সে রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্যে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ উধাও হয়ে যাওয়ার পরে কী হয়েছে জানার জন্যে শরণাপন্ন হলাম গুগলের। এবং ‘আউটেজ’ শব্দটির সন্ধান পেলাম। অর্থ খুঁজতে গিয়ে দেখি, ‘বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাঘাত’, ‘পরিষেবার ব্যাঘাত, ‘ব্ল্যাক আউট’-কে আউটেজ বলা হচ্ছে। লোডশেডিং বা যখন তখন কারেন্ট চলে যাওয়ার সঙ্গে কম বয়স থেকে পরিচয় আছে। ব্ল্যাক আউট আমি না দেখলেও বাবা-মায়ের মুখে শুনেছি। আউটেজ-এর আরও মানে দেখলাম যান্ত্রিক ব্যর্থতা, পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যর্থতা, মানসিক স্বাস্থ্যের পতন।
েভবেচিন্তে মনে হল, শেষ তিনটে অর্থ দিয়েই চার তারিখের ‘টেক আউটেজ’কে সব থেকে ভাল ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। বিশ্ব কতটা টেকনলজি নির্ভর হয়ে উঠেছে, মার্ক জ়াকারবার্গের প্রতিষ্ঠান কয়েক ঘণ্টার জন্যে বন্ধ হয়ে গেলে সেটা হাড়ে হাড়ে বোঝা গেল। ফেসবুকের অ্যাপগুলি (যার মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার এবং অকুলাস) ‘এরর মেসেজ’ বা ত্রুটি বার্তা দেখিয়ে অকেজো হয়ে যায়। পাঁচ ঘণ্টা ধরে আউটেজ চলার পরে কিছু অ্যাপ স্থিতিশীল হয়।
মেসেজিং, লাইভ স্ট্রিমিং, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও ডিজিটাল পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত করে ফেসবুক নিজেকে একটি অপরিহার্য প্ল্যাটফর্মে তথা মনোপলি মার্কেটে পরিণত করেছে। ভারতের মতো দেশে ফেসবুক আর ইন্টারনেট সমার্থক। বিশ্বে ৫০০ কোটির বেশি মানুষ ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে বন্ধু, পরিবার এবং সহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শ বিতরণ করেন, পেজ বা গ্রুপ তৈরি করে বিজ্ঞাপন ও প্রচারের মাধ্যমে ব্যবসা করেন। এ ছাড়াও আছে ই-কমার্স সাইট। বাংলার কথাই ভাবা যাক। পুজোর সেল আউটেজ-এর ‘ডোমিনো এফেক্ট’-এ প্রবল ধাক্কা খেল। একে ‘পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যর্থতা’ ছাড়া আর কী বলব?
আউটেজ কেন হল? জটিল বিষয়। জ়াকারবার্গের কোম্পানি বছরের পর বছর ধরে ডেটা সেন্টারের এক বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। সেই নেটওয়ার্কের নির্দিষ্ট একটি বিন্দুতে সমস্যা শুরু হয়। ‘বর্ডার গেটওয়ে প্রোটোকল’ বা বিজিপি নামের একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নেটওয়ার্ক অপারেটরদের ফেসবুক জানায় তার নিজস্ব সার্ভারগুলির অবস্থান কোথায়। ৪ অক্টোবর, অনিবার্য কারণবশত ফেসবুকের বিজিপি তথ্য প্রত্যাহৃত হয়। যার মানে হল ফেসবুক তার নিজস্ব ‘ডোমেন নেম সিস্টেম’ বা ‘ডিএনএস’-এর অবস্থান জানাচ্ছে না। অর্থাৎ, ইন্টারনেট হাইওয়েতে ফেসবুকের কোনও ঠিকানা নেই। কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। পরিষেবা ফিরে আসার পরে ফেসবুক জানায়, ডেটা সেন্টারগুলির মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদান দেখাশোনা করে যে ইন্টারনেট পরিকাঠামো— সেখানে সমস্যা শুরু হয়। পরে এটি দ্রুত অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। ক্যালিফর্নিয়ার সান্তা ক্লারার একটি ডেটা সেন্টারে এক দল বিশেষজ্ঞ, ফেসবুকের সার্ভার কম্পিউটারে অ্যাকসেস পাওয়ার পরে পরিষেবা স্বাভাবিক হয়।
হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ হয়ে বেজায় অসুবিধায় পড়লাম। গুনে দেখলাম, কাজের জায়গায়, সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ রাখার জন্যে অন্তত পাঁচটি গ্রুপের সদস্য আমি। অতিমারির সময় স্পর্শবিহীন আদানপ্রদানের জন্য ডকুমেন্টের ফটো পাঠিয়ে কী লাভ যে হয়েছে, হিসাব নেই। সহকর্মীরা টেনশনের চোটে চুল ছিঁড়তে শুরু করলেন। কাজের বাইরে অন্য ছবিটা সব জায়গায় এক রকম। যাঁদের বাড়িতে ফেসবুক-অ্যাডিক্ট আছে, তাঁরা নিশ্চয় দেখেছেন, সোমবার রাতে কত বার স্মার্টফোন রিস্টার্ট করছেন ফেসবুক নেশাড়ুরা। আউটেজ-এর আর এক মানে যে ‘মানসিক স্বাস্থ্যের পতন’, সেটা মনে পড়ে গেল।
অতীতেও ফেসবুকে আউটেজ হয়েছে। তবে পৃথিবী জুড়ে নয়, এত দীর্ঘ সময়ের জন্যেও নয়। মনোপলি মার্কেটের খারাপ দিক চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল এই আউটেজ। আমরা, যারা কাজের জন্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং মিডিয়া ব্যবহার করি, তারা হোয়াটসঅ্যাপের বদলে অন্য কোনও প্ল্যাটফর্মে গ্রুপ খুলে রাখব, যাতে আবার এই সমস্যায় পড়তে না হয়! ব্যবসা বা যোগাযোগের জন্যে যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাঁরাও প্ল্যান বি রেডি রাখবেন।
শেষ করি আর্থার হেলির লেখা ওভারলোড উপন্যাস দিয়ে। ক্যালিফর্নিয়ায় ‘গোল্ডেন স্টেট পাওয়ার অ্যান্ড লাইট’ নামে এক কাল্পনিক পাবলিক সেক্টর কোম্পানিকে নিয়ে লেখা উপন্যাসটির বিষয়, লোডশেডিং। এক গ্রীষ্মে সন্ত্রাসবাদী হামলায় সংস্থাটির বিদ্যুৎ সরবরাহ করার ক্ষমতা কমে যায়। স্বল্প জোগান ও আকাশচুম্বী চাহিদা মেটানোর জটিল ধাঁধা ছিল উপন্যাসের মূল বিষয়।
অতীতে বিদ্যুৎ, আজ ডেটা। অতীতে ব্ল্যাক আউট আর লোডশেডিং, আজ আউটেজ। সময়ের সঙ্গে সমস্যা বদলায়, সমস্যার নাম আর ধরন বদলায়। যা ধ্রুব থেকে যায় তা হল মানুষের যন্ত্র-নির্ভরতা। এ এমন এক ‘দরকারি শয়তান’, যার হাত থেকে মুক্তি নেই।