বিশ্ব-দরবারে: (বাঁ দিক থেকে) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদী, জি৭ বৈঠক, হিরোশিমা। ছবি: রয়টার্স।
মাঝে কিছু দিনের ব্যবধান ছিল। দেশে জি২০-র মহাযজ্ঞ, কর্নাটকের নির্বাচনের জন্য তপ্ত প্রহরে দীর্ঘ পথযাত্রা ও জনসভার কারণে কয়েক মাস সেই পরিচিত ফ্রেম দেখতে পাননি দেশবাসী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ত্রিদেশীয় সফরে মাঝের শূন্যতা ভরাট তো হয়েছেই, বরং উপচে পড়েছে বলা যায়।
না, হাতে বিশেষ কিছু আসেনি পেনসিল ছাড়া— জাপান, পাপুয়া নিউ গিনি, অস্ট্রেলিয়া সফরে কিছু পাওয়ার কথাও ছিল না। কিন্তু ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিয়েছে ছবিতে-গল্পে, নাটুকে সংলাপে, আলিঙ্গন-কূটনীতির উষ্ণতায়। আমরা দেখেছি জো বাইডেন, ঋষি সুনককে প্রবল দার্ঢ্যে জড়িয়ে ধরেছেন নরেন্দ্র মোদী। তাঁরাও মুখ-মিষ্টি সংলাপ বলেছেন দেদার, যাতে তাৎক্ষণিক হাততালি রয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রান্তিক কৃষকের সার কেনার হদিস, মাল রাখার হিমঘর, সঠিক দাম পাওয়ার আশ্বাস, কোটি কোটি বেকারের চাকরির রূপকথা, পিছিয়ে থাকা বর্গের কাছে নিত্য ফেনাভাতের গন্ধ, গোটা দিনের বাণিজ্য সেরে রাম-রহিমের এক সঙ্গে বিড়িতে সুখটান দেওয়ার নির্ভরতা বা নিশ্চয়তা, কোনওটাই নেই।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ় ব্রুস স্প্রিংস্টিন-এর উদাহরণ টেনে বলেছেন, ও সব তুশ্চু! আসল ‘বস’ হলেন মোদী! কিন্তু হদিস নেই যে, সেই ‘বস’-এর দেশের অজস্র ছাত্রছাত্রীর অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে যাওয়ার উপর যে খাঁড়ার ঘা দিয়েছেন তিনি, তা কবে উঠবে? বাইডেন তোষামোদকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে জি৭-এর নৈশাহারে মোদীকে বলেই ফেললেন, জুন মাসে তাঁকে ডেকে ভারী বিপদ হয়েছে— গোটা দেশ নাকি ভেঙে পড়ছে ওয়াশিংটনে মোদীর নৈশাহারের টিকিট পাওয়ার জন্য। কিন্তু এটা বললেন না যে, এত বছর ধরে নয়াদিল্লি প্রাণপাত করার পরেও কেন আমেরিকা এই প্রবল জনপ্রিয় নেতার সঙ্গে বাণিজ্য-চুক্তির ক্ষেত্রে নিজেদের কায়েমি শর্তগুলির সিকি ভাগও লঘু করতে রাজি নয়? একই ভাবে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবি দেখে আসমুদ্রহিমাচল শ্লাঘা বোধ করেছে। কিন্তু তাতে মাত্র দু’মাস আগে লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনে খলিস্তানি তাণ্ডবের তিক্ততম স্মৃতি কিছু ম্লান হচ্ছে কি? আর গড়পড়তা দেশবাসীর কাছে পাপুয়া নিউ গিনি দেশটা খায়-না-মাথায়-দেয়, তার কোনও সুস্পষ্ট ধারণা নেই। ফলে সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর মোদীর পা ছুঁয়ে প্রণামের প্রসঙ্গটা নাহয় বাদই রাখা গেল।
কিন্তু, মোদী ফিরে এলেন বিশ্বগুরুর ভাবমূর্তিকে আরও শক্তপোক্ত করে। ফিরেই সংসদের নতুন ভবন উদ্বোধন করে বললেন, “আজ গোটা বিশ্ব ভারতের সঙ্কল্পের দৃঢ়তা এবং প্রখরতাকে, জিজীবিষাকে অত্যন্ত আশা এবং আনন্দের সঙ্গে দেখছে। আজ ভারত অগ্রসর হলে বিশ্বও অগ্রসর হবে।” বিরোধীশূন্য সংসদ, সুতরাং ‘গোটা লোকসভা’ মোদীর নামে জয়ধ্বনি দিল।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। নির্বাচনী বছরে আন্তর্জাতিক সিলমোহর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘরোয়া রাজনীতির জন্য। শুধু দেশকে নয়, গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে নরেন্দ্র মোদী পথ দেখাচ্ছেন, এই ধারণা রাজস্থান সীমান্তের কোনও দিন আলো-না-জ্বলা কুঁড়ে ঘর বা মধ্যপ্রদেশের উচ্ছেদের ভয়ে কুঁকড়ে থাকা জনজাতি গ্রামেও ভাল বিক্রি হয়। কিন্তু এর সঙ্গে মোদী এবং বিজেপি নেতৃত্ব যে ডঙ্কাটি বাজাতে শুরু করেছেন, তা আসলে বিশ্বগুরু প্রকল্পেরই বর্ধিত অংশ। সেটা হল— ভারত শুধু বৃহত্তম গণতন্ত্রই নয়, গণতন্ত্রের জননী। গোটা পৃথিবীকে গণতন্ত্রের দিশা দেখাচ্ছে তাঁর সরকার। প্রাচীন মহাভারত জুড়ে গণতন্ত্রের ছড়াছড়ি।
পাঠককে সঙ্গে নিয়ে একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক ২০২১-এর ডিসেম্বরে। বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নিয়েছেন কিছু আগে। গোটা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ছন্নছাড়া অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, গণতন্ত্রকে স্যালাইন জোগাতে বাইডেন আয়োজন করেছিলেন, ‘সামিট ফর ডেমোক্র্যাসি’। সেই সম্মেলনের কয়েক মাস আগে গণতন্ত্র, মানবাধিকার সংক্রান্ত আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন অসরকারি সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউস’ তাদের বার্ষিক রিপোর্টটি প্রকাশ করে। সেখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয় যে, ২০১৪ সালে মোদী সরকার গড়ার পর ভারতে মানবাধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমশ কমেছে। বেড়েছে মানবাধিকার সংস্থা, সাংবাদিকের উপর চাপ, মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়ন।
আরও বলা হয়, মোদী এবং তাঁর দল ভারতকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে একনায়কতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এই রিপোর্ট প্রকাশের পর গর্জে উঠেছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। যেমন পশ্চিমের মানবাধিকার-সংক্রান্ত যে কোনও সমালোচনাতেই অধুনা বার বার তাঁর ক্ষোভ আমরা দেখতে পাই। মনে পড়তে পারে, সে দিন জয়শঙ্কর বলেছিলেন, “ভারতের বাইরের থেকে শংসাপত্রের প্রয়োজন নেই।”
বাইডেন আয়োজিত ওই গণতন্ত্র-সংক্রান্ত সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদী তাঁর তত্ত্বের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন। যে তত্ত্ব আসলে বিজেপি তথা আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদেরই পরবর্তী (আন্তর্জাতিক) ধাপ। মোদী দাবি করলেন, গণতন্ত্র কোনও আধুনিক পশ্চিমি দর্শন নয়। ভারতের সভ্যতার অভ্যন্তরে তা ঐতিহ্যগত ভাবে রয়ে গিয়েছে। হিন্দু ইতিহাস ঘেঁটে তিনি সে দিন আড়াই হাজার বছর আগের একটি গণতান্ত্রিক প্রদেশের কথা বলেছিলেন। দশম শতকে তামিলনাড়ুর একটি মন্দিরগাত্রের হরফে গণতন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে, বলেছিলেন সে কথাও।
অর্থশাস্ত্র, মনুসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, মহাভারতের রাজধর্ম পর্যায়ের সংস্কৃত নথি ঘেঁটে কী পাওয়া যাবে— প্রাচীন ভারতে শাসনের মূল ধারা রাজতন্ত্র ছিল, না কি গণতন্ত্র, সে তর্কে যাচ্ছি না। এখানে যেটা বেশি প্রয়োজনীয় সেটা হল, নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকেই সুকৌশলে ঢাল হিসাবে কী ভাবে ব্যবহার করলেন মোদী, এবং ক্রমশ সেখান থেকে তৈরি হল বিশ্বগুরুর তত্ত্ব— এই প্রক্রিয়াটিকে বুঝে নেওয়া। উদার আন্তর্জাতিক বিশ্ব-ব্যবস্থার সমর্থকদের মোকাবিলা করে সে দিন মোদী বার্তা স্পষ্ট করেছিলেন। ভারতের গণতান্ত্রিক বোধ তার সভ্যতার আত্মায় প্রোথিত, উদার শাসনধর্ম অন্য কোনও দেশের নকলনবিশি নয়, বহু প্রাচীনকাল থেকেই তা ভারতে রয়েছে।
এখানে যা প্রণিধানযোগ্য তা হল, মোদীর এই বলিষ্ঠ ঘোষণা কেবলমাত্র ভারতের প্রাচীন সভ্যতাকে আলোকপর্ণা করে তোলার নিমিত্তই ছিল না। আরও বড় উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। তা হল, তাঁর নিজের নেতৃত্ব এবং হিন্দুত্ববাদী দর্শনের আলোয় ভারতকে বিশ্বগুরু হিসাবে দেখানোর। এটা বলাও অতিশয়োক্তি হবে না যে, বিশ্বগুরুর ধারণা বাইরের দিকে মুখ করা একটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রকল্প বিশেষ। যার অন্য মুখটি ফেরানো রয়েছে ঘরোয়া রাজনীতির দিকে। পাশাপাশি আরএসএস-এর দীর্ঘমেয়াদি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতি আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে এ এক রকম সম্মতি কুড়িয়ে নেওয়া, যা ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক হিন্দুত্বসঙ্গীতের স্থায়ী বা অন্তরা হয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক সিলমোহরকে গত আট বছর তো বটেই, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই ঘরোয়া ভাবমূর্তি তৈরির মশলা হিসাবে ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে মোদীকে। বিজেপি নেতৃত্ব যে শিরোনামে এই প্রচারকে বিভিন্ন ভাবে সাজিয়েছেন, সেটি হল— “বিশ্ব মোদীকে বন্দনা করে। যা প্রতিটি ভারতীয়ের গর্বের কারণ।”
আসলে, মোদী সরকার গণতন্ত্রের লাঞ্ছনা করছে— এই অভিযোগ নিয়ে পশ্চিমের তির যখন ছুটে আসে, তখন এই সভ্যতা ও ঐতিহ্যের জাতক এবং গণতন্ত্রের জননীর তকমা কাজে লাগছে সেই তিরকে ভোঁতা করে দিতে। এই সভ্যতার জাতক তত্ত্বের অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হল, রাষ্ট্রের মূল্যবোধ তার নিজেরই সংস্কৃতি এবং ইতিহাস থেকে উৎসারিত। ঔপনিবেশিক পশ্চিমের শক্তির কাছ থেকে তার উদারতার জ্ঞান নেওয়ার প্রয়োজন নেই। অধুনা আমাদের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর তাই পশ্চিমের করা সমালোচনায় মাঝেমাঝেই জ্বলে ওঠেন। বলেন, “যে-হেতু ভারতের কেউ এক জন অনুমোদনের অপেক্ষায় পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকেন না, তারা যে ভাবে নাচাতে চাইছে সে ভাবে নাচেন না, ফলে বিষয়টি হজম করতে তাদের খুব সমস্যা হচ্ছে।”
‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বাইরে থেকে দেশ যখন অপমানিত হয়, “আমাদের দেশের কোনো দুর্বলতা কোনো ত্রুটি স্বীকার করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে ওঠে। তখন যে কেবল আমরা পরের কাছে মুখরক্ষা করিবার জন্যই গরিমা প্রকাশ করি তাহা নহে, আহত অভিমানে নিজের অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের বুদ্ধিও অন্ধ হইয়া যায়, আমরা যে অবজ্ঞার যোগ্য নহি তাহা চক্ষের পলকেই প্রমাণ করিয়া দিবার জন্য আমরা একান্ত ব্যগ্র হইয়া উঠি।”
তখন যে বিশ্বগুরু তত্ত্ব আমদানিরও প্রয়োজন হয়, এ কথা অবশ্য রবীন্দ্রনাথ সে দিন লিখে যাওয়ার কালখণ্ড পাননি!