এক একটা জয় মানেই এক একটা সাফল্য। প্রতিটি সাফল্য আবার নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়। নতুন কর্তব্য হাজির হয় নতুন সাফল্যের সামনে। বিধানসভা নির্বাচনে জনবাদীদের জয় এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। অনেকে বলেছেন যে, জনবাদীদের এই বিপুল জয় বাংলাকে বাঁচিয়েছে, দেশকে বাঁচিয়েছে। এই কথা সঙ্গত। অন্য দিকে এও বলা যায়, বাংলার জনগণ জনবাদীদের জয়ী করে জনবাদীদের বাঁচিয়েছে। তাই এই প্রশ্ন তোলা সঙ্গত যে, বাংলার মানুষ জনবাদী শক্তিকে জয়ী করেছে— এ বার তারা জনবাদী প্রশাসন এবং জনবাদী নেতা ও কর্মীদের থেকে কী প্রত্যাশা করে?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য কোনও গভীর রণনৈতিক চিন্তাভাবনার দরকার নেই। দরকার রাজনৈতিক সাধারণ বুদ্ধি এবং অতীতের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে এক সম্যক ধারণা।
জনবাদীদের কর্মকাণ্ডের যে সব দিক সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়েছে, সাড়া জাগিয়েছে সমস্ত মানুষের মাঝে, তা সবাই জানেন। এগুলোর শুধু উল্লেখই যথেষ্ট। কন্যাশ্রী, খাদ্যসাথী, শিক্ষার প্রসার, ও এই ধরনের বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তামূলক নীতি ও কর্মসূচি সময়োপযোগী প্রমাণিত হয়েছে। অনুরূপ, এই দু’বছর ধরে চলা অতিমারির কালে জনস্বাস্থ্য ও অন্যান্য পরিষেবার প্রসার সাধারণ মানুষকে সরকারের উপর আস্থা রাখতে উৎসাহিত করেছে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিধ্বংসী ঘটনার মোকাবিলায় জনবাদী প্রশাসনের প্রচেষ্টাও জনসমর্থন পেয়েছে। তৃণমূল স্তরে নানা বিচ্যুতি ও দুর্নীতি এই সমর্থনের ভান্ডারে ক্ষয় ধরাতে পারেনি। সর্বোপরি, জনবাদীদের প্রশাসননীতি— যার মূল কথা সরকার আপনার দুয়ারে পৌঁছবে— গ্রাম, ছোট শহর, বড় শহর নির্বিশেষে লোককে ভাবিয়েছে যে, অন্য ভাবে প্রশাসন চালানো সম্ভব।
জনমুখিতা এই প্রশাসনের বৃহত্তম সম্পদ। কিন্তু তার পর? এই কর্মসূচির পুনরাবৃত্তিমাত্র? না কি, জনমুখিতাকে নতুন দিকে প্রসারিত করা? এবং বাধাগুলির সম্পর্কে এক সম্যক ধারণার উপর ভিত্তি করে নতুন দিকে জনবাদী প্রশাসনের মোড় ঘোরানো? অবশ্যই, গণপরিষেবার ধারণাকে অনেক প্রসারিত করা যায়। শহর থেকে গ্রামে, বড় শহর থেকে ছোট শহরে, উচ্চবিত্ত এলাকা থেকে দরিদ্র ও বস্তি এলাকায়, উচ্চবর্ণপ্রধান জনমণ্ডলী থেকে অধোবর্ণের জনমণ্ডলীতে এবং বাংলার অপেক্ষাকৃত উপেক্ষিত এবং অবহেলিত এলাকায় গণপরিষেবাকে প্রসারিত করা, ও এই সব এলাকা এবং জনমণ্ডলীও এবং পরিষেবার ভার সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ আছে। প্রয়োজনও রয়েছে। তেমনই নারীসমাজের অধিকার, নিরাপত্তা, মর্যাদা, অর্থনৈতিক সুরাহা ও কর্মসংস্থানকে গণপরিষেবার মূল নীতির এক বড় অংশ করে তোলা যায়।
এক কথায় গণপরিষেবার সংজ্ঞাকে প্রসারিত করতে হবে; পরিবর্তন আনতে হবে এই সংজ্ঞায়। এর জন্য প্রয়োজন অধিক মাত্রায় সরকারি বিনিয়োগ, সম্পদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নতুন ভাবনা এবং নীতি, এবং সরকারি-বেসরকারি এবং সামাজিক সহযোগিতা নিয়েও নতুন করে চিন্তা। বলা যায়, রাজনৈতিক উদ্ভাবনশীলতার যে স্বাক্ষর জনবাদীরা বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসে রেখেছেন, আর্থিক সংস্কার ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সেই উদ্ভাবন ক্ষমতার পরিচয় এখনও সেই মাত্রায় পাওয়া যায়নি। এর জন্য প্রয়োজন, কিছুটা পরিমাণে রণনৈতিক চিন্তা; অল্প মাত্রায় হলেও দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা। সাধারণ মানুষ কী চায়, সামগ্রিক কল্যাণ অথবা সমবেত উন্নয়ন সম্পর্কে কী তাদের প্রত্যাশা, এ নিয়ে জনবাদীদের আরও ভাবতে হবে। সামাজিক ও বস্তুগত পরিকাঠামোর উন্নতির দিকে অনেক বেশি পদক্ষেপ করতে হবে। নচেৎ জনপরিষেবার প্রসার দুরূহ।
দুটো উদাহরণ যথেষ্ট। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘিরে চিন্তাভাবনা এবং নির্দিষ্ট পদক্ষেপ লক্ষ লক্ষ পরিবারকে এগিয়ে আসতে সাহায্য করবে। তেমনই কৃষি ও কৃষককে ঘিরে কর্মসূচি ‘দুয়ারে সরকার’কে অর্থনৈতিক সারবত্তা জোগাবে। কৃষক মান্ডি, কৃষিতে উৎপাদন পণ্য সরবরাহ, এবং কৃষি সমবায়— এই তিন ক্ষেত্রে জনবাদীদের চিন্তাভাবনায় গতি আনতে হবে। সৃষ্টিশীলতা না আনলে জনবাদীদের এই বিপুল জয়ের সদ্ব্যবহার হবে না— অচিরেই এক বদ্ধদশায় পড়বেন জনবাদীরা। প্রতিটি সফলতার অর্থ, নতুন প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করে পূর্বতন সাফল্যকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা। জনজীবনের নানা দিকে, শিক্ষা স্বাস্থ্য সংস্কৃতি ও উৎপাদন-সহ নানা ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল অগ্রগতি জনগণের প্রত্যাশার মূল্য দিতে পারবে। ছোট এবং মাঝারি পুঁজিকে ব্যবহার করতে পারবে বাংলার সামগ্রিক উন্নতির লক্ষ্যে।
বাংলার জনজাগরণ জনবাদীদের দেশের সামগ্রিক মানচিত্রে লক্ষণীয় ভাবে হাজির করেছে। প্রশ্ন হল, যে অভিনবত্ব বাংলার রাজনীতির মোড় ঘোরালো, তেমন অভিনবত্ব ছাড়া কি পুরনো পন্থায় জাতীয় রাজনীতিতে জনবাদী স্বাক্ষর রাখা সম্ভব?
এক শব্দে উত্তর দেওয়া যায়, না।
তা হলে এই নতুন দিগ্নির্দেশ কী ভাবে পাওয়া যেতে পারে? এক দিকে ভাবা দরকার যে, বাংলায় এই সাফল্যের মূল শিক্ষাগুলি কী, যাতে দেশের অন্যত্র তাকে নিয়ে যাওয়া যায়, অবশ্যই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের আধারে; তেমনই অন্য দিকে সমগ্র দেশের ক্ষেত্রে নতুন দীর্ঘমেয়াদি ও রণনৈতিক চিন্তাভাবনার দরকার। তামিলনাড়ু, বাংলা, কেরল-সহ বিভিন্ন রাজ্যের জাতীয় সত্তা সেই সব অঞ্চলের রাজনৈতিক শক্তিকে সংহত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা এবং শক্তিশালী করার দাবিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই পথে এগোনোর কথা ভাবতে গেলে সমগ্র দেশে গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম কর্মসূচির কথা আসবে। আজকের প্রেক্ষাপটে ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি কী হতে পারে? এ নিয়ে বিভিন্ন প্রাদেশিক জাতিসত্তামূলক শক্তিগুলির সঙ্গে নিরন্তর আলাপচারিতা প্রয়োজন। রণনৈতিক চিন্তাভাবনা জাতীয় ক্ষেত্রে জনবাদীদের সর্বাপেক্ষা জটিল সমস্যার সমাধানে সাহায্য করবে— তা হল, কে জনবাদীদের শত্রু, কে জনবাদীদের মিত্র। এই শত্রু-মিত্র নির্ণয়ের কর্তব্য চিরকালই থাকবে, শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞাও পাল্টাবে। কিন্তু এই বিশ্লেষণকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে এগোনোর উপায় নেই। ন্যূনতম কর্মসূচি এই কর্তব্যে প্রাসঙ্গিক।
পশ্চিমবঙ্গে সাফল্য এবং রাজনৈতিক শক্তির সংহতি এবং জাতীয় ক্ষেত্রে অগ্রগতির মাঝে সম্পর্ক গভীর এবং দ্বন্দ্বাত্মক। শুধু ‘বাংলা মডেল’-এ কাজ হবে না, আবার তাকে ছাড়াও এগোনো যাবে না। তাই পরিষ্কার থাকা দরকার, ‘বাংলা মডেল’ এই ভাবনার অর্থ কী? কী সেই বৈশিষ্ট্যের সমাহার, যার ভিত্তিতে বলা সম্ভব, বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিকে এক আদিকল্পের রূপে ভাবা যায়? এই বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল রাজনীতিতে প্রশাসনিকতা নিয়ে নতুন করে ভাবা। বিশেষত, যেখানে জনবাদীরা প্রশাসনের ক্ষেত্রে নিজস্ব ছাপ রেখেছেন।
সর্বভারতীয় স্তরে সামাজিক জনবাদ কী ভাবে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে? উগ্র জাতীয়তাবাদ, নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক আগ্রাসন, অত্যধিক কেন্দ্রীভবন, অসংগঠিত লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক খাতে রাষ্ট্রের ব্যয়সঙ্কোচন, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, দেশের নিরাপত্তার নামে সব ধরনের নিপীড়নের সাফাই— এই সবের বিরুদ্ধে ন্যূনতম কর্মসূচি একমাত্র জনবাদীরাই দেশের সামনে হাজির করতে পারবেন। ধর্মান্ধতা ও সংখ্যালঘু নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়ে অনেকেই এগিয়ে আসবেন। কিন্তু স্বৈরতন্ত্র-বিরোধিতার জন্য যে তা যথেষ্ট নয়, আজ তা প্রমাণিত। কাজেই ভাবতে হবে, বঙ্গ-রাজনীতিতে জনবাদী ধারণার যে ব্যাপকতা, তা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক মানসে কী ভাবে প্রোথিত হবে?
স্পষ্টতই, দেশের প্রশাসনিক কল্পনায় জনবাদীদের নিজস্ব চিন্তাভাবনার ভূমিকা কী হতে পারে, তা স্থির করা প্রয়োজন। এবং কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বিক্ষোভ আন্দোলন যত গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই তাৎপর্য বহন করে ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচির জন্য প্রয়াস। বাংলার প্রশাসনের অভিজ্ঞতা এবং জনমুখিতার স্বকীয় চরিত্র এই ভাবেই সম্পর্কিত সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রয়াসের সঙ্গে।
বিরোধী রাজ্য সরকারগুলির সমাবেশ ও মতামত বিনিময়ের এক স্বতন্ত্র মঞ্চ ছাড়া এই যোগবন্ধন সম্ভব নয়। বিরোধী রাজ্যসরকারগুলি এই রকম আলাপচারিতায় হয়তো এখনই যোগ দেবে না। তাই যারা ইচ্ছুক, সম্ভবত তাদের নিজস্ব আলাপচারিতার ভিত্তিতে এগোতে হবে। কেরল, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ় ইত্যাদি প্রদেশের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার এক সাধারণ নির্যাস আছে, যা অভিন্ন কর্মসূচির পাথেয় হতে পারে। বিশেষত খাদ্যসংস্থান, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, অতিমারির মোকাবিলা ইত্যাদির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার পারস্পরিক আদানপ্রদান দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভিত্তিকে শক্তি জোগাবে। কৃষি, কৃষক, এবং ছোট ও মাঝারি পুঁজি— এই তিন বিষয়ে মনোযোগ এক সমবেত রাজনৈতিক শক্তিকে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।
কিছুটা হলেও অপেক্ষাকৃত দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা ও রণনৈতিক পরিকল্পনা বলতে আমি এই সবই বোঝাতে চেয়েছি। এই পরিকল্পনায় বাংলার রাজনীতি ও প্রশাসনকে দৃঢ় করা ও জাতীয় কর্মসূচির লক্ষ্যে এগোনো— এই দুইয়েরই গুরুত্ব আছে।
সংক্ষেপে বলা যায় যে, অধোবর্গের মানুষজন, নারীসমাজ এবং নিজস্ব সত্তাবোধের ভিত্তিতে এখানে জনবাদী আন্দোলন ২০২১-এর সঙ্কটকে কাটিয়ে উঠেছে; সমগ্র দেশের ক্ষেত্রে এই তিন উপাদানভিত্তিক রণনীতি প্রণয়নের উপায় কী হতে পারে— এই হল আজ জনবাদীদের কাছে সর্বাপেক্ষা বড় চ্যালেঞ্জ। এ এক অভিনব পরিস্থিতি। কেতাবি ধারণায়, লোকেদের পথ স্থির থাকে। তারা পাথেয় খোঁজে। এ ক্ষেত্রে পাথেয় প্রস্তুত। পথে চলার উপাদান মজুত। এ বার দরকার স্থির করা, এই পাথেয় নিয়ে কোন পথে এগোব?
পথে নেমে পাথেয় পাওয়া গিয়েছে। এই পাথেয় এ বার সম্বল। পথই এই ভাবে আরও এগোবার সমস্যার সমাধান করে।
সমাজবিজ্ঞানী