‘চিন্তাশক্তি আর একটু ব্যবহার করুন, বামপন্থীদের কাছে এই দাবি আমরা সাধারণ মানুষরা তো করতেই পারি।’ বললেন অমর্ত্য সেন।
Amartya Sen

কার্পণ্য নয়, ঔদার্য দরকার

এক দিকে দেশ চালানো, রাজত্ব করা, আর অন্য দিকে বামপন্থী সচেতনতা বজায় রাখা— এই দুইয়ের মধ্যে একটা বচসা আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২১ ০৪:৫৮
Share:

ফাইল চিত্র।

প্রশ্ন: আপনি বামপন্থীদের চিন্তার বিভ্রান্তির কথা বলেছেন। (‘অভাব সুচিন্তা সমদৃষ্টির’, ৮-৬) এই বিভ্রান্তির কারণটা কী হতে পারে?

Advertisement

অমর্ত্য সেন: এটা নিয়ে চিন্তা করার খুবই প্রয়োজন আছে। এই চিন্তাটা একেবারে ভিত্তিহীন ভাবে এল, তা-ও নয়। আমি যখন ছাত্র ছিলাম প্রেসিডেন্সি কলেজে, স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সদস্য ছিলাম, কিছু দিন একটু নেতৃত্বও করতে হয়েছিল। এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে বামপন্থীরা সে-বারই প্রথম, পুরোপুরি জিতলেন না বটে, কিন্তু আধা জিতলেন। আমরা যে সফল হলাম, সেটা শুধু স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সাহায্যে নয়, আমাদের তত নির্বাচিত সদস্য ছিল না। এই সময় যে প্রশ্নটা আমাদের খুব সামনে এসেছিল সেটা হচ্ছে— অন্যদের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রয়োজন নিয়ে। একটা অংশের বক্তব্য ছিল, অন্যদের কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, আমাদেরই নিজেদের সব কাজ করতে হবে। কিন্তু অন্য দিকে, হাত মেলানো যে প্রয়োজন, এই বিষয়ে একটা বড় রকম বোধ আমাদের অনেকের মধ্যেই এসেছিল। মনে হয়েছিল, আমাদের দৃষ্টি একটু প্রসারিত করা দরকার। চিন্তায় একটা উদারতা নিয়ে আসা দরকার।

উদারতার উল্টোটা হচ্ছে কার্পণ্য। যেমন, অন্যদের কোনও কৃতিত্ব আমরা দেব না, যদি কেউ সেকুলার হয় কিন্তু আমাদের দলের না হয়, তা হলে আমরা তাদের ছি ছি করব— এমন ধারণার মধ্যে একটা চিন্তার কার্পণ্য আছে। এই কার্পণ্যটা সবচেয়ে বেশি দেখা গেল, যখন বামপন্থীরা বহু দিন ধরে রাজত্ব করার পরে হঠাৎ ঘা তো খেলেনই, তাঁদের বড় রকমের পতন হল। কেন এ রকম হল তা নিয়ে চিন্তা করার অনেক কারণ থাকতে পারে। বিশেষ করে, এটা বলা যায় যে, এক দিকে দেশ চালানো, রাজত্ব করা, আর অন্য দিকে বামপন্থী সচেতনতা বজায় রাখা— এই দুইয়ের মধ্যে একটা বচসা আছে। সেটা তো সব দেশেই দেখা যায়, যেমন রাশিয়াতেও দেখা গিয়েছিল। অন্যত্রও আমি উল্লেখ করেছি, রবীন্দ্রনাথ যখন সেখানে গেলেন, ১৯৩০ সালে, সেই সম্পর্কে রাশিয়ার চিঠি-তে এক দিকে তিনি বলছেন যে— এখানে সবাইকে শিক্ষা দেওয়ার যে চেষ্টা চলছে তার মধ্যে একটা প্রচণ্ড বড় গুণ আমি দেখতে পাই, কিন্তু যাদেরই ওঁদের সঙ্গে মতে মিলছে না, তাদের শাসন করার যে প্রচেষ্টা, তা নিয়ে একটা বড় রকমের চিন্তার কারণ আছে। তিনি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সোভিয়েট সরকারের ইজ়ভেস্তিয়া কাগজে। শিক্ষা নিয়ে রাশিয়ার যে প্রশংসা করেছিলেন তার জন্য রবীন্দ্রনাথ খুব বাহবা পেলেন। কিন্তু যেখানে তিনি চিন্তার কার্পণ্য এবং অন্যদের নাজেহাল করার প্রচেষ্টা নিয়ে সমালোচনা করলেন, সেটা ওরা ছাপল না। তবে ইজ়ভেস্তিয়া-র সাক্ষাৎকারটি ছাপা হল বিলেতের ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান-এ। তার বহু দশক বাদে গোর্বাচেভের আমলে ইজ়ভেস্তিয়া সেই পুরনো সাক্ষাৎকার শেষ অবধি ছাপতে পারলেন।

Advertisement

আমাদের দেশেও এই বিষয়ে একটা চিন্তার বিভ্রাট হয়ে থাকতে পারে। বামপন্থী নেতারা যেমন এক দিকে দেশ চালাতে পারেন, তেমনই অন্য দিকে বামপন্থী কর্মী হিসেবে নতুন কী করা যায়, সে সম্বন্ধে তাঁদের চিন্তা করার প্রয়োজন ছিল। যেটা বামপন্থীরা এক সময় করেছেন, যেমন ভূমি সংস্কার নিয়ে, পঞ্চায়েত নিয়ে— কেরলে তো নানা ভাবে করেই চলেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সেই ঐতিহ্যটা যেন ছেড়ে দেওয়া হল, যখন দেখা গেল বহু দশক ধরে তাঁরা রাজত্ব করছেন এবং কিছু একটা সমস্যা হলেই বলা হচ্ছে— ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে একটু খবর দাও, তা হলেই সব হয়ে যাবে। এখন, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে খবর দিয়ে সমস্যার সমাধান করাটাকে তো ঠিক ‘কমিউনিস্ট সলিউশন’ বলা যাচ্ছে না!

এর ফলে, বাম রাজত্বের শেষের দিকে, এমন একটা ব্যাপার দাঁড়াল যে, যাঁরা লোকের হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বলতে পারেন, তাঁরা বামফ্রন্টকে হারিয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ পেলেন। এই সময় বামপন্থীদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার অনেক কারণ ছিল। তার পরে যখন ওঁরা হেরে গেলেন, এবারের নির্বাচনের মতো এতটা গোহারা না হলেও বড় রকম হারলেন, তখন তাঁদের চিন্তায় একটু ঔদার্যের প্রয়োজন ছিল, চিন্তা করবার দরকার ছিল যে, এদের— বিজেপি-বিরোধী বাম ও অ-বাম পার্টিগুলোর— সঙ্গে আমাদের মতবিরোধটা কোথায়। নিশ্চয়ই বিরোধ আছে কিছু, নইলে আমরা বামপন্থী কেন আর ওরা বামপন্থী নয় কেন; কিন্তু সেই বিরোধ সত্ত্বেও আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রাধান্য দিয়ে কতটা হাত মেলাতে পারি।

আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু আমার ধারণা, এখন এই নিয়ে চিন্তার একটা প্রচণ্ড প্রয়োজন এসেছে। বামপন্থীরা এমন একটা মার খেলেন— স্বাধীনতার পর থেকে কখনও এমন হয়নি যে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী দলের এক জনও এমএলএ নেই— এটা কী করে সম্ভব হল? আমরা থাকি এমন একটা জায়গায়, যেখানে একশো বছর ধরে নানা দিক দিয়ে বাম চিন্তা এসেছে, সেখানে এই পরিণতির পিছনে কতটা ভুল আছে, সেই নিয়ে ভাববার খুব বড় রকমের কারণ আছে। এটা শুধু পুরনো বামপন্থী চিন্তার ব্যাপার নয়, ঔদার্য এবং কার্পণ্য নিয়েও একটা বড় রকম আলোচনা দরকার। আমার মাস্টারমশাই পিয়েরো স্রাফা— তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর খুবই যোগ ছিল, এবং ওঁদের যে পত্রিকা ছিল তা চালাতেও তিনি বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন— তাঁর সঙ্গে ইটালির কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা আন্তোনিয়ো গ্রামশির অনেক তর্কাতর্কি হয়েছে, সে বিষয়ে আমি আগেও আলোচনা করেছি, এবং আমার যে একটা বই বেরোচ্ছে ইংরেজিতে— হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড— তাতে এই তর্ক নিয়ে খানিকটা আলোচনা আছে। এই তর্কটা মাঝে মাঝেই এসেছে, নানা দেশেই। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এই তর্কটা খুবই বড়। আমাদের ভাবতে হবে, কী কারণে আমাদের দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের এই পতন ঘটল এবং সেটার জায়গায় কোন দিকে যাওয়া দরকার। এখনও আমরা যদি চিন্তার কোনও পরিবর্তন না দেখি, যদি এমন হয় যে এক নেতার জায়গায় আর এক নেতা এলেন, কিন্তু চিন্তাভাবনা একই থেকে গেল, তা হলে বামপন্থীদের খুব উন্নতি হবে, সেটা মনে করা কঠিন।

প্র: বামপন্থীদের জোর তো তাঁদের চিন্তায়, অথচ তাঁরা আজ নিজেদের ভুলগুলোকেও স্পষ্ট ভাবে ধরতে পারছেন বলে মনে হয় না।

উ: এখানেও আমার মনে হয় সমস্যাগুলোকে দুটো ভাগে ভাগ করা দরকার— কোন ভুলগুলোর মধ্যে চিন্তার বড় রকম বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে, আর কোনগুলো সেই তুলনায় সূক্ষ্ম ভুল। যে ভুলগুলো এসেছে চিন্তার বড় বিভ্রান্তি থেকে, প্রথমে তো সেগুলো সংশোধনের জন্যেই যথেষ্ট চেষ্টা করা দরকার। বিজেপির বিরোধিতায় অন্য দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের প্রশ্নে বামপন্থী দলের নেতারা যে পার্থক্যগুলোর ওপর জোর দিচ্ছেন সেগুলো নানা ধরনের সূক্ষ্ম বিচারের ব্যাপার। তার প্রয়োজন হয়তো কম নয়, কিন্তু স্থূল ভুলগুলোকে সূক্ষ্মতার জালে জড়িয়ে ফেলার সত্যিই কোনও যুক্তি নেই। তাঁদের দেখাতে হবে যে তাঁদের সুবিচারের কল্যাণে স্থূল ভুলগুলো তাঁরা প্রথমেই ধরতে পারছেন, যেগুলো অন্যরা এখনও অবধি ধরতে পারছে না— বামপন্থীদের সঙ্গে এখানেই অন্যদের বড় তফাত। যে চিন্তাকে বামপন্থী ধারার সঙ্গে যোগ করা যায় সেটা বজায় রাখা দরকার, আবার অন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যতটা কাজ করা সম্ভব সেটাও করা দরকার।

বামপন্থী দলগুলোর দুরবস্থাতে আমি যদি দুঃখপ্রকাশ করে থাকি, তার একটা কারণ হচ্ছে এই যে, তাঁদের নেতৃত্বের কাছে তো এই প্রাথমিক চিন্তাগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবেই আশা করা যেত, অথচ সেটা একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। বামপন্থীরা যদি সামগ্রিক ভাবে অন্য দিকে আমাদের পথ দেখাতেন, সেটা তো সমাজের পক্ষে ভাল হতে পারত, অথচ সেটা আমরা দেখছি বলে মনে হয় না। বামপন্থীদের নিজেদের চিন্তার বলিষ্ঠতা খুবই দরকারি, যার ভিত্তিতে তাঁরা পুরনো সামাজিক সমস্যাগুলির নতুন সামাজিক সমাধান কী ভাবে করা সম্ভব সে বিষয়ে ভাবতে পারেন। ভূমি সংস্কার হল, পঞ্চায়েত হল, ভাল কথা, কিন্তু তার পর কী? সামাজিক সমতায় বিশ্বাসের প্রয়োজন এবং চিন্তাশক্তির সুব্যবহারের প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এর কোনওটাই তো বামপন্থীদের অপরিচিত নয়। তাঁরা সেই বিশ্বাস এবং চিন্তাশক্তি আর একটু ব্যবহার করুন— বামপন্থীদের কাছে এই দাবি আমরা সাধারণ মানুষরা তো করতেই পারি।

সাক্ষাৎকার: অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও কুমার রাণা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement