ঘরমুখী: সিংঘু সীমান্ত ছেড়ে চলে আসার সময়ে কৃষক নেতাদের বিজয়সূচক অঙ্গুলিভঙ্গি, ১১ ডিসেম্বর। ছবি: পিটিআই।
তিনশো আশি দিন পর সাতশো চোদ্দো জন কৃষককে হারিয়ে দিল্লি সীমান্তের প্রতিবাদী ছাউনি থেকে কৃষকরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। বর্তমান কৃষক আন্দোলনকে এ যুগের মহাভারত হিসাবে দেখলে বলতে হয় একটা পর্ব শেষ হল। পর্বের নাম কৃষি আইন প্রত্যাহার পর্ব বা সিংঘু-টিকরি-গাজিপুর ছাউনি পর্ব দেওয়া যেতে পারে। কথিত আছে, পৌরাণিক সময়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আঠারো দিনে শেষ হয়েছিল। এ যুগে ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য, বিশেষত মোদী সরকারের মতো চরম ক্ষমতাশালী এক তন্ত্রের বিরুদ্ধে। আর এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সাংগঠনিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই কৃষকরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। আজ পরবর্তী পর্বে উত্তরণের প্রস্তুতি বজায় রেখেই কৃষক ঘরে ফিরছেন।
কৃষক আন্দোলনের মূল দাবি দু’টি ছিল জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কৃষি আইন প্রত্যাহার এবং গোটা দেশ জুড়ে যাবতীয় ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা। এর মধ্যে প্রথম দাবিটি সরকার মেনে নিয়েছে, দ্বিতীয় দাবি পূরণের জন্য কমিটি গঠনের কথা হয়েছে, যে কমিটিতে কৃষক প্রতিনিধিরাও থাকবেন। স্বামীনাথন কমিশন অনেক দিন আগেই এই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপির ফর্মুলা ঠিক করে দিয়েছে: সম্পূর্ণ কৃষি সংক্রান্ত খরচের দেড় গুণ। প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদীর অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল কৃষকদের জন্য এই এমএসপির নিশ্চয়তা। আজ এত দিন পরে আবার নতুন করে কমিটি গঠনের কোনও প্রয়োজন নেই, তবুও কৃষক আন্দোলন এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছে।
কৃষক আন্দোলনের দু’টি অন্য পুরনো দাবি— বিদ্যুৎ বিল (২০২০) বাতিল করা এবং ফসলের গোড়া বা খড় পোড়ানোর জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার— সরকার মোটামুটি মেনে নিয়েছে। কৃষকদের অবশিষ্ট দাবিগুলি আন্দোলন পর্যায়ে উদ্ভূত। এই দাবিগুলি ছিল, কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া মামলা প্রত্যাহার, আন্দোলনে শহিদ হওয়া কৃষক পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং লখিমপুর খেরিতে কৃষক বিরোধী হিংসার উস্কানি দাতা স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের অপসারণ। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রীর অপসারণের দাবিটি বাদ দিয়ে কথা হয়েছে বাকি দু’টি দাবি সংশ্লিষ্ট সব রাজ্য সরকার মেনে নেবে। সব মিলিয়ে বলা যায় কৃষক আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছে। এই জয়ের বার্তা নিয়েই আন্দোলনরত কৃষকরা এখন ঘরে ফিরে যাচ্ছেন।
সরকারি ব্যাখ্যা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য রকম। সরকার কৃষক আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। কৃষকদের সঙ্গে সরকারের যে আলোচনা-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা বাইশে জানুয়ারির পর আর এগোয়নি। নরেন্দ্র মোদীর ভাষণে এবং আইন প্রত্যাহারের ঘোষিত যুক্তি হিসাবে সংসদে যা বলা হয়েছে, তা হল কৃষকদের একটা ছোট অংশ আইনের সুফল বুঝতে পারছে না। সরকার তাই স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে সবার মন রাখতে এই আইন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অর্থাৎ কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নটা সরকারের উদারতা ও মহানুভবতার, এর সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই। কৃষক আন্দোলন তো কৃষকদের এক ছোট অংশের অন্যায় আবদার। —তাও ভাল। এত দিন দালাল ও দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত হওয়ার পর আন্দোলনরত কৃষকরা শেষ পর্যন্ত কৃষক আখ্যা তো পেলেন।
আন্দোলন এবং অধিকার, অধিকার অর্জন ও রক্ষার আন্দোলন এবং আন্দোলনের অধিকারের নিশ্চয়তা, গণতন্ত্রের গোড়ার কথা। আর এই গোড়ার কথাটা আমরা দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে আয়ত্ত করেছি, আমাদের সংবিধান তাকে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি হিসাবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু আজ আমাদের গণতন্ত্রে, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার এই গোড়ার কথাটাকেই অস্বীকার করতে উদ্যত। কৃষক আন্দোলনের দাবি মোটের উপরে মেনে নিতে বাধ্য হলেও সরকারের চোখে আন্দোলন উপহাসের ব্যাপার। সংসদে ‘আন্দোলনজীবী’ শব্দ উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের সাংসদদের দাম্ভিক উল্লাসের কথা আমাদের দীর্ঘ দিন মনে থাকবে। মনে থাকবে, এ বারের সংবিধান দিবসে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের কথা— অধিকার নয়, কর্তব্যই নাকি সংবিধানের মর্মবস্তু। কর্তব্য পালন করলে অধিকার নাকি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই সুনিশ্চিত হয়ে যায়। অধিকারের দাবি নাকি দেশ ও সংবিধানকে দুর্বল করে দেয়।
কৃষক আন্দোলনের জয় তাই শুধু কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবির জয় নয়, তা হল শাসকের এই গণতন্ত্রবিরোধী দম্ভ ও দর্শনের বিরুদ্ধে কৃষকের বলিষ্ঠ কশাঘাত। স্বাধীনতা আন্দোলনে কৃষকই ছিল আন্দোলনের মূল শক্তি। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সমসাময়িক বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহ, সে সবই ছিল কৃষকের আন্দোলন। চম্পারণের কৃষক আন্দোলনই দক্ষিণ ভারত থেকে ফিরে আসা ব্যারিস্টার মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আজ আবার যখন সেই কৃষক শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা উপেক্ষা করে দিল্লির সীমান্তে ছাউনি তৈরি করে রাস্তায় বসে যান, তখন তা নিছক কৃষক আন্দোলন থাকে না, খুব স্বাভাবিক ও নিশ্চিত ভাবেই এক নতুন গণজাগরণের প্রেক্ষাপট রচনা করে দেয়। আন্দোলনকে উপহাস করলেও কৃষক আন্দোলনের এই অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ও শক্তিকে চিনতে শাসকের ভুল হওয়ার কথা নয়। তাও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সরকার তাই কৃষি আইন প্রত্যাহার করে কৃষক আন্দোলনের হাত থেকে ছাড় পেতে চেয়েছে।
কৃষক আন্দোলনের পরবর্তী পর্ব কী ভাবে গড়ে উঠবে, তা সময় বলবে। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্বার্থে আমরা চাইব, কৃষক আন্দোলনের মেজাজ ও আবহ যেন বজায় থাকে, গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে যায়। কৃষক চেতনা উৎপাদন ও সৃষ্টির চেতনা। সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও বিদ্বেষের উৎপাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে এ এক মহৌষধ। দাঙ্গাবিধ্বস্ত মুজফ্ফরনগরে যখন কিসান মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চ থেকে দাঙ্গা নিয়ে অনুশোচনার কথা শোনা যায় তখন সেটাই হল মৈত্রীর অমোঘ বাণী। আজ যখন কৃষকরা ঘরে ফিরে যাচ্ছেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, অযোধ্যার পর কাশী ও মথুরাতে মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের রণহুঙ্কার শোনা যাচ্ছে, তখন আমরা চাইব, কৃষকের চেতনা যেন ঘরে ফিরেও জেগে থাকে, পাহারা দেয়।
কৃষকের চেতনা পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার চেতনা। আজ পুরনো অর্থে উপনিবেশ নেই, কিন্তু নতুন উপনিবেশের ঠিকানা সবার আগে কৃষকেরই জানা। কৃষিজমি থেকে শুরু করে সমগ্র কৃষি উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়াকে হস্তগত করতে চাইছে নতুন কর্পোরেট জমিদারি প্রথা। সে কালে জমিদারি প্রথার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিল ব্রিটিশ শাসক। আজ নতুন জমিদারির অভিভাবক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও বিশ্বায়নের বাজার ব্যবস্থা। কৃষকের কৃষি জমি ও কৃষিরক্ষার লড়াই আজ এই নতুন যুগে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। আর যদি প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার কথা বলি, জলবায়ু প্রদূষণ ও পরিবর্তনের বিপদের কথা ভাবি, সেই লড়াইয়েরও সবচেয়ে বড় শক্তি আদিবাসী জনগণ ও কৃষক সমাজ। এই কঠিন সময়ে পরিবেশ-প্রকৃতি-প্রাণরক্ষার আন্দোলনে প্রতিটি সচেতন মানুষের দায়িত্ব কৃষকের পাশে দাঁড়ানো, কৃষকের হাত ধরা।
আজ দেশ বলতে জনতার আগে আমাদের নেতাকে চিনিয়ে দেওয়া হয়। এই চরম ব্যক্তিপূজার ও ব্যক্তিসর্বস্বতার যুগে কৃষকের এই সমষ্টিশক্তি কিন্তু স্বেচ্ছায় গড়ে ওঠা সচেতনতা। সেখানে অসীম ধৈর্য ও দৃপ্ত শান্তির সঙ্গে শৃঙ্খলা পালিত হয়। কৃষক নেতারা অনায়াসে সরকারের সঙ্গে টেবিলে বসে আলোচনা করে মাটিতে বসে নিজেদের আনা খাবার খান। কোনও নেতার আচরণ কৃষক বা আন্দোলনের স্বার্থের পরিপন্থী বিবেচিত হলে সেই নেতাকে সমষ্টির প্রজ্ঞাকে মেনে নিতে হয়। ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক শিবির কি কৃষক ঐক্যের এই সমষ্টিগত অনুশীলন থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে না?