কলকাতার এমারাল্ড থিয়েটারে (যা বহু দিন কালগর্ভে বিলীন) ১৩০২ বঙ্গাব্দের ১৩ শ্রাবণ বিদ্যাসাগরের সাম্বাৎসরিক স্মরণসভায় রবীন্দ্রনাথ একটি বক্তৃতা পাঠ করেছিলেন, যা পরবর্তী কালে তাঁর চারিত্রপূজা গ্রন্থের প্রথম রচনা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। রচনাটির প্রথম ভাগে বিদ্যাসাগর ও রাজা রামমোহন রায়কে আদর্শ মানুষ হিসাবে পাশাপাশি রেখে কবি তাঁদের দু’টি প্রধান লক্ষণের কথা বলছেন: একটি অনন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য (বা, ‘নিজত্ব’), অন্যটি সর্বজনীন মনুষ্যত্বের। “মহৎ ব্যক্তিরা এই নিজত্বপ্রভাবে একদিকে স্বতন্ত্র, একক— অন্য দিকে সমস্ত মানবজাতির সবর্ণ, সহোদর। আমাদের দেশে রামমোহন রায় এবং বিদ্যাসাগর উভয়ের জীবনেই ইহার পরিচয় পাওয়া যায়। এক দিকে যেমন তাঁহারা ভারতবর্ষীয়, তেমনি অপর দিকে য়ুরোপীয় প্রকৃতির সহিত তাঁহাদের চরিত্রের বিস্তর নিকটসাদৃশ্য দেখিতে পাই। অথচ তাহা অনুকরণগত সাদৃশ্য নহে।”
কিন্তু কেন এমন মানুষদের আবির্ভাব হয়? কেন ‘প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে’ রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও কতিপয় ‘বিরল’ মানুষ এই বঙ্গদেশে অবতীর্ণ হয়েছিলেন? বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অতুল চারিত্রগুণাবলির কথা বিস্তৃত আলোচনার শেষে রবীন্দ্রনাথ উপনীত হচ্ছেন এক আলোকবর্তিকাসম সিদ্ধান্তে: “...দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব...”। এখানে যোগ করা প্রয়োজন যে, ‘পৌরুষ’ কথাটি রবীন্দ্রনাথ কেবল পুরুষমানুষের গুণগত বৈশিষ্ট্য হিসাবে নয়, ‘অকুতোভয় আপসহীনতা’ অর্থে বলেছিলেন। ‘এই ক্ষুদ্রকর্মা ভীরুহৃদয়ের দেশে’ কোটি কোটি বাঙালির মাঝে, পারিপার্শ্বিক সমাজ-রাজনীতির একই অবস্থার মধ্য থেকে হঠাৎ এক জন মানুষ কেন, কিসের জোরেই বা অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়, তা আসলে, একটি বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতিতে থেকেও, তার সীমানা পেরোনোর গল্প।
আঠারো শতকের শেষার্ধে বাংলার, বিশেষত বাঙালি হিন্দুদের যে সমাজবিন্যাস, কোম্পানির রাজধানী তথা নতুন পত্তন কলকাতা শহরে তা উনিশ শতকের গোড়ায়ও কিছুটা ভিন্ন ও বিচিত্র ভাবে মোটের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। মধ্যস্বত্বভোগী, সাহেবদের মোসাহেবি করে আখের-গোছানো লোকেদের সংখ্যা বাড়তে লাগল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকেও এই সামাজিক বিন্যাস ও পরিবেশ বেশ বজায় ছিল, তবে ওই শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে একটা নতুন হাওয়া বইতে লাগল। শিবনাথ শাস্ত্রী মশাই এই ‘নবযুগ’-এর জন্মকালকে চিহ্নিত করেছেন ১৮২৫ থেকে ১৮৪৫ সাল অবধি কুড়ি বছরের কালকে। তাঁর কথায়, “এই কালের মধ্যে কি রাজনীতি, কি সমাজনীতি, কি শিক্ষাবিভাগ সকল দিকেই নবযুগের প্রবর্তন হইয়াছিল।”
এই নতুন যুগের হাওয়া বিদ্যাসাগরের চিত্তে প্রবল ভাবে লেগেছিল অবশ্যই, তবে তার ফলাফল নবযুগের অন্য দিশারিদের চেয়ে অনেকাংশেই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হয়েছিল। হিন্দু কলেজের ইংরেজিমাধ্যমে পড়া ও ‘যা-কিছু-দেশি তা-ই পরিত্যাজ্য’, এমতে বিশ্বাসী ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠীর পথ অথবা তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের প্রাচীন শাস্ত্র-নির্ভর পরিবেশ, কোনওটিরই অনুসরণ না করে, তিনি প্রায় একার উদ্যোগে জেলায় জেলায় আধুনিক বাংলা স্কুল স্থাপন করে গিয়েছেন। মাতৃভাষায় বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও যুক্তিবাদে নবীন শিক্ষার্থীদের মন নিষিক্ত করতে চেয়েছেন। সঙ্গে কেউ আসুক না আসুক, সমাজ সংস্কারের ঊষর ও কণ্টকাকীর্ণ পথেও তিনি নিজেই নিজের রাস্তা বানাতে চেয়েছেন।
সতীদাহ-রদের ক্ষেত্রে রামমোহন রায়কে তাঁর সমসময়ের প্রেক্ষিতে যে যুক্তি দাঁড় করাতে হয়েছে, তা হল— চিতায় প্রাণ বিসর্জন দিয়ে নয়, আজীবন কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করেই স্ত্রী তাঁর মৃত স্বামীর প্রতি পুণ্য কর্তব্য সম্পন্ন করবেন। কিন্তু সহমরণের বদলে যে সুদীর্ঘ কঠোর নিয়ম মেনে বৈধব্য বহন করার দায়, আট থেকে আশি বছরের বিধবাদের উপর বর্তালো, তা কি সহমরণের চেয়েও কিছু কম! এই নিয়ে সেই সময় থেকে অনেক কাল নানা বক্তব্য নানা ভাবে উঠে এসেছে। সোজা ভাবে বললে, রামমোহন তো বিধবাকে জ্বলন্ত চিতা থেকে বাঁচালেন, কিন্তু তাঁদের সামনে পড়ে রইল কঠোর বৈধব্য পালনের এক দীর্ঘ করুণ জীবন। অতঃ কিম্? এখান থেকেই বিদ্যাসাগরের শুরু। এই প্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের গুরুত্ব, যে আন্দোলনকে চিহ্নিত করা যায় সতীদাহ-রদ আন্দোলনের যৌক্তিক উপসংহার হিসাবে।
সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যে সব সংস্কারের উদ্যোগ করেছিলেন, তাদের কেন্দ্রে ছিল মেয়েদের প্রতি তাঁর বিশেষ দরদি মনোভাব। বিধবা নারীদের অবর্ণনীয় কষ্টের জীবন শৈশবেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অথচ তাঁর প্রখর কাণ্ডজ্ঞানের ফলেই বুঝেছিলেন, তাঁর সমাজের অধিকাংশ মানুষই, ‘বিধবাবিবাহ’-এর ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। তাই শুধু আইন প্রবর্তন করে হবে না, পরিবর্তনকে স্থায়ী করতে গেলে শাস্ত্রসিদ্ধতা ও আইন প্রণয়ন, দুইয়েরই প্রয়োজন।
বিধবাবিবাহ বিষয়ক ‘প্রথম প্রস্তাব’-এর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন: “যদি, যুক্তি মাত্র অবলম্বন করিয়া ইহাকে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এতদ্দেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন।... অতএব, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত বা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কর্ম, ইহার মীমাংসাই সর্বাগ্রে আবশ্যক।” এবং তা করতে গিয়ে, অন্যান্য শাস্ত্রের চেয়ে কলিযুগের আদর্শ ‘পরাশর সংহিতা’-র চতুর্থ অধ্যায় থেকে তিনি উদ্ধৃত করছেন সেই অভীষ্ট পঙ্ক্তিগুলি (রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য অনুযায়ী ১৮৫৩ সালের শেষ দিকে তাঁর বাড়িতে পরাশরের পুঁথি ওল্টাতে ওল্টাতে, তিনি এই লাইন ক’খানি আবিষ্কার করে আর্কিমিডিসের মতো, ‘পেয়েছি, পেয়েছি’ বলে ওঠেন), যার প্রথম দুই লাইনে বলা হয়েছে— “স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব স্থির হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত।” পরাশর বলেছেন, পুনর্বিবাহ ছাড়া স্ত্রী ব্রহ্মচর্যও অবলম্বন করতে পারে অথবা সহমরণেও যেতে পারে। এই অবধি বলে, বিদ্যাসাগর দুঁদে উকিলের মতো যুক্তি দিচ্ছেন, পরাশরের দেওয়া তৃতীয় বিধান, অর্থাৎ ‘সহমরণ’-এ যাওয়া ‘রাজকীয়’ আদেশক্রমে’ (সতীদাহ নিবারণী আইন প্রণয়নের ফলে) আর সম্ভব নয়, তাই হাতে রইল পরাশরের দেওয়া দু’টি পথ: বিধবাদের পুনর্বিবাহ অথবা আজীবন ব্রহ্মচর্যের মাধ্যমে বৈধব্য পালন। তাই আগে বৈধব্য পালনের যে একমাত্র বাধ্যতা ছিল, তা থেকে মুক্ত হয়ে এখন বিধবাদের কাছে দু’টি পছন্দ রইল, “ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক, ইচ্ছে হয় ব্রহ্মচর্য্য করিবেক।”
বিধবাবিবাহবিষয়ক ‘প্রথম পুস্তক’টি ছাপা হলে বাংলাদেশের হিন্দুসমাজে বিরোধিতা, কটুকাটব্য, ব্যঙ্গ, এমনকি ‘সং’-যাত্রা প্রভৃতি নানা রূপে রক্ষণশীলরা ফেটে পড়লেন, অনেকে শাস্ত্রীয় কূটপ্যাঁচেও মেতে উঠলেন। এই সবেরই প্রত্যুত্তর দিতে ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসে ‘দ্বিতীয় পুস্তক’টির অবতারণা, যে-গ্রন্থ প্রথমটির তুলনায় আয়তনে অনেক বড়। এই বইয়ের উপসংহারে সব কিছু নৈয়ায়িকদের মতো বিচারের পর যা লিখছেন, তাতেই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ‘অক্ষয় মনুষ্যত্বের’ কণ্ঠস্বর, তাতে নারীজাতির প্রতি চূড়ান্ত আবেগী সমবেদনা ও সমাজকে গ্রাস করা দেশাচার, যা শাস্ত্রকে নিজের মতো ব্যাখ্যা করে পুরুষদের কায়েমি স্বার্থ ধরে রাখে, তাকে তীব্র ধিক্কার দিয়েছেন। তাঁর অননুকরণীয় ভাষায়: “ধন্য রে দেশাচার! তোর কি অনির্বচনীয় মহিমা! তুই অনুগত ভক্তদিগকে দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ রাখিয়া কি একাধিপত্য করিতেছিস।...” ‘ধর্ম’কেও ঠুকে লিখেছেন: “হা ধর্ম! তোমার মর্ম বুঝা ভার! কিসে তোমার রক্ষা হয়, আর কিসে তোমার লোপ হয়, তা তুমিই জান!” আর তার পর, একদম শেষের লাইনে ঝরে পড়েছে মেয়েদের জন্য এই হতাশোক্তি: “হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ কর, বলিতে পারি না!”
এটাই হল, শাস্ত্রকে দিয়ে শাস্ত্রকে কেটে নতুন পথ বানাবার পরেও, মনুষ্যত্বের জন্য সেই শাস্ত্রকেই অতিক্রম করার, সীমানা পেরোনোর বিদ্যাসাগরী ঐতিহ্য। এরই জোরে তিনি বলতে পেরেছেন, “আমি দেশাচারের দাস নহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক হইবে, তাহা করিব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না”। আজ ২৬ সেপ্টেম্বর। আমাদের আজ আবার মনে করার কথা যে, ঠিক এই কারণেই দু’শো বছর পার করেও বাঙালি জাতির কাছে বীরসিংহের ধুতি-চাদর পরা মানুষটি এত আধুনিক, এত অনুসরণযোগ্য।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়