প্রতিবাদ: জাল টিকা শিবির ধরার পর কলকাতার রাস্তায় বামপন্থীদের বিক্ষোভ, ২৮ জুন। পিটিআই
আশির দশকের শেষ বা নব্বইয়ের প্রথম দিক। বড় কোনও ঘটনার খবর সংগ্রহে আমি এবং ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এ তখনকার এক সহকর্মী-বন্ধু এক সঙ্গে পৌঁছলাম ভাঙড় থানায়। সাদা অ্যাম্বাসাডর থেকে ধোপদুরস্ত আমরা থানার গেটে নামতেই কর্তব্যরত প্রহরী লম্বা স্যালুট ঠুকলেন। গম্ভীর মুখে দু’জনে গটগটিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।
সামনেই ঘরে কয়েক জন অফিসার। সানগ্লাস কপালের উপর ঠেলে সহকর্মী-বন্ধু জানতে চাইলেন, বড়বাবু আছেন? আমাদের দেখে অফিসারেরা তত ক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের এক জন বললেন, “বড়বাবু নেই, স্যর। আমি মেজোবাবু।”
হয়তো পরবর্তী কোনও ‘আদেশ’-এর অপেক্ষা। বললাম, “আমরা রিপোর্টার। আমি আনন্দবাজারের, উনি টেলিগ্রাফের। ঘটনার ব্যাপারে…।”
কথা ফুরোনোর আগেই টুপি খুলতে খুলতে অফিসারেরা যে যার চেয়ারে বসে পড়লেন এবং মেজোবাবু যথেষ্ট পুলিশি কাঠিন্যে জানালেন, “বড়বাবু আউটে আছেন এসপি সাহেবের সঙ্গে। এখানে কোনও খবর নেই।” আমরা বেরিয়ে এলাম। এ বার প্রহরীও উঠে দাঁড়ালেন না!
মজা লাগছিল। পরে ভেবে দেখলাম, গোটা বিষয়টিতে পুলিশের কী নিদারুণ অদক্ষতা এবং অপেশাদারিত্ব ধরা পড়ছে। আমরা অচেনা-মুখ দুই যুবক থানায় ঢুকলাম। সেলাম পেলাম। অফিসারেরা শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু কেউ এক বার বিনয়ের সঙ্গেও যাচাই করলেন না, আমরা কে এবং কেন এসেছি। এ ভাবে কোনও বদ মতলবেও তো দু’জন ঢুকে পড়তে পারত!
আরও কুড়ি-বাইশ বছর পরের কথা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতার এক যুগল রাজ-আতিথ্যে উত্তরবঙ্গের একটি বন-বাংলোয় ঘর পেলেন। গাড়ি নিয়ে ঘুরতেও বেরোলেন। তাঁরা নাকি মুখ্যমন্ত্রীর ‘মেয়ে-জামাই’! পুলিশ কোনও প্রশ্নই তোলেনি। ভেবেও দেখেনি, মুখ্যমন্ত্রীর মেয়ে যেতে চাইলে এ ভাবে বিনা নোটিসে যাবেন কেন? শুধু এক কনস্টেবলের কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল। পর দিনই সব ফাঁস!
দেবাঞ্জন দেবও নিশ্চিত ভাবে আরও ‘চালিয়ে’ যেতে পারতেন, যদি কোভিড-প্রতিষেধকের ঘটনাটি না ঘটত! কারণ তার আগে পর্যন্ত অনেকটা সময় জুড়ে লোকটির বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে এটা পরিষ্কার, পুলিশ-পুরসভা-প্রশাসন-নেতা-মন্ত্রী সর্বস্তরে অদক্ষতা, উদাসীনতা, প্রশ্রয়, গাফিলতি ইত্যাদি অনেক কিছু তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পেরেছেন।
প্রশ্ন হল, তিনি কি সত্যিই সকলকে ঘোল খাওয়াতে পেরেছিলেন? না কি চোখে ঠুলি, মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়ার কোনও ‘উপযুক্ত মন্ত্র’ তাঁর জানা ছিল? যেটাই হয়ে থাকুক, সবার আগে তাঁকে ‘শাবাশ’ জানানো উচিত! কী করতে বাকি রেখেছেন তিনি? আইএএস অফিসারের ভুয়ো পরিচয়ে কলকাতার কেন্দ্রস্থলে বাতিওয়ালা গাড়ি হাঁকিয়ে মাসের পর মাস ঘুরেছেন। কলকাতা পুরসভার যে পদটি দশ বছর আগে বিলুপ্ত, নিজেকে সেই যুগ্ম কমিশনার বলে প্রকাশ্যে প্রচার করেছেন। পুরসভার জিএসটি নম্বর দিয়ে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। পুরসভার হলোগ্রাম ও প্রতীক ব্যবহার করে অফিস ফেঁদেছেন। বড় বড় নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে উঠে ছবি তুলেছেন। নিজের নামে সমাজমাধ্যমে সেই সব ছবি সাঁটিয়েছেন। আইনরক্ষকদের কুর্নিশ কুড়িয়েছেন। অথচ, কেউ এত দিন একটি প্রশ্নও তোলেনি বা তুলতে চায়নি। এহেন ‘কৃতী’ দেবাঞ্জনের ‘কৃতিত্ব’কে তাই খাটো করে দেখা ঠিক নয়।
তিনি ধরা পড়ার পরে পুলিশকে চরম ব্যবস্থা করতে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আশা করা যায়, সেই নির্দেশ পালনে এ বার পুলিশ যথাসাধ্য করবে। কিন্তু তাতে তাদের ‘দক্ষতার’ তকমা চকচক করবে, এমন ভাবার কারণ আছে বলে মনে করি না। প্রশাসন, পুরসভা এবং কিছু রাজনৈতিক লোকজনের ক্ষেত্রেও এ কথা একই ভাবে প্রযোজ্য। কাদা মাখামাখি হওয়ার পরে জানি না, দেখিনি, শুনিনি, বুঝিনি-র মতো কিছু ছেঁদো যুক্তিতে মূল বিষয়টি আড়াল হয়ে যায় না। বরং তার চেষ্টা হলে সেটা চরম অনৈতিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
জানা যাচ্ছে, দেবাঞ্জন ‘সমাজসেবা’ করতেন। সেই সুবাদেই নাকি বড় বড় নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। পুরভবনেও তাঁর যাতায়াত ছিল। সন্দেহ নেই, তাঁর সঙ্গে ববি হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়দের মতো নেতা-মন্ত্রীর যে সব ছবি বাজারে ঘুরছে, সেগুলি তোলার পরিসর বা মওকা তিনিই তৈরি করতে পেরেছিলেন।
এ কথাও ঠিক, নেতা-মন্ত্রীদের অনেক সময় অনেকের সান্নিধ্যে আসতে হয়, অনেকে তাঁদের কাছাকাছি চলে আসেন। তাঁদের সকলেই যে চেনা, ঘনিষ্ঠ বা প্রশ্রয়ে পুষ্ট, এমন বলা যায় না। তাই এ বিষয়ে ববি হাকিম যা বলেছেন, সেটা হয়তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিমানবন্দরে, বিমানে, দেশ-বিদেশের রাস্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে দেখি। অনেকেই এগিয়ে আসেন, তাঁর সঙ্গে ‘সেলফি’ তুলতে চান। আবার এক জনের কাঁধের পাশ দিয়ে অন্য কেউ মুখ বাড়িয়ে দেন এবং ছবিতে তাঁদের দেখা যায় মুখ্যামন্ত্রীর খুব কাছে!
তবে মমতা নিজে এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন এবং ওয়াকিবহাল থাকেন। ফলে এই রকম অবস্থায় সমাধানের একটি নিজস্ব পদ্ধতি তিনি তৈরি করে নিয়েছেন। সেটা হয়তো প্রকাশ্য আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু দেবাঞ্জনের ক্ষেত্রে যে সব তথ্য সামনে আসছে, তা দু’-চারটি ছবি তোলার চেয়ে ঢের বেশি গুরুতর। বিশেষ করে পুরসভা ও রাজ্য সরকারকে ওই ব্যক্তি যে ভাবে ব্যবহার করার সাহস দেখিয়েছেন, সেখানে একটি বড় প্রশ্ন চিহ্ন অবশ্যই থাকবে।
এটাও ধরে নেওয়া যায়, প্রশাসনে কোথাও তার কোনও ‘প্রশ্রয়-স্থল’ ছিল। যার ফলেই হয়তো ‘যোগাযোগ-ব্যবস্থা’ ছিল মসৃণ। দেবাঞ্জন সকল সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। যেমন, গত বছর নভেম্বরেও তিনি ‘সরকারি’ পরিচয় দিয়ে তালতলায় ঘুরেছেন। তারই জেরে এই বছর ফেব্রুয়ারিতে সেখানে রবীন্দ্র-মূর্তি স্থাপনের অনুষ্ঠান-ফলকে নেতাদের সঙ্গে তাঁর নাম খোদাই করা হয়। তত দিনে তাঁর নীল বাতি লাগানো গাড়ি!
ফলকে দেবাঞ্জনের নামের পাশে লেখা হয়েছিল, ‘মুখ্য উপদেষ্টা, যুগ্ম সচিব, রাজ্য সরকার’! একই ফলকে নাম ছিল প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর বিধায়ক-পত্নী নয়না ও আরও কয়েকজন নেতার। অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা অশোক চক্রবর্তী, ওরফে মানা, দীর্ঘ দিন সুদীপবাবু ও নয়নার অতি ঘনিষ্ঠ পার্শ্বচর। তৃণমূল ট্রেড ইউনিয়নেরও তিনি নেতা। তাঁর চেনা-জানা এবং অভিজ্ঞতা নেহাত কম নয়। দেবাঞ্জনের ওই রকম উদ্ভট একটি পদ দেখে মানার মনেই বা কোনও প্রশ্ন ওঠেনি কেন? সর্বোপরি, এতগুলি মাসের মধ্যে ওই ফলকের দিকে পুলিশ, পুরসভা, নেতা কারও নজর না পড়ার যুক্তিও কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য? না কি কোনও ‘গভীর’ কারণে বিষয়টির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা হয়েছিল? প্রশ্নগুলি সহজ। উত্তর হয়তো জটিল!
দেবাঞ্জন দেবের জালিয়াতির ‘রাজ-কাহিনি’ যেখানে শেষ হল, একই রকম আশ্চর্য লুকিয়ে আছে সেখানেও। প্রতিষেধক শিবিরের আগে থেকেই ওই এলাকায় নীল বাতির গাড়িতে ‘আইএএস’-টির নিত্য যাওয়া-আসা, পুরসভার নামে অফিস খোলা। অথচ, এ সব তথ্য নাকি স্থানীয় কোনও ‘দাদা’ এবং পুলিশ কারও গোচরে ছিল না! এ শুধু দুর্ভাগ্যের নয়, উদ্বেগেরও বিষয়।
এই উদাহরণ সামনে রেখে তাই প্রশ্ন তোলা যায়, পুলিশ, নেতা সবাই কি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন? দক্ষতা কমছে? টাকা পেয়ে চুপ করে থাকেন? না কি, ‘খুঁটির জোর’ বুঝলে ঘাঁটান না?
দেবাঞ্জন-কাণ্ড কোন গোত্রে পড়বে, জানি না। তবে অনুমান করি, সত্যিকারের তদন্ত হলে ‘রুই-কাতলা’ জালে পড়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট।