংক্রান্ত যে আইন পাশ করা হয়েছে, তাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে, যার বাস্তবায়ন টেলিফোন হেল্পলাইনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। তার মধ্যে একটি হল, নীতিনির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়। গত তিন বছরে আত্মহত্যায় প্রতিদিন গড়ে তেইশ জন মারা গিয়েছেন, এর প্রতিরোধের কোনও পদক্ষেপ আমরা এখনও পর্যন্ত দেখিনি। আত্মহত্যা প্রতিরোধের নীতি তৈরি করতে চাইলে বিশেষ বরাদ্দ দরকার। আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, শেষ প্রান্তিক মানুষটির কাছেও পরিষেবা পৌঁছে দিতে হবে। চিকিৎসা যদি টেলিফোন-নির্ভর হয়ে যায়, তা হলে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে যে গৃহবধূর সাহায্য দরকার, তিনি কী ভাবে চিকিৎসা পাবেন? চিকিৎসা যদি ডিজিটাল হয়ে যায়, তা হলে সেই প্রযুক্তির অপর প্রান্তে যে সব মনোসামাজিক রোগী আছেন, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সুষ্ঠুভাবে চালানোটাই যাঁদের কাছে চ্যালেঞ্জ, তাঁদের কী করণীয়?

মনোরোগীকে সহায়তা দিতে হলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের অধীনে যে জেলাভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্প আছে, তার পরিসর বাড়াতে হবে, যাতে তা দূরতম মানুষটির কাছেও পৌঁছে যেতে পারে। পাশাপাশি রোগী-ওষুধ-প্রেসক্রিপশনের যে চিরাচরিত কাঠামো, সেই ছক ভেঙে দেওয়াও দরকার। যে কোনও রোগ সারানোর প্রথম ধাপ হল মানুষের মনে আশা জাগানো। কথা বলা আর শোনা, রোগীর চোখের ভাষা, মুখের রেখার বাঁকবদল পড়তে পারাটা চিকিৎসার একটা বড় অঙ্গ, যা টেলিফোনে কিছুতেই সম্ভব নয়। অসরকারি যে সব সংগঠন এই ধরনের কাজ সারা ভারত জুড়ে করে চলেছে এবং প্রমাণ করেছে চিকিৎসায়
মানুষ সুস্থ হয়ে যান, তাদের পরিসর আরও বিস্তৃত করা, ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোটা মানসিক চিকিৎসার অন্যতম দিক।

পাশাপাশি রয়েছে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ। গত কয়েক বছরের বাজেটে এই সচেতনতা খাতে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে সেই কাজ করা সম্ভব হয়নি বলে টাকা ফিরে গিয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। তাই তৃণমূল স্তর থেকে নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে। মানসিক রোগ যে পাপ বা অভিশাপ নয়, চিকিৎসায় ভাল হয়ে যায়, এই সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। এই ধরনের প্রচার কখনওই অগ্রাধিকার পায়নি।

মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাকে শহরকেন্দ্রিক করে রাখলে চলবে না। কাকদ্বীপ, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ভোরবেলা কোঁচড়ে মুড়িবাতাসা নিয়ে ট্রেনে চড়ে কলকাতায় এসে পাভলভে লাইন দিয়ে চিকিৎসা করাবেন রাধারানী, মহেশ, শঙ্করেরা, এ অসম্ভব। এখানেই এই বাজেটের বৈষম্য। পাশাপাশি জেলায় জেলায় মানসিক স্বাস্থ্যের ক্যাম্প করা সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রতিবন্ধী কার্ড বা সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন না অগুনতি মনোসামাজিক রোগী। সেই বৈষম্য কবে দূর হবে? বাজেটে তারও উল্লেখ নেই! যে হেতু মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের অপ্রতুলতা রয়েছে, তাই আশাকর্মীদের মতোই প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে হবে, যাঁরা প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে গিয়ে পরিষেবা দেবেন এবং তার জন্য টাকা বরাদ্দ করতে হবে।

তবে শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়, তাই রাজ্য কেন্দ্রের দেখানো পথে হাঁটবে, না কি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অন্য রকম ভাবনাচিন্তা নিয়ে দরিদ্র মানুষের প্রতি যত্নবান হবে, সেটাও দেখার। কিন্তু মূল সমস্যাগুলোকে অস্বীকার করে শুধু টেলিমেন্টাল হেলথ সেন্টার তৈরির ঘোষণা সামগ্রিক ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের কোনও উন্নতি ঘটাবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement