সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল একটা অপ্রিয় কিন্তু জরুরি প্রশ্ন আবার সামনে এনেছে। কৃষক আন্দোলন কতটা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারল? এ কথা ঠিক, কৃষক আন্দোলন নির্বাচনী প্রচারে ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কালা কানুনের বিরুদ্ধে, আর ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টির দাবিতে উত্তর ভারতের কৃষকদের একাংশ আন্দোলনে নেমেছিলেন। সেখানে পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এবং পূর্ব রাজস্থানের কৃষকদের দেখেছি আমরা। এই কৃষক আন্দোলন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। কী ভাবে অনেকগুলি কৃষক সংগঠন একটা ন্যূনতম কর্মসূচিতে একমত হল, পনেরো মাস ধরে চলা আন্দোলন অনেক প্ররোচনা সত্ত্বেও অহিংস রইল, মহিলারা একটা মুখ্য ভূমিকায় দেখা দিলেন, কী ভাবে প্রবল শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে, ঘরছাড়া হয়ে তাঁরা দীর্ঘ আন্দোলন চালালেন, এবং সাতশোর বেশি মৃত্যু সহ্য করে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দম্ভকে গুঁড়িয়ে দিলেন, তা ভবিষ্যতের সমাজকর্মীদের কাছেও শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।
তার পরেও প্রশ্নটা থেকেই যায়। পঞ্জাবের ফলাফল দেখে মনে হতে পারে যে, পালাবদলের পিছনে কৃষক আন্দোলনের নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মনে রাখা দরকার, ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পাঁচ বছর অন্তর (কখনও তার আগেই) অকালি দল আর কংগ্রেসের মধ্যে পালাবদল হয়ে আসছে। এ বারে ময়দানে এসেছে আম আদমি পার্টি। আপ কোনও কালেই কৃষকদের পার্টি বলে পঞ্জাবে পরিচিত ছিল না, আজও নেই। বরং অকালি দল কৃষি আইনের বিরোধিতা করে বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করেছিল, এবং কৃষক আন্দোলনকে পিছন থেকে মদত জুগিয়েছিল। কংগ্রেস আগাগোড়া তিনটি কৃষি আইনের বিরোধিতা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার যখন লোকসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, তাদের কাছে আন্দোলনকারী মৃত কৃষকদের কোনও তালিকা নেই, তখন কংগ্রেস তিনটি রাজ্যে মৃত কৃষকদের তালিকা প্রকাশ করে। পঞ্জাব সরকার সেই সব মৃত কৃষক পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার অঙ্গীকার করে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, এমনকি উত্তরাখণ্ড ও মধ্যপ্রদেশেও আন্দোলনকারী কৃষকদের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছিল, কিন্তু রাজস্থান বা পঞ্জাব সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করেনি। অর্থাৎ কংগ্রেস কৃষক আন্দোলনের বিরোধী ছিল, এ কথা বলা যাবে না।
সেন্টার ফর ডেভলপিং সোসাইটি-র ‘লোকনীতি’ বিভাগ নির্বাচনের পরে যে সমীক্ষা করেছে (বুথফেরত সমীক্ষা নয়), তাতে দেখা যাচ্ছে, পঞ্জাবের ভোটাররা কংগ্রেস-বিজেপি-অকালি তিনটি দলকেই শাস্তি দিতে চাইছিলেন। কারণ ব্যাখ্যা করার সুযোগ এখানে নেই, কিন্তু নানা আলোচনায় বেরিয়ে এসেছে যে, দীর্ঘ দিনের অকালি/কংগ্রেস শাসন সামাজিক-আর্থিক দিক থেকে পঞ্জাবকে পিছিয়ে দিয়েছে। দেখা গেল, পঞ্জাবের অকালি ও কংগ্রেস সমর্থকদের তিন ভাগের এক ভাগ এ বার আপকে ভোট দিয়েছেন। এমনকি বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে ১৬ শতাংশ আপকে ভোট দিয়েছেন। আপের প্রতি এই সমর্থন কৃষিজীবী ও অকৃষিজীবী, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই সমান স্পষ্ট। পঞ্জাবের তিনটি অঞ্চলের মধ্যে শুধুমাত্র মালওয়া অঞ্চলেই কৃষক সম্প্রদায় ঝেঁটিয়ে আপকে ভোট দিয়েছেন, এমনকি চাষিদের যে অংশটি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি তাঁরাও আপকে সমর্থন জানিয়েছেন। বরং দোয়াব ও মাঝা অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন আপ-এর চেয়ে বেশি ছিল। অর্থাৎ, পঞ্জাবের নির্বাচনে কৃষক আন্দোলনের প্রভাব আংশিক, এটুকু বলেই ক্ষান্ত থাকতে হবে।
কিন্তু উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে? সমাজবাদী পার্টির জোটের ১২৫টি আসনের অধিকাংশ পূর্বাঞ্চলে, অথচ কৃষক আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছিল পশ্চিমের জাঠ বলয়ে। সেই জাঠদের দল আরএলডি ৩৩টি আসনে লড়াই করে মাত্র ৮টিতে জিততে পেরেছে। পূর্বাঞ্চলে কৃষক আন্দোলনের কোনও জোয়ার ছিল না, সেখানে বরং জাতি-সমীকরণটাই মুখ্য। ‘লোকনীতি’-র সমীক্ষাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ব্রাহ্মণ, ঠাকুর, বৈশ্য, জাঠ, কুর্মী, নিশাদ, কাশ্যপ, অন্যান্য ওবিসি-রা বিজেপির দিকেই ঝুঁকেছে, এসপি-র জোটের দিকে নয়। এমনকি জাঠভদের (বিএসপি-র ভোট ব্যাঙ্ক বলে পরিচিত) ২০ ভাগ ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছে। যাদব ও মুসলিম ছাড়া অন্য কোনও জাতিই একজোট হয়ে এসপি-র পাশে থাকেনি।
আমরা যে কৃষক আন্দোলনকে নৈতিক ভাবে সমর্থন করেছি, তা আখেরে কি জাতি সমীকরণের পরিচিত অঙ্কের ঊর্ধ্বে চাষিকুলকে জোটবদ্ধ করতে সমর্থ হল? ২০১৫-১৬ সালের কৃষি সেন্সাস অনুযায়ী, উত্তরপ্রদেশে আশি শতাংশ প্রান্তিক চাষি, ও আরও ছয় শতাংশ ক্ষুদ্র চাষি। কৃষক আন্দোলন স্থগিত হলেও এই ছিয়াশি শতাংশ চাষির দাবিগুলি তো স্থগিত হয়ে যায়নি। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনুসারে ২০২২ সালে তো কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার কথা। নির্বাচনে এ সবের কোনওটাই প্রাধান্য পেল না কেন? উত্তরপ্রদেশে কমবেশি আড়াই কোটি কৃষক আছেন, ভোট দেওয়ার বেলায় তাঁদের চাষিসত্তার চেয়ে জাতিসত্তা এবং উপভোক্তাসত্তা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এমন কি হওয়া সম্ভব যে, কৃষক আন্দোলনের দাবিগুলি আসলে সমস্ত চাষিকুলের হৃদয়ঙ্গম হয়নি? হতে পারে। কারণ, তাঁদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় এমএসপি, মান্ডি ব্যবস্থা, সরকারি ক্রয়, এগুলি প্রধান চ্যালেঞ্জ নয়। প্রধান চ্যালেঞ্জ বাজার থেকে ফসলের উপযুক্ত দাম পাওয়া, উৎপাদনের ঊর্ধ্বমুখী খরচ জোগানো, চাষ থেকে জীবিকা নির্বাহের উপায়ের ধারাবাহিক সঙ্কোচনের মোকাবিলা, ফসল নষ্ট, ইত্যাদি। একমাত্র গোরক্ষা নীতির পরিণামে ঘরছাড়া গরুদের উৎপাতে চাষিদের একাংশ যথেষ্ট রুষ্ট ছিলেন, এবং এই সমস্যাটি পূর্বাঞ্চলেই বেশি প্রকট ছিল। তার কিছুটা সুফল এসপি-র জোট পেয়েছে। আরও চিন্তা হয় যখন ‘লোকনীতি’র সমীক্ষা থেকে দেখি, পঞ্জাব বাদে তিনটি রাজ্যেই ভোটাররা রাজ্য সরকারের চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে বেশি সন্তুষ্ট। মানে রেশন, পেনশন, জ্বালানি নির্বাচনে হয়তো বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে।
নির্বাচন ছেড়ে রাষ্ট্রনীতির দিকে তাকালে মনে হয়, রাষ্ট্র চাষিদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। কৃষি সংক্রান্ত প্রধান তিনটি কর্মসূচি— পিএম কিসান, ফসল বিমা, কৃষি সিঁচাই যোজনায় গত বছরের তুলনায় এ বছরে কেন্দ্রীয় বাজেটে এক কণাও বৃদ্ধি হয়নি। গোটা কেন্দ্রীয় কৃষি দফতরের বাজেট বাড়েনি। কৃষক ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে কমিটি বসার কথা ছিল, তা এখন ঠান্ডা ঘরে। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটির রিপোর্ট দেড় বছরের উপর বাক্সবন্দি। যেন কৃষিক্ষেত্রটাই রাষ্ট্রের নজর থেকে সরে গিয়েছে।
স্বাধীনতার পরে অনেকটা সময় ধরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রসার হয়েছে কৃষক, শ্রমিক আর ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে, পাশাপাশি দলিত ও মণ্ডল রাজনীতিও গণতান্ত্রিকতার প্রসারে বড় ভূমিকা নিয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছিল, কারণ আন্দোলনের দাবিসমূহ তৈরি হয়েছিল শ্রমিক-কৃষক-দলিতদের সর্বজনীন দৈনন্দিন অভিজ্ঞতালব্ধ বৈষম্য ও বঞ্চনার বোধ থেকে। দেশের চাষিদের ৭৮ ভাগ যদি প্রান্তিক চাষি হন, তা হলে তাঁদের চাহিদাগুলি কী, তা নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনা, এবং তার ভিত্তিতে আন্দোলনের দাবি তৈরি জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে আমরা ভাবতেই থাকব যে কৃষক আন্দোলন সর্বজনীন, কিন্তু সারা ভারতের কৃষক তাতে সাড়া দেবেন না।