এক হাজার দিন পূর্ণ হল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের, কিন্তু কবে তা শেষ হবে কেউ বলতে পারে না। অনেকে মনে করছেন যে ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট পদে এসে যুদ্ধে ইতি টানবেন। কিন্তু কী ভাবে? কবে? প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছেন। তিনি ইউক্রেনকে অনুমতি দিয়েছেন, আমেরিকার দেওয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার অভ্যন্তর লক্ষ্য করে ছুড়তে পারে ইউক্রেন। এর আগে কেবলমাত্র রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য, ইউক্রেনের অভ্যন্তরে ওই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি ছিল। মাস দুয়েক পরেই যিনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যাবেন, তাঁর পক্ষে এমন গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই।
রাশিয়াও পাল্টা চাপ তৈরি করছে এই বলে যে, আণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নীতিতে তারা সংস্কার আনতে পারে। ফলে আশঙ্কা ছড়িয়েছে যে, কিভ-এর উপরে আণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে মস্কো। এমন ঘটলে বহু দেশে তার প্রভাব পড়বে। বিশেষ অভিঘাত হবে ভারতের উপর— ভারত অনেক দিন ধরেই রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে ভারসাম্য রাখার কঠিন কাজটা করে চলেছে।
বাইডেনের সিদ্ধান্তের পিছনে নানা যুক্তি থাকতে পারে। নির্বাচনে তাঁর দল প্রায় ধূলিসাৎ হয়েছে, আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টেও এখন রিপাবলিকান-মনোনীত বিচারপতিদেরই আধিপত্য বেশি। ইউক্রেন নীতিতে বাইডেনের শেষ মুহূর্তের মোচড় হয়তো ট্রাম্পকে কঠিন পরীক্ষার সামনে ফেলার শেষ চেষ্টা। সরকারি বয়ান অবশ্য এই যে, এ হল আমেরিকার প্রতিক্রিয়া। উত্তর কোরিয়া থেকে রাশিয়া সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে, তা জেনে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাইডেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, যুদ্ধ সমাপ্তির জন্য আলোচনা, দরদস্তুর যখন শুরু হবে, তখন এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের খানিকটা সুবিধে করে দিতে পারে।
ইউক্রেনকে পশ্চিমের যে দেশগুলো সমর্থন করছে, তাদের অনেকেই মনে করছে যে ইউক্রেনকে তারা যথাসাধ্য সহায়তা করা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি কার্যত যুদ্ধ হেরেই গিয়েছেন। এই ধারণা বদলানোর জন্য জ়েলেনস্কি কৌশল বদলেছেন। কেবল প্রতিরক্ষার জন্য শক্তি ব্যয় না করে তিনি রাশিয়ার উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছেন। দখল করতে পেরেছেন রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কুর্স্ক নামে রাশিয়ার একটি শহরকে। রাশিয়ার সামরিক ইতিহাসে কুর্স্কের ভূমিকা সামান্য নয়। স্তালিনগ্রাদের পরে কুর্স্কই দ্বিতীয় শহর, যা নাৎসি জার্মানির সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। জ়েলেনস্কি আশা করছিলেন, ইউক্রেনের কাছে কুর্স্ক হারানোয় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভাবমূর্তি আহত হবে, এবং তা কাজে লাগিয়ে কুর্স্কের বিনিময়ে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ইউক্রেনীয় এলাকাগুলি ফেরত নিতে পারবে ইউক্রেন। তবে পাশ্চাত্যের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই কৌশল শেষ অবধি কাজ করবে না। কারণ, যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার জন্য রাশিয়ার অভ্যন্তরে যে পুতিনের উপর খুব চাপ রয়েছে, এমন নয়। আর, ইউক্রেনের সেনা কুর্স্ক দখল করে থাকায় রাশিয়ায় ইউক্রেন-বিরোধিতা আরও গাঢ় হবে, কুর্স্ক পুনরুদ্ধারে আরও মরিয়া হয়ে উঠবে রাশিয়ার মানুষ, সেই সম্ভাবনাও রয়েছে।
তা হলে যুদ্ধ শেষ করার উপায় কী? কোন কোন বিষয়ে সহমত তৈরি করতে হবে দু’পক্ষকে? রাশিয়া চাইছে ইউক্রেনের নেতৃত্বে পরিবর্তন— তারা জ়েলেনস্কিকে সরিয়ে মস্কোর প্রতি অনুকূল কোনও নেতাকে বসাতে চায়। ইউক্রেনের যে কুড়ি শতাংশ জমি এখন রাশিয়ার দখলে, তার উপর রাশিয়ার কর্তৃত্বের বৈধতা চায়। ইউক্রেনকে কখনও নেটো-র সদস্য করা হবে না, এই প্রতিশ্রুতি চায়। এবং ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রাশিয়ার ভূমিকাকে পাকাপোক্ত করতে চায়।
অন্য দিকে, ইউক্রেন তার সমস্ত ভূখণ্ডকে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে চায়। ইউক্রেনের দাবি, যুদ্ধের সব ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে মস্কোকে। পুতিনকে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত করে বিচার করতে হবে। নেটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যপদ দিতে হবে ইউক্রেনকে।
দু’পক্ষের ইচ্ছা-তালিকার কোনওটাই পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়, তাই কোনওটাই ট্রাম্প কিংবা ইউরোপীয় নেতাদের সমর্থন পাবে না। ট্রাম্প যুদ্ধ শেষ করতে চান বটে, কিন্তু অনেকেই ভুলে যান যে প্রথম বার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ট্রাম্পই ইউক্রেনকে অস্ত্রের জোগান দেওয়া শুরু করেছিলেন। তাঁর গঠিত গোয়েন্দা-চক্র থেকে পাওয়া খবরের ফলেই যুদ্ধের সময়ে রাশিয়ার বাহিনীর অগ্রগতি বিলম্বিত হয়েছিল। মস্কোর শাসকরা ট্রাম্পকে বিশ্বাস করেন না, যদিও ট্রাম্পের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চান পুতিন।
শান্তির কথাবার্তা শুরু করার জন্য কয়েকটি সম্ভাবনার কথা ভাবা হচ্ছে। যেমন, যুদ্ধবিরতির একটা ভৌগোলিক সীমা নির্ণয় করা যায়, যা দু’পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। নেটোয় ইউক্রেনের প্রবেশে একটা দীর্ঘ বিরতি আরোপ করা যায়, রাশিয়ার দখলে-থাকা ইউক্রেনীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ আপাতত রাখা যায় রাশিয়ার হাতে। তবে রাশিয়ার সম্পূর্ণ বিজয় কখনও মেনে নিতে চাইবে না পশ্চিমের দেশগুলো। জ়েলেনস্কিও যে এই দীর্ঘ যুদ্ধ থেকে কিছু লাভ করেছেন, তা দেখাতে চাইবে। তাই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ইউক্রেনের প্রবেশকে এখনই চূড়ান্ত করা যেতে পারে।
এই যুদ্ধের শেষে সম্ভবত দেখা যাবে যে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে বিপুল সংখ্যায় মানুষ, বিশেষ করে শহরের বাসিন্দারা, দেশ ছাড়ছেন। তিন কোটি জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছেও এই জয় এসেছে চরম মূল্যে। যুদ্ধের আগে রাশিয়ার সীমান্তে ইউক্রেন ছিল এক গোলমেলে পড়শি দেশ। আর এই দীর্ঘ সংঘাত-শেষে তার দুয়ারে থাকবে এক চিরকালীন শত্রু।