বধূটিকে মারধর করে শ্বশুরবাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হত প্রায় রাতেই। এ দেশের বেশির ভাগ বিবাহিত মেয়ের মতোই, বাপের বাড়ি ফেরার রাস্তা খোলা ছিল না গুরুগ্রামের এই মেয়েটিরও। ছিল না অন্য কোনও আস্তানা জুটিয়ে নেওয়ার রেস্তও। তাই বার করে দেওয়া সত্ত্বেও, শ্বশুরবাড়িরই দরজা খোলার অপেক্ষা করত মেয়েটি। এই জানুয়ারিতে তার অপেক্ষা ফুরাল। হরিয়ানার শীতের হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা আর সইতে পারেনি নিত্য মার খাওয়া শরীরটা। দরজা খোলার আগেই শ্বাস বন্ধ হল তার।
সব মেয়েকে অবশ্য মৃত্যু এসে নিষ্কৃতি দেয় না। মারধর করে শ্বশুরবাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার ঘটনা প্রায়শই ঘটে এ দেশের মেয়েদের সঙ্গে। আর, বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার হুমকি তো জোটে অহরহই। ‘এ বাড়িতে তোমার আর জায়গা হবে না’ কিংবা ‘বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে’— ভাষাগত শালীনতাভেদে, এ দেশের বিবাহিত মেয়েদের আকছার এমন কথা শুনতে হয়।
কিন্তু কেন শোনেন মেয়েরা?
কথা হচ্ছিল ফুলমণি কুর্মির (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে। খেমাশুলি স্টেশনের কাছে, পশ্চিম মেদিনীপুরের এক গ্রাম। যদিও তাঁদের ভাষা কুরমালি, তবু স্টেশনের কাছে চা-ম্যাগি-ডিমসেদ্ধর দোকান চালান বলে ফুলমণির কথার টান খানিক কম। শহুরে মানুষ বুঝতে পারেন। জানতে পারলাম, ফুলমণির স্বামী পরিযায়ী শ্রমিক। রাজমিস্ত্রির কাজ করেন কেরলে। বাড়ি আসেন সাকুল্যে বছরে দু’বার। ছুটিতে। প্রথম দু’চার দিন ভালই কাটে। তার পর শুরু হয় অশান্তি, মারধর, বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া।
বার করে দিলে কী করেন?
আমাদের ম্যাগির জন্যে আনাজ কাটার গতি অক্ষুণ্ণ রেখেই উত্তর দেন ফুলমণি— “বাইর দাওয়ায় শুই গো। কাপড়খান জড়ায় নিই গায়ে।”
ব্যস? এমন অন্যায় অত্যাচারের এমন যৎসামান্য প্রতিক্রিয়া? বলি, চলে যান না কেন?
চায়ের জলের চিনি নাড়াতে নাড়াতে একই রকম নিরুত্তাপ উত্তর আসে, “উপায় হয় না রে, দিদি।”
সত্যিই তো। রাষ্ট্রই হোক বা পরিবার, কতটুকু উপায়, কতটুকু সুযোগ দেয় এ দেশের মেয়েদের? একে তো আজও এ দেশের প্রায় সত্তর শতাংশ মহিলাই অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর নন। স্বামী-শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের প্রতিবাদে ঘর থেকে যে বেরোবেন— যাবেন কোথায়?
আবার, রোজগার করলেই কি সমাধান মেলে? এই যে ফুলমণি, চা-ডিমসেদ্ধ-ম্যাগির দোকানে রোজগার তো একটা আছেই, কিন্তু কে বা কারা যেন শিখিয়ে দিয়েছে যে, সে রোজগার তার নিজের নয়, সংসারের। ছেলেপুলের, শ্বশুরের দেখভালের, বছরান্তে ঘরে ফেরা বরের মদ খাওয়ারও হতে পারে— কিন্তু তাঁর নিজের নয় কখনও। খেমাশুলি থেকে কলকাতা, দার্জিলিং থেকে সুন্দরবন, দিল্লি থেকে পুণে, ট্রেনের লেডিজ় কামরার শ্রোতা হয়ে জেনেছি, মোটের উপরে মেয়েদের এই অবস্থান-চিত্রের বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই কোথাও। বুঝেছি শিক্ষা বা বিত্তের সঙ্গে মেয়েদের অধিকারের সম্পর্কটি একমাত্রিক নয়, এর মাঝে আছে আরও অনেক খেলা। বুঝেছি, লিঙ্গবৈষম্য এ দেশের অন্তরাত্মায় বয়। তাই খেমাশুলির ফুলমণির মতো দিল্লির জোরবাগের উচ্চবিত্ত পরিবারের রোজগেরে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী অনিতা বর্মাকেও (নাম পরিবর্তিত) রোজগারের বৃহদংশই তুলে দিতে হয় স্বামী-শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে। কাজ করতে যাওয়ার স্বাধীনতাটুকুর বিনিময়ে। রোজগার করলেই যে মেয়েরা বাড়ি-গাড়ি-সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না, পৃথিবীর নানান পিছিয়ে পড়া ও অনুন্নত দেশে সমীক্ষা করে তা প্রমাণ করেছেন গবেষকরা।
এক বার বিয়ে হয়ে গেলেই স্থায়ী ভাবে আর বাপের বাড়ি ফিরতে না-পারার বাধ্যবাধকতাটিও শত অত্যাচারের পরেও মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি আঁকড়ে পড়ে থাকার একটা কারণ। আসলে তাঁরা জানেন, ফিরে গেলে লাভ হবে না কিছুই। আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধব-সহ নিজের বাবা-মাও তাঁকে, আর একটু মানিয়ে নিয়ে, আর একটু সহ্য করে শ্বশুরবাড়িতেই ফিরে যাওয়ার নিদান দেবেন। ঘোরতর সামাজিক নিয়মানুদেশে আবদ্ধ এ দেশের বৈবাহিক ব্যবস্থা, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িকেই ‘নিজের বাড়ি’ বলে ভাবতে শেখায় মেয়েদের। এর বাইরে নিজের জন্য পৃথক কোনও বাসস্থানের কথা এ দেশের মেয়েদের বৃহদংশের কল্পনাতেও আসে না। শহুরে, শিক্ষিত মেয়েদের যৎসামান্য অংশই তা করতে পারেন।
কিন্তু এতে রয়েছে অন্য এক সামাজিক সমস্যা। কারণ বিয়ের পর নবযুগলের আলাদা থাকার ব্যাপারটাকে ভারতীয় সমাজ এখনও সুনজরে দেখে না। পরিসংখ্যানের হিসাবে এ দেশের ৪৩% স্বামী-স্ত্রী পৈতৃক বাসভবন ছেড়ে আলাদা বাড়িতে সংসার পাতেন বটে, কিন্তু একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তা এক প্রকার বাধ্যবাধকতার ব্যবস্থা। কর্মসূত্রে ভিন্ন শহরে থাকা, শ্বশুরবাড়িতে স্থানাভাব বা তার প্রত্যন্ত অবস্থান, বাড়ির অমতে বিয়ে অথবা অন্য ধর্মের, অন্য জাতের মেয়েকে পরিবার মেনে নেয়নি— এমন কিছু-না-কিছু সমস্যা ছাড়া শুধুমাত্র নিজেদের মতো করে একটা ব্যক্তিগত জীবন কাটানোর উদ্দেশ্যে পৃথক বাসস্থানের আয়োজন করে উঠতে পারেন খুব কম দম্পতিই। ছেলেদের নিজের বাবা-মা’কে ছেড়ে অন্যত্র থাকার ব্যাপারটিকে ব্যক্তিগত পছন্দের মান্যতা দেয় না সমাজ। তাকে দাগিয়ে দেয় ছেলে হিসাবে মা-বাবার প্রতি কর্তব্যে অবহেলা বলে। তাই সেই ‘সামাজিক অপরাধ’ ভাবনায় মলম লাগিয়ে নিজের কর্তব্যপরায়ণতার পরিচয় দিতে এ দেশের ছেলেরা বিবাহোত্তর জীবনেও অনেক সময়েই নিজের রোজগারে বানানো বাড়ি, গাড়ি-সহ নানান সম্পত্তি নিজের মা-বাবার নামেই করেন। এমন অবস্থায় কোনও কারণে বিবাহোত্তর জীবন অনুকূল না-হলে এই সম্পত্তির উপরে নিজের আইনি অধিকার প্রমাণ করার লড়াই চালাতে হয় মেয়েদের।
তবে, এই আলাদা বাসস্থান ব্যবস্থার ভাবনা এখনও এ দেশের মুষ্টিমেয় দম্পতির জন্যই প্রযোজ্য। কারণ কর্মসংস্থানের অভাব, অতি স্বল্প বেতনের চাকরি, মূল্যবৃদ্ধি এবং সর্বোপরি গত দশ বছরে এ দেশের ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্য ও সম্পদের অসম বণ্টন এ দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে বাড়ির মতো স্থায়ী সম্পদ বানানোর পথে বাধা। পৃথক বাড়ি তো দূর, ৬৯তম জাতীয় নমুনা সমীক্ষার প্রতিবেদন বলছে যে, এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিবাহিত যুগলের ‘শেয়ারড হাউসহোল্ড’ বা ভাগের বাড়িতে পৃথক কোনও ঘরের ব্যবস্থাই নেই।
এ দেশের মেয়েদের এই বাসস্থানজনিত সমস্যার কথা মাথায় রেখে ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট তার ১৫ বছরের পুরনো একটি রায় খারিজ করেছিল। ২০০৭ সালের রায়টিকে খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল যে, কোনও বিবাহিত মহিলার শ্বশুরবাড়িটি যদি তাঁর স্বামীর নামে না-হয়ে শ্বশুরবাড়ির অন্য কোনও ব্যক্তির নামেও হয়, তা হলেও তাঁর সেই ‘ভাগের বাড়ি’-তে বসবাসের পূর্ণ অধিকার থাকবে। অন্যথায় স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে সমরূপ অন্য কোনও বাসস্থানের আয়োজন করে দিতে হবে বধূটিকে।
২০০৭ সালের মামলাটি ছিল এই রকম— এক দিল্লিনিবাসী ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করেন। সেই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই— খোরপোশ-সহ কোনও রকম আর্থিক বোঝাপড়া হওয়ার আগেই— মামলাকারী ব্যক্তির স্ত্রীকে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাড়ি থেকে বার করে দেন। মহিলার স্বামী কর্মসূত্রে অন্য রাজ্যে থাকলেও, মহিলা নিজে শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন। তাই সেখান থেকে বার করে দেওয়ার ফলে তিনি গৃহহীন হয়ে পড়েন। শ্বশুরবাড়িতে বসবাসের অধিকারের দাবিতে তিনি সুপ্রিম কোর্ট অবধি গেলেও, কোর্ট তাঁকে সেই অধিকার দিতে ব্যর্থ হয়। আদালত বলে, শ্বশুরবাড়িটি মহিলার স্বামীর নামে নয়, তাঁর শাশুড়ির নামে। তিনি যে-হেতু তাঁর পুত্রবধূর বাসস্থানের দায়িত্ব নিতে আইনত বাধ্য নন, তাই ওই মহিলার শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারার বিষয়টিও আইনত ধার্য করা সম্ভব নয়।
শুধু তো এ রকম বিচ্ছেদের মামলার ক্ষেত্রে নয়, নিজের নামে বাড়ি না-করেই গত হওয়া কোনও স্বামীর স্ত্রীকেও অনেক সময়ই এই সমস্যায় পড়তে হয়। এই রকম আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তিত রায়টি বহু কাঙ্ক্ষিত ও কল্যাণকর। কারণ এটি মেয়েদের বাসস্থানের অধিকারের সাদাকালো সংজ্ঞার ঊর্ধ্বে উঠে নির্মিত এক বহুমাত্রিক সিদ্ধান্ত; যা একাধারে মানবিক এবং এ দেশের মহিলাদের প্রতি ঘটে চলা অসাম্যের কথা মাথায় রেখে তৈরি। আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতের বহু মেয়ের বাসস্থানের সমস্যার সমাধান করবে এই রায়। তবে শুধু আইন করেই তো সমস্যার সমাধান হয় না। প্রশ্ন জাগে, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতি, সামাজিক ধ্যানধারণার পরিবর্তন এবং মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রোজগারের সুযোগ না-বাড়লে এই সমস্যার সমাধান কি আদৌ সম্ভব? বিবাহিত মহিলাদের শ্বশুরবাড়িতে বাসের অধিকার নিয়ে মামলা-মকদ্দমার পাশাপাশি, মেয়েদের নিজের বাপের বাড়িতে ফিরে আসার সামাজিক অধিকারটিও স্থাপিত হবে না কেন?
ভার্জিনিয়া উল্ফ লিখেছিলেন, নিজের টাকা আর সম্পূর্ণ নিজের একটা ঘর, এ দুটো জিনিস না থাকলে কোনও নারীর পক্ষে সৃষ্টিমূলক রচনা সম্ভব নয়। আর নিজের জীবনের চেয়ে বড় উপন্যাস কে-ই বা কবে লিখেছে?